কয়রায় টেকসই বেড়িবাঁধ আমাদের প্রাণের দাবি

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

খুলনার দক্ষিণে অবস্থিত, সুন্দরবনের কোল–ঘেঁষা কয়রা উপজেলার মানুষ আমরা। দুর্যোগের আঘাত সহ্য করতে করতে আমরা ক্লান্ত। এক দুর্যোগের ক্ষত না শুকাতেই আরেকটা এসে আঘাত হানে। অন্যভাবে বলতে গেলে আমরা অবহেলিত বটে। এককথায় আমাদের বছর ভর সংগ্রাম করতে হয়। বছরের কিছু সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে আর কিছু সময় এই দুর্যোগের রেশ কাটিয়ে উঠতে।

২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলা আঘাত হানে বাংলাদেশের উপকূলে। সামুদ্রিক এই জলোচ্ছ্বাসে লন্ডভন্ড হয়ে যায় উপকূলের অবহেলিত উপজেলা কয়রা। সিডর-আইলার আর্থসামাজিক ক্ষতি আজও কাটিয়ে উঠতে পারেনি এই জনপদ। এরই মাঝে আঘাত হেনেছে সুপার সাইক্লোন আম্ফান। আম্ফানের আঘাতে কয়রার ৪টি ইউনিয়নের ৫২টি গ্রাম সম্পূর্ণ এবং দুটি ইউনিয়নের ২৪টি গ্রাম আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

জেলা প্রশাসনের কার্যালয় সূত্রমতে, কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি, উত্তর বেদকাশি, সদর ও মহারাজপুর ইউনিয়নের ১ লাখ ৪৮ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। এর মধ্যে ২৩ হাজার ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত এবং ১৪ হাজার ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সর্বমোট ৩৭ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেড়িবাঁধ ভেঙেছে অন্তত ২৪ জায়গায়। প্রায় ৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল লোনা পানিতে প্লাবিত হয়েছে। ছোট–বড় ৫ হাজার মাছের ঘের ভেসে গেছে জোয়ারের পানিতে।

এভাবে একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপকূলে বাধাহীনভাবে আঘাত হানতে থাকলে একসময় উপকূলের এই জনপদ ধীরে ধীরে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। বর্তমান যেই জীর্ণশীর্ণ বাঁধগুলো আছে, তা ৬০ বছরের আগের। মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে ২০ বছর আগেই। অথচ বিগত এক যুগেও এই অঞ্চলের মানুষের প্রাণের দাবি; টেকসই বেড়িবাঁধের কোনো বাস্তবায়ন তারা দেখেনি। আশার বাণী শুনেছে বহুবার। বিগত এক যুগে দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেলসহ বহু মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়িত হচ্ছে কিন্তু উপকূলের লাখ লাখ মানুষের মৌলিক অধিকার–সংশ্লিষ্ট এই দাবির কোনো সুরাহা হয়নি। কোনো ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানলেই কাদামাটি আর পলিথিন দিয়ে কোনো রকমে বাঁধ দেওয়া হয়। ভঙ্গুর বাঁধ ভেঙে যায় সাধারণ জোয়ারের তোড়েই। তাই টেকসই বেড়িবাঁধের বিকল্প নেই।


এর আগে অনেকবারই বরাদ্দ হয়েছে এবং বেড়িবাঁধ সংস্কার করা হয়েছে, যা টেকসই হয়নি কখনো। তাই টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে আমাদের একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা দরকার। কারণ, এই পরিকল্পনা আমাদের বেড়িবাঁধের সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো সুবিধা দিতে পারে; অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে। একটি সুন্দর পরিকল্পনাই এই বৃহৎ প্রকল্পকে বিনিয়োগে রূপান্তর করতে পারে। বিশ্ববিখ্যাত ম্যানগ্রোভ বনের কোল ঘেঁষে এই উপজেলার অবস্থান। তাই সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে এক-ট্যুরিজমের এক অপার সম্ভাবনা রয়েছে এখানে। ইতিমধ্যেই কয়ার গোলখালি, কাঠকাটা, কেওড়াকাটাসহ বিভিন্ন স্থান স্থানীয় পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সে জন্য বেড়িবাঁধের রাস্তাগুলো ৪৫ থেকে ৫০ ফুট পর্যন্ত প্রশস্ত করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে এটি আংটি হারার সঙ্গে ভারতের নৌ-যোগাযোগ সম্প্রসারণে বড় ভূমিকা রাখবে।

এই রাস্তা দিয়ে পর্যটকেরা বিশ্ববিখ্যাত ম্যানগ্রোভ বনের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য নদীগুলোর ড্রেসিং করা জরুরি। কারণ, নদী ড্রেসিং করা ছাড়া বাঁধ টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তাই রাস্তা ভরাট করতেও কোনো সমস্যা হবে না। নদীর বালিতেও ভরাট করা যাবে রাস্তা। রাস্তার ধার দিয়ে বনায়ন সৃষ্টি করতে হবে, যা পর্যটকদের যেমন আকর্ষণ করবে তেমনি বেড়িবাঁধের স্থায়িত্বও বাড়াবে। আবার সেখান থেকে পাওয়া যাবে বিভিন্ন অর্থনৈতিক সুবিধা। বাঁধে রোপণ করা যেতে পারে গোলপাতা, গড়ান, গেউয়া, কেউড়া, নারকেল, তালগাছসহ বিভিন্ন ধরনের গাছ। এখান থেকে পাওয়া যেতে পারে গড়ান, গেউয়াসহ বিভিন্ন ধরনের মধু, যা শোধনের মাধ্যমে ভালো মূল্যে বিক্রি করা যাবে। অর্থনৈতিকভাবে দেশ এবং এই অঞ্চল এগিয়ে যাবে। প্রতিবছর এখানে নষ্ট হয় হাজার হাজার টন কেওড়া, যা সংরক্ষণ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণে মাধ্যমে কেওড়ার জল তৈরি করা যেতা পারে। এই বিস্তৃত ১২১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধজুড়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে হাজার হাজার বেকার মানুষের। কয়রার মানুষের বড় একটা অংশ মাছ চাষ করে জীবিকা আহরণ করে, তাই নদী ড্রেসিং করা হলে স্বভাবতই নদী পথের যাতায়তব্যবস্থার সুবিধা বাড়বে, বাড়বে বাণিজ্যিক তৎপরতা। উন্মোচিত হবে ব্লু ইকোনোমি। আমরা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করতে সক্ষম হব। তবে এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা অতীব জরুরি। পূর্বে বেড়িবাঁধের বাজেট নিয়ে বহু দুর্নীতি হয়েছে। বাজেট হয়েছে অথচ বেড়িবাঁধ নির্মাণ হয়নি। এর ফল ভোগ করতে হয়েছে উপকূলের জনসাধারণের। তাই বেড়িবাঁধ প্রকল্পের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা বেশি জরুরি।

*শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কয়রা, খুলনা। [email protected]