টাঙ্গনে মা মাছ নিধনের 'উৎসব'

ডিমওয়ালা মাছ ধরা হচ্ছে টাঙ্গন নদে। ছবি: লেখক
ডিমওয়ালা মাছ ধরা হচ্ছে টাঙ্গন নদে। ছবি: লেখক

আমরা মাছে ভাতে বাঙালি। বহুল প্রচলিত এ প্রবাদটি বাঙালির ঐতিহ্য ও জীবন পরিচালনায় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমাদের প্রধান খাবার ভাত ও মাছ, যা অস্বীকার অন্তত কোনো বাঙালিই করতে পারবে না। তবে অতীত ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান রেখে কেউ ‘মাছে ভাতে বাঙালি’র সত্যতা স্বীকার করলেও বাস্তবতার নিরিখে তা অস্বীকার করার সময় সম্মুখে দাঁড়িয়ে। কারণ, দেশীয় প্রজাতি অর্থাৎ আমাদের অতিপরিচিত মাছগুলো যেভাবে বিলুপ্ত হচ্ছে, তাতে আগামী দিনের বাঙালি খাবারের তালিকায় যুক্ত হবে নতুন কিছু। ভাতের সঙ্গে মাছ শব্দটি উধাও হতে আর বেশি দিন বাকি নেই। বর্ষার পানি জমা হতে না হতেই টাঙ্গন ব্যারাজের নদ-নালায় চলছে মা মাছ নিধনের উৎসব।

একশ্রেণির জেলে টাঙ্গন নদ ও ব্যারাজের বিভিন্ন পয়েন্টে কারেন্ট, ফিকা জালসহ বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মা মাছ ধরছেন। সেগুলো স্থানীয় হাটবাজারে প্রকাশ্যে বিক্রি করলেও মৎস্য বিভাগকে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না। অথচ এই সময়টা মাছের প্রজননকাল। কঠোর নজরদারি না থাকায় স্থানীয় জেলেরা অবাধে মাছ ধরছেন। আর এখন ধরা পড়ছে সব ধরনের পোনা ও ডিমওয়ালা মাছ।

মৎস্য আইনে ১ এপ্রিল থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত পোনা মাছ ও ডিমওয়ালা মাছ নিধন করা যাবে না। যদি কেউ এ আইন অমান্য করে মাছ নিধন করে, তাহলে অর্থদণ্ড ও জেল–জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ড হতে পারে। কিন্তু এর কার্যকর কোনো পদক্ষেপ বাস্তবে দেখা যায়নি।

গত শুক্রবার ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার উত্তর বঠিনা, রুহিয়া টাঙ্গন ব্যারাজ ঘুরে দেখা যায়, উপজেলার পাটিয়াডাঙ্গী সেতু, বরদেশ্বরী সেতু, শুক নদসহ ব্যারাজের বিভিন্ন পয়েন্টে জেলেরা বাদাই, কারেন্ট, ফিকা, ছাপি জালসহ বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে ডিমওয়ালা কই, মাগুর, শিং, পাবদা, টেংরা, পুঁটি, ডারকা, মলা, ঢেলা, শৌল, বোয়াল, আইড়, ভ্যাদা, বাইম, খলিশা, ফলি, চিংড়ি, টাকি, চিতল, বালিয়া, কাঁকিলা, চাপিলা, বইচা, চাটুয়া, নাপতানি, গুলশা, দেশি পুঁটি, সরপুঁটি, বাচা, বাটা, টেংরা, কাজলি, চ্যাং, ছোট চিংড়ি, বাতাসি, টাটকিনি, বইরালিসহ নাম না-জানা বহু প্রজাতির মাছ প্রকাশ্যে ধরছেন। যদিও দেশীয় প্রজাতির এই মাছগুলো বিলুপ্তির পথে। সরকারিভাবে মা মাছনিধন নিষেধ থাকলেও প্রশাসনের নাকের ডগায় প্রতিদিন ডিমওয়ালা ওই মাছগুলো আশপাশের স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা বাজারে প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে। মাছগুলো স্থানীয় লোকজন বেশি দাম হাঁকিয়ে কিনে নিচ্ছেন।

উপজেলার বিভিন্ন বাজারে ডিমওয়ালা মাছ ও পোনা মাছ প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি টেংরা ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা, পুঁটি ৪০০ টাকা, মোয়া মাছ ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, ডিমওয়ালা বোয়াল ৬০০ টাকা কেজি, শোল বা টাকি মাছের পোনাও ২০০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। দেশীয় মৎস্যসম্পদ রক্ষায় এটা বন্ধ হওয়া জরুরি। যদি প্রতিবছর আইন মেনে ব্যারাজে মাছ ধরা হয়, তবে মিঠা পানির মাছের কোনো অভাব পড়বে না আর না হলে মৎস্যরাজ্যে মৎস্যবংশ চিরতরে শেষ হয়ে যাবে।

বর্ষার পানি জমা হতে না হতেই টাঙ্গন ব্যারাজে চলছে মা মাছ নিধনের ‘উৎসব’। ছবি: লেখক
বর্ষার পানি জমা হতে না হতেই টাঙ্গন ব্যারাজে চলছে মা মাছ নিধনের ‘উৎসব’। ছবি: লেখক

ব্যারাজ এলাকার বাসিন্দা এনায়েত হোসেনসহ অনেকেই জানান, একটা সময় ছিল জেলে ও কৃষকেরা শখের বসে স্বল্প আকারে পোনা মাছ ধরতেন। আর এখন পোনা ও ডিমওয়ালা সব ধরনের মাছ নিধনের মহোৎসব চলছে। তাই এ সময় প্রশাসনের পক্ষ কঠোর নজরদারি ও পোনা–ডিমওয়ালা মাছনিধনে মৎস্য আইন প্রয়োগ করলে মাছের বংশ বৃদ্ধি করা সহজ হতো। আর ব্যরাজের পানিতে স্রোত তৈরি হচ্ছে, সে স্রোতের পানিতেই রুই, ঘনিয়াসহ বিভিন্ন জাতের দেশি মাছ ডিম ছাড়বে। পানির স্রোত না থাকলে মাছ ডিম ছাড়তে পারে না। তাই টাঙ্গন ব্যারাজের স্রোতকে পুঁজি করেই চলছে মা মাছনিধন।

ঠাকুরগাঁও জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আফতাব হোসেন বলেন, টাঙ্গন ব্যারাজে বিভিন্ন পয়েন্টে মা মাছ নিধনের বিষয়টি তিনি শুনেছেন। এ ব্যাপারে ইতিমধ্যে অভিযান শুরু করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে জনবল–সংকটের কারণে পুরো এলাকায় একসঙ্গে অভিযান চালানো সম্ভব হচ্ছে না।