নৌকার গ্রামে নৌকা তৈরি ধুম

বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত কারিগরেরা নৌকা বানানোর কাজে ব্যস্ত থাকেন। ছবি: লেখক
বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত কারিগরেরা নৌকা বানানোর কাজে ব্যস্ত থাকেন। ছবি: লেখক

গ্রামের পাশে গেলেই শোনা যাবে ঠুকঠাক শব্দ। একটি–দুটি নয়, ঘরে ঘরে এ শব্দ। শব্দ যেন মাধুরী মিশিয়ে যায়। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের বালু নদঘেঁষা পিরুলিয়া ও নয়ামাটি এলাকাজুড়ে হাতুড়ি-কাঠের শৈল্পিক ছন্দে যে কারও মন ভরে যাবে। এই দুই গ্রামজুড়ে বর্ষা আসার প্রায় এক মাস আগে থেকেই শুরু হয় নৌকা তৈরির ধুম। গ্রাম দুটির পাশেই বালু নদ ঘেঁষে শনিবার আর বৃহস্পতিবার জমে নৌকা বিক্রির হাট। এ ছাড়া রূপগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী গোলাকান্দাইল হাটে বসে নৌকা বিক্রির হাট। কাকতালীয়ভাবে হলেও এ হাটও বসে প্রতি বৃহস্পতিবার।

বর্ষা ঘনিয়ে এলেই হাট দুটিতে রমরমা নৌকা বিক্রি হয়। বৈশাখ থেকে ভাদ্র পাঁচ মাসের মৌসুমি ব্যবসা। চাহিদা যথেষ্ট, তাই কারিগরদের ব্যস্ততাও বেশি। তবে এবার করোনার কারণে নৌকা বিক্রি নিয়ে কারিগরেরা দুশ্চিন্তায় ভুগছেন।

একদিন সকালে রূপগঞ্জের নগরপাড়া রাজ্জাক চত্বরে গেলে চায়ের দোকানে বসে নৌকা তৈরির কথা লোকমুখে শোনা যায়। সে সূত্র ধরেই স্থানীয় একজনের সহযোগিতা নিয়ে নৌকার গ্রামে যাত্রা। সহযোগী দেইলপাড়া গ্রামের আবুল হোসেন প্রথমে নিয়ে গেলেন পিরুলিয়া গ্রামে। একে একে নৌকার গ্রাম নয়ামাটি ও পরে নৌকার হাট শনিবারের হাটে যাওয়া হয়। এই দুই গ্রাম ছাড়া রাজধানী ঢাকার উত্তর কায়েতপাড়া গ্রামেও নৌকা তৈরি করা হয় বলে আবুল হোসেন জানান।

বিক্রির জন্য রাখা নৌকা। ক্রেতারা নৌকা কেনার জন্য দেখছেন। ছবি: লেখক
বিক্রির জন্য রাখা নৌকা। ক্রেতারা নৌকা কেনার জন্য দেখছেন। ছবি: লেখক

এলাকার বৃদ্ধ নারায়ণ চন্দ্র (সবাই ডাকে নারায়ণবাবু) হাতুড়ি মারছেন। তাঁর ছেলে মলিন চন্দ্র কাঠ চাঁচছেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, পিরুলিয়া ও নয়ামাটি এলাকার কারিগরেরা স্বাধীনতারও আগে থেকে নৌকা তৈরি করে আসছেন। কারও কারও মতে, এ এলাকার নৌকা তৈরির ইতিহাস প্রায় শতাব্দীপ্রাচীন।

পিরুলিয়া এলাকার বৃদ্ধ অঞ্জনকুমার দাস বলেন, ‘আমার জন্মের আগে থেইক্যা বাপ-দাদারা নৌকা বানাইয়া আইতাছে হুনছি।’

কারিগরেরা জানান, নৌকা তৈরির গ্রাম পিরুলিয়া ও নয়ামাটি বললেই সবাই চেনে। তবে এ গ্রাম দুটির ৯০ ভাগ মানুষই হিন্দু সম্প্রদায়ের। হিন্দুরাই দীর্ঘদিন ধরে নৌকা তৈরি করে আসছেন। আশির দশকের পর নৌকা ব্যবসায়ী কমে যায়। অনেকে ভারত চলে যাওয়ায় এখনো শতাধিক পরিবার টিকে রয়েছে কোনোমতে।

দূরদূরান্তের লোকজনও নৌকা কিনে নিয়ে যান। ছবি: লেখক
দূরদূরান্তের লোকজনও নৌকা কিনে নিয়ে যান। ছবি: লেখক

কারিগরেরা বলেন, নৌকা তৈরির কারিগরদের অবস্থা এখন কিছুটা ভাটা পড়েছে। নব্বইয়ের দশকের পর যান্ত্রিক সভ্যতা ফিরে আসায় নৌকার কদর কিছুটা কমে যায়। প্রতিবছর বর্ষায় নৌকা তৈরির ধুম চলে। তবে বন্যা হলে ব্যবসা ভালো হয় বলে জানালেন সুনীল দাস। তিনি বলেন, ‘৮৮ আর ৯৮ সালের বন্যায় অনেক টেহা লাব অইছিলো।’

নয়ামাটি এলাকার নৌকার কারিগর রবি দাস বলেন, ‘কাডের দাম বাইড়া যাওনে লাভটা কম হয়। নাইলে ব্যবসা খারাপ না। আর স্টিলের নৌকার কারণে কিছুডা লছ অইতাছে। তারপরেও খারাপ নাই। ডাইল-ভাত খাইবার পারি।’

নৌকা বানাতে ব্যস্ত এক কারিগর। ছবি: লেখক
নৌকা বানাতে ব্যস্ত এক কারিগর। ছবি: লেখক

তাপস দাসসহ কয়েকজন বলেন, এক একটি নৌকা তৈরি করতে খরচ পড়ে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। আবার লাখ টাকায়ও নৌকা বানানো হয়। কোষা নৌকা বানাতে খরচ পড়ে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা।
নৌকার কারিগর হরিপদ সরকার ও সুবল চন্দ্র সরকার বলেন, প্রতি বৃহস্পতিবার গোলাকান্দাইল ও কায়েতপাড়ার শনিবারের হাটে নৌকা বিক্রির হাট জমে। এখানে শত শত নৌকা বিক্রি হয়। তাঁরা বলেন, ‘দাদু পানি আইলে ব্যবসা ভালাই অয়। তহন নৌকা কেনার ধুম পড়ে। তয় এইবার যেই করোনা আইছে, মনে হয় ব্যবসা ভালা অইবো না।’

রাজধানী ঢাকার নন্দীপাড়া এলাকা থেকে নৌকা কিনতে এসেছেন রজব আলী। কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, বর্ষাকাল এলে নন্দীপাড়া এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। তখন নৌকার প্রয়োজন পড়ে। এখানে ভালো দামে নৌকা পাওয়া যায়।