মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জনস্বাস্থ্যগত দিক

১২ জুন, প্রথম আলোর মতামত বিভাগে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী স্যার একটি লেখা লিখেছেন। শিরোনাম ‘মাস্ক-গ্লাভসের বর্জ্য: নদী যেন গন্তব্য না হয়’। লেখাটি চমৎকার লেগেছে। গণমাধ্যমের কল্যাণে পরিবেশে রক্ষায় তার ভূমিকা অনেকেরই জানা। মহামারি বা অতিমারির এই সময়ে তাঁর কাছ থেকে এ লেখা প্রত্যাশিত ছিল। এ জন্য তাঁকে ধন্যবাদ।

মাস্ক-গ্লাভসের মতো বর্জ্যের দুই ধরনের প্রভাব রয়েছে—একটি জনস্বাস্থ্যগত, অন্যটি পরিবেশগত। মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী পরিবেশগত দিকটি নিয়ে আলাপ করেছেন। ফলে প্রাসঙ্গিকভাবেই জনস্বাস্থ্যগত দিকটি আলোচনার দাবি রাখে। সেই দিকটি এ লেখায় আলাপ করতে চাই।

সাধারণ অর্থে বলা যায়, চিকিৎসাপ্রক্রিয়ায় যেসব বর্জ্য তৈরি হয়, তাদের মেডিকেল বর্জ্য বলে। সেই অর্থে সাধারণ মানুষের ব্যবহার করা মাস্ক-গ্লাভস, পিপিই বা একই ধরনের অন্যান্য বর্জ্যকে মেডিকেল বর্জ্য বলা হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে যেহেতু কোভিড-১৯ টেস্টের তুলনায় শনাক্ত রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি, সুতরাং ধরে নেওয়া যায় আমাদের আশপাশে শনাক্ত হয়নি, এমন কোভিড-১৯ পজিটিভ ব্যক্তির সংখ্যা অনেক বেশি। ফলে এসব মাস্ক-গ্লাভস বা একই ধরনের বর্জ্যকে মেডিকেল বর্জ্য ধরে নেওয়াই উচিত হবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই মুহূর্তে বিপুলসংখ্যক মানুষ এসব ব্যবহার করছে, ফলে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য ফেলে দেওয়া হচ্ছে বলেই তা আমাদের নজরে আসছে। কিন্তু চিকিৎসাব্যবস্থায় যেসব বর্জ্য তৈরি হয়, সেগুলোর ব্যবস্থাপনা কী রকম হচ্ছে, তা কি আমরা ভেবে দেখেছি?

ওপরের ছবিটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হসপিটাল ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট সাইকেলের ছবি। এখানে এ কাজের ধাপগুলো দেখানো হয়েছে। লক্ষ করলেই বোঝা যাবে, মূলত বর্জ্যের ট্রিটমেন্ট বা ডিসপোজাল ঠিকভাবে না হলে পরিবেশগত ঝুঁকি বা সংকট তৈরি হয়। মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী তাঁর লেখায় এ দিকটি ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু ট্রিটমেন্ট ও ডিসপোজালের আগের কয়েকটি ধাপ যেমন বর্জ্য শনাক্ত করা (আইডেন্টিফিকেশন), আলাদা করা (সেগরিগেশন) ও পরিবহনের (হ্যান্ডলিং) সঙ্গে জনস্বাস্থ্যগত ঝুঁকি যুক্ত। যদি আমরা এর আগের ধাপগুলোর দিকে তাকাই, তাহলে দুটি ধাপ দেখতে পাই, একটি এ–বিষয়ক প্রশিক্ষণ (ট্রেইনিং) অপরটি তদারকি ও পরীবিক্ষণ (মনিটরিং)। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনাবিষয়ক ট্রেনিং বা তদারকিতে যে নজর দেওয়া হয় না, তা বলাই বাহুল্য। অথচ সঠিক ব্যবস্থাপনা না হলে বর্জ্য থেকে পুনরায় সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা অনেক। এখন পর্যন্ত চিকিৎসকসহ অন্য চিকিৎসাকর্মীদের যে বিপুল অংশ কোভিড-১৯–এ সংক্রমিত হয়েছেন, তাঁদের একটি অংশ হাসপাতালে দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণে সংক্রমিত হয়ে থাকতে পারেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যা এবং জাতিসংঘের পরিবেশ প্রোগ্রাম (ইউএনইপি, ১৯৯৯) মেডিকেল ওয়েস্ট বা হেলথ কেয়ার ওয়েস্টের জন্য একটি গাইডেন্স ম্যানুয়াল তৈরি করেছে। এ ছাড়া হেলথ কেয়ার ফ্যাসিলিটিগুলোর হাইজিন ম্যানেজমেন্টের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি ম্যানুয়েল রয়েছে (ওয়াশফিট, ২০১৭)। দুটি ম্যানুয়েলেই সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে অকুপেশনাল ও পাবলিক হেলথ রিস্ককে। অর্থাৎ হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং এই বর্জ্য বাইরে ফেলার ফলে যাঁরা এর সংস্পর্শে আসবেন, সেসব মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি।

এসব বর্জ্যকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়।
১.
ঝুঁকিহীন বর্জ্য (রিসাইক্লেবল ও বায়োডিগ্রেডেবল বর্জ্য)
২.
বিশেষ বর্জ্য (শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, রক্ত, রাসায়নিক ইত্যাদি)
৩.
সংক্রমণক্ষম বর্জ্য
৪.
তেজস্ক্রিয় বর্জ্য
৫.
অন্যান্য বর্জ্য।

এর মধ্যে ১ ও ৫ নিয়ে দুশ্চিন্তা কম। যেসব জায়গায় ২ ও ৪ নম্বর বর্জ্য তৈরি হয়, সেখানে তার ব্যবস্থাপনাও থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে সবচেয়ে ঝুঁকি ৩ নম্বর বর্জ্যে। এর মধ্যে রোগীর বিছানা, চাদর, মাস্ক, গ্লাভস, পিপিই—সবকিছু পড়ে। করোনাকালে, শুধু হাসপাতাল নয়, বাড়িতেও এসব বর্জ্য বিপুল পরিমাণে তৈরি হচ্ছে। যেহেতু এসব বর্জ্য উৎসে আলাদা (সোর্স সেপারেশন) করা হয় না, ফলে মিশে গিয়ে সব বর্জ্যই জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হয় এবং বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশ মেডিকেল বর্জ্য বিধিমালা-২০০৮–এর আলোকে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের জন্য ২০১১ সালে একটি পরিবেশগত সমীক্ষা ও অ্যাকশন প্ল্যান (২০১১-২০১৬) নেওয়া হয়েছিল। এই অ্যাকশন প্ল্যান অনুযায়ী ২০১৫ সাল নাগাদ দেশে প্রতিদিন ৪০ হাজার টনের মতো মেডিকেল বর্জ্য উৎপাদিত হবে ধরা হয়েছিল। এর মধ্যে সংক্রমণক্ষম বর্জ্যের পরিমাণ ১০ হাজার টনের মতো। বলা বাহুল্য, করোনাকালে এখন উৎপাদিত বর্জ্যের পরিমাণ অনেক বেশি। উন্নত বিশ্বে হাসপাতালের বর্জ্য হয় নিরাপদে ইনসিনারেট (বৈজ্ঞানিক উপায়ে পোড়ানো) হয় অথবা অটোক্লেভ (জীবাণুমুক্ত) করে ফেলে দেওয়া হয় (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ২০১৮)। ওই অ্যাকশন প্ল্যানেই বেশ কিছু পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সেখানে যেমন কেন্দ্রীয়ভাবে মেডিকেল ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্টের জন্য একটি সেন্ট্রাল ফ্যাসিলিটি তৈরির কথা বলা হয়েছিল, তেমনি নিয়মিত এ–সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ, তদারকি, পরীবিক্ষণ ও তথ্য প্রচারের সুপারিশ করা হয়েছিল। এর অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়নি।

ঢাকার মাতুয়াইলে একটি মেডিকেল ওয়েস্ট ইনসিনারেটর রয়েছে। প্রিজম নামে একটি প্রতিষ্ঠান ঢাকার ও এর আশপাশের হাসপাতালগুলো থেকে মেডিকেল বর্জ্য সংগ্রহ করে এখানে ইনসিনারেট করে। বাংলাদেশের বেশির ভাগ জায়গায় কিন্তু এ সুবিধা নেই। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ইনসিনারেশন ব্যবস্থাপনার শেষ ধাপ। এতে মূলত পরিবেশগত ঝুঁকি হ্রাস করা হয়। কিন্তু এর আগের ধাপগুলোই জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ কীভাবে রোগীদের বা চিকিৎসাকর্মীদের বর্জ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে, কীভাবে তা অন্য বর্জ্য থেকে আলাদা করা হচ্ছে, কীভাবে তা সংরক্ষণ করা হচ্ছে সেসব ধাপ। এখন এ অবস্থার উন্নয়নে কী করা যায়, সেটা ভেবে দেখাই কাজ। এ জন্য কিছু পদক্ষেপ অনতিবিলম্বে নেওয়া দরকার। আর কিছু দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিতে হবে মহামারি কাটিয়ে ওঠার পর।

কিছু জায়গায় হাসপাতালগুলো নিজ উদ্যোগে বর্জ্য পুড়িয়ে ফেলছে বা মাটিতে পুঁতে ফেলছে। পুড়িয়ে ফেলা বেশ বিপজ্জনক সমাধান। এ জন্য কিছু নিয়ম মানতে হয়, তা না মানলে যেমন কর্মীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি, তেমনি দুর্ঘটনার ঝুঁকি আছে। সেই তুলনায় মাটিতে পুঁতে ফেলা বা অন্য কন্টেইনমেন্টের (সংরক্ষণ) ব্যবস্থা করা উত্তম। আর সাধারণ ব্যবহারকারীরা যেসব মাস্ক, গ্লাভস বা অন্য কিছু ব্যবহার করছেন, তার জন্য ব্যাপকভিত্তিক প্রচারনার বিকল্প নেই। তাঁরা যেন কোনোভাবেই এসব জিনিস ড্রেনে বা সাধারণ ডাস্টবিনে না ফেলেন। বাসাবাড়িতে তৈরি হওয়া মেডিকেল বর্জ্য অন্তত বেশ কিছু দিন আবদ্ধ পাত্রে রেখে তারপর বাইরে ফেলা উচিত। আর সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা থেকে এই বিশেষ সময়ের জন্য লাল রং করা ক্লোজড বিন স্থাপন করা যেতে পারে, যাতে শুধু এ ধরনের বর্জ্য ফেলা যাবে।

মনে রাখতে হবে, যতক্ষণ না অটোক্লেভ বা ইনসিনারেশনের ব্যবস্থা করা যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সেপারেশন বা কন্টেইনমেন্টই সর্বোত্তম সমাধান। করোনা মহামারি কাটিয়ে ওঠার পর সামগ্রিক মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বড় আকারে নজর দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে শুধু বর্জ্য ডিসপোজালের ফ্যাসিলিটি বা কেন্দ্র তৈরির উদ্যোগ নিলে হবে না। এ জন্য সংশ্লিষ্ট সবার প্রশিক্ষণ, তদারকি, পরীবিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সঙ্গে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণকে পরিচিত করা জরুরি। কী পরিমাণ উপাদান হাসপাতালে প্রবেশ করল, তা থেকে কত বর্জ্য তৈরি হতে পারে, সেই পরিমাণ বর্জ্য আলাদা হয়ে পরিশোধন কেন্দ্রে গেল কি না, তার তথ্য ব্যবস্থাপনা (ইনভেন্টরি ম্যানেজমেন্ট) প্রচলন করাও দীর্ঘ মেয়াদে কার্যকর পদক্ষেপ হবে। আমরা প্রায়ই স্বাস্থ্য খাতের সিস্টেম ডেভেলপমেন্ট বা সামগ্রিক উন্নয়নের কথা বলি। এই ধরনের ব্যবস্থাপনা প্রণয়ন কিন্তু সেই সিস্টেম ডেভেলপমেন্টেরই অংশ।

*পরিবেশ গবেষক, আইআরসি ওয়াশ-এ কর্মরত

আরও পড়ুন: