নীলক্ষেতের বইয়ের রাজ্যে চাপা নীরবতা

ক্রেতা প্রায়ই নেই বললেই চলে, অলস বসে আছেন নীলক্ষেতের বই বিক্রেতারা। ছবি: লেখক
ক্রেতা প্রায়ই নেই বললেই চলে, অলস বসে আছেন নীলক্ষেতের বই বিক্রেতারা। ছবি: লেখক

‘এই যে মামা এই দিকে, কী বই লাগবে? মেডিকেলের বই?’ আকুলতা ভরা প্রশ্নটা করেই দুই তরুণের দিকে তাকিয়ে মোহাম্মদ পারভেজ বুঝতে পারলেন ওরা তাঁর কাছ থেকে বই কিনবে না। দুই বন্ধু নিজেদের মতো দাঁড়িয়ে আলোচনা করতে থাকেন। হতাশ চোখে তাদের আলোচনা দেখে আষাঢ়ের মন খারাপ করা এই মধ্যাহ্নের সূর্যের মতোই ম্লান হয়ে যায় পারভেজের মুখ।

বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারিতে বিত্তশালী কিংবা মধ্যবিত্তই যখন দুর্বিপাকে তখন নিম্ন আয়ের সাধারণ বই ব্যবসায়ীদের কী যে করুণ দশার সৃষ্টি হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। ২০ জুন নীলক্ষেত এলাকা ঘুরে দেখা গেল অস্বাভাবিক এক চিত্র। ঠিক মধ্যাহ্নের যে সময়টিতে সবচেয়ে কর্মব্যস্ত সময় কাটান বই বিক্রেতারা, সেখানে গলিতে যেন নিস্তব্ধতা। অধিকাংশ দোকানের শাটার নামানো। আর যাঁরা দোকান খুলে বসে আছেন তাঁদের মুখে যেন শব্দ নেই।

কথা বলি অনন্ত বুক হাউসের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ পারভেজের সঙ্গে। জানালেন, প্রায় ২০ বছর বইয়ের ব্যবসা তাঁর। তাঁর মতে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের আগে আর পরের বিক্রির তফাতটা প্রায় ৯০ শতাংশ। তাঁকে এত পার্থক্যের কারণের কথা জিজ্ঞাসা করতেই তিনি খুব গুছিয়ে বললেন, ‘আমার কাছে মনে হয় সমস্যা আসলে তিনটা। কম সময়—মাত্র ৪টা পর্যন্ত দোকানদারি করতে পারি। মার্কেটের প্রশাসনিক সমস্যা তো আছেই আর সবচেয়ে বড় সমস্যা তো এই ভাইরাস!’

চলছেন কীভাবে জিজ্ঞেস করতে মুখ আরও ম্লান হয়ে যায় মোহাম্মদ পারভেজের। তিনি দুঃখভরা কণ্ঠে জানান, ‘আসলে আমরা যারা নিম্ন আয়ের মানুষ তারা কিন্তু কারও কাছে সাহায্য চাইতে পারি না। চলতে পারি না, চলি আল্লাহ‌ চালাইতেসে তাই! তিন বেলার জায়গায় হয়তো দুই বেলা খাচ্ছি, খুবই শোচনীয় অবস্থায় আছি।’

করোনাভাইরাসের এই ভয়াবহতার ভেতরেও দোকানে আসছেন ভয় করে না? প্রশ্ন করলে পারভেজ বলেন, ‘ভয় করলে চলবে? পেট তো চালাইতে হবে!’

করোনার আগে নীলক্ষেতে বইয়ের দোকানের মাঝখানের গলিগুলোতে দাঁড়ানোর উপায় ছিল না। আর এখন...। ছবি: লেখক
করোনার আগে নীলক্ষেতে বইয়ের দোকানের মাঝখানের গলিগুলোতে দাঁড়ানোর উপায় ছিল না। আর এখন...। ছবি: লেখক

পারভেজের দোকানের সামনের একজন ফল ব্যবসায়ী খুব আগ্রহ নিয়ে আমাদের আলাপ শুনছিলেন। শেষ কথায় তিনিও খুব জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলে উঠলেন, ‘ঠিক! পেট তো চালাইতে হবে আপা!’ তার দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখলাম ছোট্ট জায়গায় স্ট্রবেরির কিছু প্যাকেট দিয়ে ফলের পসরা সাজিয়েছেন মোহাম্মদ হৃদয় হোসেন। দিনাজপুরের এই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জানালেন আগে যেখানে প্রায় চার হাজার টাকার ফল বিক্রি করতেন সেখানে মাত্র এক থেকে দেড় হাজার টাকার ব্যবসা হচ্ছে তাঁর। তিনি বলেন, আগে সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বিক্রি করলেও এখন যেহেতু সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত করতে পারেন, সে কারণেই বিক্রি কমে গেছে। ‘খুব করুণ অবস্থায় আছি, আপা। মনে করেন আমার পরিবারে প্রায় ৬-৭ জন সদস্য। তিন বেলার জায়গায় দুই বেলা খেয়ে দিন কাটাচ্ছি, বাড়িওয়ালা নোটিশ দিছে। দেয়ালে তো পিঠ ঠেকেই গেছে, এ রকম চলতে থাকলে পথে বসতে হবে!’ দুশ্চিন্তা আর আতঙ্কে যেন তেতো হয়ে ওঠে মিষ্টি ফল স্ট্রবেরি এই বিক্রেতার মুখ।

নীলক্ষেতের অলিগলিতে ঘুরে দেখা যাচ্ছিল একই চিত্র। হতাশ দোকানিরা শব্দহীন বসে আছেন পিনপতন স্তব্ধতায়। এ রকম কিছু নিস্তব্ধ গলি পেরোতেই মোটামুটি মাঝের ফাঁকা একটা জায়গায় অনেক দোকানিকে একে অপরের সঙ্গে গল্প করতে দেখে এগিয়ে গেলাম। সবাই সমান আগ্রহে ডাকেন, ‘আপা, এদিক আসেন কী বই কী বই?’ কাছে যেতেই তাঁরা কীভাবে যেন বুঝে গেলেন তাঁদের কথা শুনতে এসেছি, তখন খুব আগ্রহ নিয়ে সবাই সেলিম নামের মানুষটিকে অনুরোধ করেন, ‘সেলিম ভাই, আপনি বলেন।’

সেলিম ভাই কথা পাশ কাটিয়ে যান। তাঁরই দোকানের মঞ্জুরুল ইসলামকে কথা বলতে অনুরোধ করলে তিনি বলেন, ‘আসলে আপনি যে জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বলছেন স্বাভাবিক দিনে সেখানে দাঁড়ানোর সুযোগ পেতেন না, কথা বলা দূরে থাকুক! আগে যেখানে ১০ হাজার টাকার ব্যবসা করেছি এখন সেখানে ৩০০-৫০০ টাকার বিক্রি! ভাবা যায়!’ মঞ্জুরুল ইসলাম জানান করোনা পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আগেই পরিবারকে দেশের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন তিনি। ‘আর যা–ই করি মাকে ঢাকায় রাখলাম না, আনবও না!’ নিজে কেন আছেন এমন প্রশ্নে বলেন, ‘পেটের দায়ে আছি, মনে করেন দোকানভাড়া ৩২-৩৪ হাজার টাকা, গত দুই তিন মাসের ভাড়া বাকি পড়েছে। মার্কেট কমিটি কী করবে, কী সিদ্ধান্ত নেবে কিছুই জানি না।’

মার্কেট কমিটির সিদ্ধান্তের আশায় বসে থাকা আরেক ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মহসিন শেখ। চার সদস্যের পরিবারের একমাত্র রোজগারের পথ তাঁর এই বইয়ের দোকান চালাচ্ছেন ১৯ বছর ধরে। দীর্ঘ এই সময়ে প্রতিদিন যেখানে পাঁচ হাজার থেকে আট হাজার টাকার ব্যবসা করেছেন সেখানে করোনা মহামারির লকডাউন উন্মুক্ত করার পর তাঁর ব্যবসা নেমে এসেছে মাত্র এক থেকে দেড় হাজার টাকায়। চলেও যেতে পারছেন না পরিবারের কাছে। কারণ, দোকানভাড়া মওকুফ নিয়ে তিনি আছেন সংশয়ে। জানালেন, এই অনিশ্চয়তার দোলাচলে দিন আর কাটছে না তাঁর। ‘আশপাশের মার্কেটের দুই–তিন মাসের দোকানভাড়া তো মওকুফ করেছে মালিক সমিতি! শুধু আমাদের মার্কেটের সিদ্ধান্ত এখনো জানতে পারলাম না!’

দোকানভাড়া আর বাসাভাড়া নিয়ে নীলক্ষেতের অনেক দোকানির মতো দুশ্চিন্তায় আছেন ইসলামিয়া স্টোরের মোহাম্মদ সবুজও। তা–ও প্রতিদিন দোকানে এসে বসেন। তিনি জানালেন, করোনা ছড়ানোর এই তিন মাসের লকডাউন ঘোষণার প্রথম ১৫ দিন ভালোই ব্যবসা করছিলেন তাঁরা। সমস্যা শুরু হয়েছে আড়াই মাস পরে লকডাউন খোলার পর। সবুজ বলেন, ‘আগে ১০ হাজার টাকার বিক্রি হতো আর এখন বিক্রি কমে গেছে প্রায় ৭০ ভাগ। ৫ জনের পরিবারের দেখা শোনা করি। বিক্রি হয় না তা–ও আসি। দোকানভাড়া, বাসাভাড়া না হলে কীভাবে দেব? প্রতিদিনের খরচ জোগাতে এসে বসে থাকি। মনে করেন চালানকারীদের কথার মাধ্যমে বুঝায় যাচ্ছি। এভাবে কত দিন চলব জানি না!’ সামনের দিনগুলোর অনিশ্চয়তা চুপ করিয়ে দেয় সবুজকে।

ফাঁকা গলিতে শব্দহীনতা বড় অদ্ভুত। যেন কিছু বলতে চায় কিন্তু করোনার চোখরাঙানিতে দাঁতে দাঁত চেপে আছে। আরও একটু ভেতরে গিয়ে নীলক্ষেতের যত বইয়ের দোকানিকে জিজ্ঞাসা করলাম সাবাই জানালেন মহামারিতে তাঁদের জীবনে যত নিস্তব্ধতাই নেমে আসুক না কেন অন্য কোনো ব্যবসায় চলে যাওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারেন না তাঁরা। একে তো সব সময় এ ব্যবসা করেই জীবন চালিয়ে এসেছেন এখন অন্য কোনো ব্যবসায় যাওয়া তাঁদের জন্য সম্ভব না। সবার একটাই কথা—ব্যবসা শিখেছেন বই বিক্রির; রিকশা চালানো কিংবা মাঠের কাজ তো শেখা হয়নি। তাই এই পরিস্থিতির পর পুরোনো ব্যবসাই তো পড়ে থাকবে, নতুন ব্যবসা শুরু করতে যাওয়া তো একেবারে অসম্ভব!

নীলক্ষেতের ফুটপাতে আগে উপচে পড়ত বইয়ের পসরায়, সেখানে একা একা মাহমুদ। ছবি: লেখক
নীলক্ষেতের ফুটপাতে আগে উপচে পড়ত বইয়ের পসরায়, সেখানে একা একা মাহমুদ। ছবি: লেখক

নীলক্ষেতের ফুটপাতে আগে যেখানে উপচে পড়ত বইয়ের পসরায় সেখানে একা একা বসে ছিলেন মাহমুদ। চোখে রাজ্যের হতাশা নিয়ে ফাঁকা ফুটপাতের দিকে স্তব্ধ মুখে তাকিয়ে ছিলেন তিনি। এই করোনার ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ফুটপাতের মতো বিপজ্জনক জায়গায় ব্যবসা করতে বাধ্য ২০০৪ সাল থেকে এই ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া মাহমুদ। ছোট ছেলে–মেয়েদের রঙিন বইয়ের বিক্রেতার চোখ দুটো রং ছাড়া আর কণ্ঠ নিস্তব্ধ, ‘খুব কষ্ট হচ্ছে, ঋণী হয়ে গিয়েছি বলেই এই ৪-৫ দিন হলো আসলাম। সরকার লকডাউন তুলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, চারদিকে ব্যবসা করার জন্য একটু শিথিল হয়েছে দেখে এসেছি। আগে তো পুলিশ এসে সব বই উঠিয়ে দিত, বসতে দিত না। আমিও চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু পরিবারে তিন ছেলেমেয়ের দুই মেয়ে, এক ছেলে সবাই পড়াশোনা করে। এই ছোট ব্যবসা ছাড়া কিছু বুঝি না যে অন্য কিছু করে খাব। আগে যেখানে চার থেকে সাত হাজার টাকার ব্যবসা করেছি সেখানে দু–চার শ টাকার ব্যবসায় কী হবে? আশা নিয়ে আছি পরিস্থিতির হয়তো পরিবর্তন হবে!’ নিজেকেই যেন সান্ত্বনা দেন মাহমুদ।

মাহমুদ যেমন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আশায় বুক বেঁধেছেন ঠিক ততটাই নিরাশ নাবিল বুক শপের নাবিল ইসলাম সুমন। তিনি বলেন, ৯ জনের পরিবারের ৭ ভাইবোনের দুই ভাই মিলে ঢাকা থাকতেন, ছোট ভাই ছিলেন এবারের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। করোনার ভয়াবহতার শুরুতেই আদরের ছোট ভাইকে দেশে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে রয়ে গেলেও প্রতিমুহূর্তেই আছেন আতঙ্কে। ‘২০১২ সালের নভেম্বরে প্রথম এই ব্যবসায় আসছিলাম। এখন পর্যন্ত এমন পরিস্থিতির শিকার হইনি কখনো। নীলক্ষেতের বড় দোকানগুলির প্রতি দোকানে দৈনিক বিক্রি ছিল প্রায় ৩০-৪০ হাজার টাকার। আর এখন এমন অবস্থা, কোনো কোনো দোকানে সারা দিন বিক্রিই হচ্ছে না!’

এত খারাপ পরিস্থিতিতে আসছেন ভয় করে না? দুঃখের হাসি হেসে সুমন বলেন, ‘করে না মানে, করোনার ভয়েই তো এই যে মাস্ক, সানগ্লাস এসব পরে বসে আছি। মনে করেন আল্লাহ্‌ না করুক আমার তো করোনা হতেই পারে! নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে বেশ ভয় লাগে। পরিবারের কথা ভেবে আরও বেশি ভয় লাগে। কারণ, পরিবারে একমাত্র রোজগার আমিই করি। আর আমিও আসলে দোকান বন্ধ করে দেশে চলে যাব, অবস্থা খুব খারাপ। জীবনের জন্য টাকা, টাকার জন্য জীবন না!’ এটা যে তাঁর নিজের চিন্তা সেটা জানিয়ে আবার গিয়ে চুপচাপ বসেন জীবনের কঠিন বাস্তবতার শিকার এই বই ব্যবসায়ী। নাবিল যেমন টাকার জন্য জীবন না বলে থেমে গেলেন ঠিক সেভাবেই থেমে গেছে নীলক্ষেতের সমস্ত কোলাহল। বইয়ের রাজ্যে চলছে শব্দহীন নীরবতা!

* শিক্ষার্থী: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়