দক্ষতা-সহনশীলতা বৃদ্ধিতে কাজে লেগেছে করোনা-অবসর

অসহায়দের মাঝে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত
অসহায়দের মাঝে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত

‘লকডাউন খুব উপভোগ করছি’, আহ্লাদিত হয়ে যদি আমি এ রকম কোনো বিবৃতি দিই, তবে ধরে নিতে পারেন আমি ষোলোআনাই মিথ্যে বলছি। এক কথায়, গত তিনটি মাস আমার জন্য বিরক্তির পসরা সাজিয়ে বসে আছে। এটি এক দিক দিয়ে অবশ্য স্বস্তির যে বর্তমান সময় আমার একার জন্য কেবল বিরক্তির না, অন্য সবার ক্ষেত্রেও একই।

আরেক দিক দিয়ে সময়টা আমার জন্য অন্য রকমের সন্তুষ্টিরও বটে। দেশের তরুণ সমাজের একজন প্রতিনিধি হিসেবে সামাজিক কিছু দায়িত্ব পালনের সুযোগ হয়েছে এই মহামারির সময়ে। নিজ এলাকা সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ভাদেশ্বর ইউনিয়নে আমার গ্রামের বাড়ি।

এলাকার সংগঠন বিএসএর সভাপতি হিসেবে সাংগঠনিকভাবে ৪ ধাপে প্রায় ৪০০ পরিবারকে আর্থিক সাহায্য ও খাদ্যপণ্য উপহার দিয়েছি। অবশ্য একটা সময় এসে ফান্ডের অপ্রতুলতা দেখা দেয়। তখন একটি আইডিয়া মাথায় এল। নিজের শিক্ষাজীবনে বেশ কিছু অর্জন রয়েছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান যেটি সেটি ছিল ইংলিশ অলিম্পিয়াড থেকে পাওয়া একটি আকর্ষণীয় ও মূল্যবান মেডেল। সেই মেডেলটি নিলামে তুলে ফান্ড রাইজিং শুরু করলাম। নিলামে সে মেডেলটি বিক্রি হয় ৩৪ হাজার ৫০০ টাকায়। তার সঙ্গে আরও কিছু অর্থ সহায়তা পাই মেডেলটির বদৌলতে। সর্বসাকল্যে পাওয়া সে অর্থ দিয়ে আরও ১১০টি পরিবারকে আমরা সর্বশেষ সহায়তা করতে পেরেছি৷ অবশ্য মেডেলটি যিনি সর্বোচ্চ বিড করেছেন তিনি মেডেলটি আমাকেই আবার উপহার হিসেবে দিয়ে দিয়েছেন, যেটি আমার জন্য আরও সন্তুষ্টি বাড়িয়েছে। এখন পর্যন্ত নিজ এলাকায় সহায়তা ছাড়াও আমরা করোনা থেকে বাঁচতে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করে যাচ্ছি।


এসএসসির পর নিজ গ্রামে (ভাদেশ্বরে) এত লম্বা সময় টানা আর কাটেনি কখনো। এই সুবাদে নতুন কিছু অভিজ্ঞতা জমল নিজ ভান্ডারে। এগুলোর বাইরে কী করলাম? এই গল্পই একটু শোনাব আজ। একজন ‘লারনার’ হিসেবে এই দুঃসময়ে অবশ্য কিছু কাজ নতুন করে শেখার চেষ্টা করেছি। তবে দিব্যি করে বলছি, ‘বিসিএস, এমপি-থ্রি কিংবা জব সলিউশন’ এগুলোতে হাতই দিইনি। যা শিখেছি তা হচ্ছে কেবলই ‘সহনশীলতা’!


‘হোম কোয়ারেন্টিন’ টার্মটার যথার্থ সম্মান দিয়েছি আমি। বেশির ভাগ সময় বাসায় নিজ রুমে থেকেছি এবং এই সময়টায় নিজেকে নিয়ে নতুন কিছু কাজে এক্সপেরিমেন্ট করার চেষ্টা করেছি। বিশেষত গ্রাফিকস ডিজাইন নিয়ে আমার আগ্রহ ছিল অনেক দিন থেকেই। কিন্তু সময়-সুযোগ ব্যাটে-বলে না লাগায় হচ্ছিল না। লকডাউনের অফুরন্ত সময় সে সুযোগ আমায় দিল এবং আমি ছক্কা না হোক অন্তত দৌড়ে দৌড়ে কিছু রান স্কোরবোর্ডে জমিয়েছি, তা বলতে পারি। ইউটিউবের কয়েকটি টিউটোরিয়ালের সাহায্যে কিছু টুকিটাকি (ব্যানার, ফ্লাইয়ার) গ্রাফিকসের কাজ শেখা হয়েছে, যা আমাকে বেশ সন্তুষ্টি দিচ্ছে। শেখার আগ্রহটাও বাড়ছে এ ফিল্ডে।


ক্যামেরার সামনে অভিনেতা হিসেবে আর পেছনে পরিচালনায় অল্পবিস্তর অভিজ্ঞতা থাকলেও একটি বিষয়ে আমার বেশ আগ্রহ ছিল আর তা হচ্ছে সম্পাদনা। হ্যাঁ, ভিডিও এডিটিংয়ের কথা বলছি। এই কাজটা যাঁরা করেন বা করতে পারেন, এঁদেরকে সৃষ্টিকর্তা অন্য লেভেলের ধৈর্য উপহার দিয়েছেন, তা বলা বাহুল্য বৈকি কিছু না। কয়েকটি ডকুমেন্টারি আর শর্টফিল্ম নির্মাণের জন্য পরিচালক হিসেবে এডিটিং জিনিসটার পেইন আগেও নিয়েছি। কিন্তু তা কেবল একজন পরিচালক হিসেবে, সম্পাদক হিসেবে নয়। তো এই সময়টাতে এডিটিং বিষয়টি নিয়ে কিছু এক্সপেরিমেন্ট করলাম। করতে গিয়ে বুঝতে পেরেছি কাজটা কতটুকু চ্যালেঞ্জিং। বেসিক কিছু কাজ আগে থেকে জানা ছিল, তার সঙ্গে নতুন কিছু শিখলাম। এই শেখার জন্যও অন্য রকমের সন্তুষ্টির ঢেকুর তুলছি।


কনটেন্ট রাইটার হিসেবে কিছু পত্রিকায় সরাসরি যুক্ত হয়ে কাজ করেছি। নিজেও একটি ওয়েব ম্যাগাজিন চালিয়েছি। বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকার জন্যও টুকটাক লিখেছি৷ কিন্তু কখনো একটি মনমতো বড় লেখার সময় পাচ্ছিলাম না। বড় লেখা বলতে গল্প, উপন্যাস বোঝাচ্ছি না। ওগুলো আপাতত আমার আসে না। কিন্তু প্রবন্ধনির্ভর কিছু করার আগ্রহ থেকে বেশ কিছু টপিকের ওপর লিখে রেখেছি। কথা দিচ্ছি না বই আকারে কিছু প্রকাশ পাবে। তবে বলতে পারি, প্রকাশনা জগতের ভাই-বন্ধুদের সুদৃষ্টি পেলে আগামী ফেব্রুয়ারিতে কিছু একটা বেরোতে পারে। কনটেন্ট রাইটিং নিয়ে বিস্তর সময় পেয়েছিলাম এবং মাশ আল্লাহ চেষ্টা করেছি কাজে লাগানোর।
বেশ কিছু বই পড়ে ফেললাম এই সময়টাতে। অবশ্য পিডিএফ আকারে পড়তে হয়েছে। বইগুলোর ক্ষেত্রে আমার পছন্দ ছিল সেল্ফ মোটিভেশন, স্কিল ডেভেলপমেন্ট ও আত্মজীবনী রিলেটেড বইগুলো। নিজ থেকে চেষ্টা ছিল খুঁজে খুঁজে কিছু বই বের করার। পেয়েছিও বেশ কয়েকটি। বই পড়ায় মনোযোগ ধরে রাখা অবশ্য আমার জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল, যা আপাতত উতরে গেছি।


প্রচুর সিনেমা দেখেছি৷ গ্রামের নেটওয়ার্কে নতুন সিনেমা দেখার চেষ্টা থাকলেও দেখতে পারিনি কিন্তু সংগ্রহে থাকা অনেকগুলো সিনেমা দেখা হয়েছে। মাঝরাত কিংবা শেষরাত ছিল আমার সিনেমার শিডিউল। সেল্ফ মোটিভেশন দেয়, এমন ছবি দেখেছি বেশ কয়েকটা। এদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো লেগেছে উইল স্মিথ অভিনীত একজন মানুষের স্ট্রাগল আর উত্থানের গল্প নিয়ে নির্মিত ‘The Pursuit of Happyness’ ছবিটি। এ ছাড়া ‘October Sky’, ‘Catch Me If You Can’, ‘Life is Beautiful’ সিনেমাগুলো জীবন নিয়ে নতুন করে ভাবার সুযোগ দিয়েছে।


লকডাউনে আরেকটি বিশেষ সুবিধা হয়েছে। সেটি হচ্ছে যাদের সঙ্গে অনেক দিন যোগাযোগ হচ্ছিল না ব্যস্ততা কিংবা ব্যস্ততার বাহানায়, তাদের সঙ্গে ভার্চ্যুয়ালি সময় করে কথা বলা যাচ্ছে, খোঁজখবর নেওয়া যাচ্ছে। আবার যাদের সঙ্গে বেশির ভাগ সময় সাধারণ জীবনে কাটাই, তাদের বেশ মিস করতে হচ্ছে। একটি জিনিস মেনশন করতেই হয়, তা হচ্ছে, আমি নিজের ইচ্ছা থেকেই বেশ কিছু নতুন মানুষের সঙ্গে ভার্চ্যুয়ালি পরিচিত হয়েছি, তাদের কাছ থেকে শেখার চেষ্টা করেছি এবং অবশ্যই নিজেকে তাদের কাছে উপস্থাপন করেছি।


এত সব কাজ যা-ই করেছি তার সিংহভাগই করতে হয়েছে হয় মোবাইল নয়তো ল্যাপটপ দিয়ে। গত ৪ বছর থেকে চায়নার (আসলে বাংলাদেশি) নিম্ন শ্রেণির একটি মোবাইল ব্যবহার করছি এবং মোবাইলটি ৯০ ভাগ প্রায় ডেমেজ অবস্থায় আগে থেকেই আছে। এর মধ্যে এ কদিনের চাপ সামলিয়ে এটি মোটামুটি অক্কা পেয়েছে বলা চলে। তো এ সময়টায় ভিডিও ধারণ, ছবি তোলা—এ কাজগুলো করার জন্য অন্যের মোবাইলের দ্বারস্থ হয়েছি বেশির ভাগ সময়। এমনকি আমার একটি গুরুত্বপূর্ণ লাইভ সাক্ষাৎকারের জন্য বন্ধুর বাসায় গিয়ে তার মোবাইল ব্যবহার করতে হয়েছিল! মোবাইল ও নেটওয়ার্কজনিত কারণে অনেকগুলো লাইভে আমন্ত্রণ ও আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও তাতে সময় দিতে পারিনি। ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে ধার করা ল্যাপটপটাও অর্ধমৃত। গ্রাফিকস, কনটেন্ট রাইটিং আর এডিটিংয়ের যা কাজ করেছি, তা আবার সব চার্জে লাগিয়ে। বিদ্যুৎ গেল মানেই ল্যাপটপের চার্জ ফুরুত!
লকডাউনে আমার জন্য সবচেয়ে বড় খল নায়কের ভূমিকা পালন করেছে ঝড়বৃষ্টি, বিদ্যুৎ, মোবাইলের নেটওয়ার্ক ও মোবাইল! এরা একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্তও বটে!


লকডাউন শেষে শিগগিরই নতুন পৃথিবীতে দেখা হবে প্রিয়জনদের সঙ্গে। হয়তো হাত মেলাব না, কোলাকুলিও হবে না। তার পরও তিন ফুট দূরে থেকে ‘কেমন আছো’ বলে চিৎকার করব, অভিমান একপাশে রেখে দুঃসহ সময়ের গল্প বলব! অবসান ঘটুক তবু এই সময়ের, দুঃসহ পৃথিবীর। ক্যাম্পাসে, টঙে, পাড়ার দোকানে, শহরতলির পয়েন্টে আবার ফিরবে প্রাণ। তবে এখনই না!


আপাতত ধরে নিচ্ছি এই কাঙ্ক্ষিত জায়গাগুলো আমার/আপনার জন্য ঠান্ডা দিনের আইসক্রিম! সামনে আছে কিন্তু ছোঁয়া যাবে না ঠান্ডা লাগার ভয়ে, অসুখের ভয়ে! কিন্তু হ্যাঁ, ভেতর ভেতর—
“I scream, You scream, we all scream for Ice-Cream!”

*ফ্রিল্যান্স চলচ্চিত্র নির্মাতা ও উদ্যোক্তা। [email protected]