জ্ঞানতাপস অধ্যাপক মুনিম খান স্মরণে

মুনিম খান
মুনিম খান

ইতিহাসে কিংবদন্তি তাঁরাই হয়ে থাকেন, যাঁরা নিজ মেধা, মননশীলতা, অসাধারণ প্রতিভা ও কর্মগুণে নিজের ব্যাপ্তি ছড়িয়ে যান দেশ, জাতি তথা মানবতার কল্যাণে। দেশ-বিদেশে সমানভাবে আলোচিত ও খ্যাতিমান যেসব মহান ব্যক্তিত্ব নিরলস জ্ঞানসাধনায় মানবজাতির কল্যাণে অশেষ অবদান রেখে যান, নিজেদের কর্মগুণেই শ্রদ্ধাভরে তাঁরা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকেন। বহুমাত্রিক প্রতিভাধর অধ্যাপক, লেখক, প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক, বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, নজরুল গবেষক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খানের আজ প্রথম প্রয়াণ দিবস, মাত্র ৪৭ বছর বয়সে তিনি হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে ২০১৯ সালের ২৯ জুন মৃত্যুবরণ করেন।

অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান আজীবন তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন পার করে গেছেন আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরিমণ্ডলে খ্যাতিসম্পন্ন বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ হিসেবে। শিক্ষাঙ্গনে প্রাজ্ঞ ও বিচক্ষণ অধ্যাপক হিসেবে, সমাজে জ্ঞানতাপস, ধর্মীয় মনস্তাত্ত্বিক ও সংস্কারক হিসেবে, সাহিত্যে পণ্ডিত, গবেষক, লেখক, ভাষ্যকার, আলোচক, অনুবাদক ও সঞ্চালক হিসেবে এবং পরিবারে আত্মপ্রত্যয়ী, সৎচরিত্রবান, দায়িত্বশীল, উদার, স্বাধীনতায় বিশ্বাসী বন্ধুসুলভ, জীবনবোধ ও রসবোধসম্পন্ন বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী একজন সার্থক সন্তান, আদর্শ ভাই, স্বামী ও স্নেহশীল পিতা হিসেবে জীবন পার করেছেন। আত্মীয় বা অনাত্মীয়, দুস্থ-দরিদ্র কেউই বঞ্চিত হননি তাঁর স্নেহাস্পর্শ থেকে। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ও সদা পরোপকারী অধ্যাপক ড. মুনিম খানের অসামান্য অবদান প্রতিটি ক্ষেত্রে যেভাবে সমুজ্জ্বল, দেশ ও জাতি সেটা কখনো ভুলবে না।

জাতির ক্রান্তিলগ্নে যেকোনো বিষয়ভিত্তিক সমস্যায় ধর্ম ও ইসলাম সম্পর্কিত, মানবাধিকার, শিল্প ও সংস্কৃতি বা আন্তর্জাতিক যেকোনো ইস্যুতে তাঁর জ্ঞানগর্ভ আলোচনা, সাক্ষাৎকার বা গবেষণামূলক মূল্যবান প্রবন্ধ-নিবন্ধ বিভিন্ন গণমাধ্যমে টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেলগুলোতে প্রচার ও জাতীয় পর্যায়ের দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশের মাধ্যমে জাতীয় ও সামাজিক সমস্যা সমাধানের নিরলস প্রচেষ্টা আজীবন অব্যাহত রেখে গেছেন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান। বহুমুখী প্রতিভাধর এই শিক্ষক এশিয়ান ইনস্টিটিউটের পরিচালক ছিলেন। ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা ও ইনস্টিটিউট অব ল্যাঙ্গুয়েজের চেয়ারম্যান ও তারা টিভি নিউজের অ্যাডভাইজার ছিলেন। এ ছাড়া সেনাবাহিনীর অফিসারদের খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ড. মুনিম খান ২০০৩ সাল থেকে নিয়মিতভাবে বাংলাদেশের বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোয় ধর্মবিষয়ক কলাম লেখক ছিলেন। মানবতার ব্যাখ্যা, ভালোবাসায় ইসলাম, জীবনবোধে ধর্মের প্রভাব, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ ইসলামবিরোধী, ধর্মের নামে যেকোনো অপব্যবহার ও অপব্যাখ্যার বিরুদ্ধে পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে তাঁর লেখার অবস্থান ছিল স্বচ্ছ ও সুচিন্তিত। প্রথম আলো থেকে প্রকাশিত হজ গাইড তিনি লিখেছেন। এ ছাড়া ইত্তেফাক, সংবাদ, যুগান্তর, সংগ্রাম, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, ক্রীড়ালোক, ক্রীড়াজগৎসহ বিভিন্ন পত্রিকার নিয়মিত লেখক ছিলেন।

অধ্যাপক ড. মুনিম খান রচিত ও সম্পাদিত বইয়ের সংখ্যা ২৪টি, যার অধিকাংশই স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক। আরবি ভাষা, সাহিত্য, কাব্য, ভাষাতত্ত্ব, ইসলামের ইতিহাস, ধর্মবিষয়ক বহু প্রবন্ধ-নিবন্ধ (৮৩টি) বিভিন্ন গবেষণামূলক জার্নালে প্রকাশিত হয়। ইনডিপেনডেন্ট ইন্টার ফেইথ জার্নালে প্রকাশিত তাঁর গবেষণামূলক ইংরেজি প্রবন্ধের সংখ্যা ৫০। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত অগ্রপথিক সংকলনে তাঁর প্রবন্ধের সংখ্যা ৮৩। তিনি একাত্তর, বাংলাভিশন, যমুনা, এটিএন বাংলা, চ্যানেল আই, ইনডিপেনডেন্ট, নাগরিক টিভি, মাই টিভি, বিটিভিসহ বিভিন্ন চ্যানেলে নিয়মিত সমসাময়িক বিষয়ে টক শো অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ও আলোচক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন।

ড. মুনিম খান আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব, বরেণ্য শিক্ষাবিদ, বহু ভাষাবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আ ন ম আবদুল মান্নান খান ও মা রেহানা আক্তারের প্রথম পুত্র। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা থানার সৈয়দাবাদ গ্রামের ড. মুনিমের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে শিক্ষা অর্জনকালে সব ক্লাসে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়ে বিনা বেতন অধ্যয়নের সুযোগ লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদে বিএ অনার্স পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বরপ্রাপ্তির জন্য ‘নীলকান্ত স্বর্ণপদক-১৯৯১’ লাভ করেন, যা তাঁর বাবা ও ড. মান্নান খান ছাত্রজীবনে সর্বোচ্চ নম্বরপ্রাপ্তির জন্য একই সন্মানে ভূষিত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আরবি বিভাগ থেকে বিএ অনার্স ও মাস্টার্স (থিসিস গ্রুপ) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান লাভের জন্য ড. মুনিম ‘গ্রন্থ পদক পুরস্কার-১৯৯১ ও ১৯৯২’, ‘সাইদুর রহমান ফাউন্ডেশন পুরস্কার’, ‘নাসিরুন্নেসা ফাউন্ডেশন পুরস্কার’ এবং ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এমফিল ও পিএইচডি বৃত্তি পুরস্কার’ লাভের কৃতিত্ব অর্জন করেন। তিনি কলা অনুষদের অধীন ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ থেকে ২০০২ সালে পিএইচডি অর্জন করেন।
অধ্যাপক মুনিম খানের রচিত দুটি গবেষণা অভিসন্দর্ভের বিষয় শিরোনাম হচ্ছে—১. ‘আহমদ শাওকীর কবিতায় ইসলামি ভাবধারা’ মাস্টার্স থিসিস ২. ‘আহমাদ শাওকী ও নজরুল ইসলামের কবিতায় ইসলামি চিন্তাধারা’।

ড. মুনিম খান বিভিন্ন পর্যায়ে ১৬টি বিরল সম্মাননা পদক ও পুরস্কার লাভ করেন। তিনি মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে ২০০৫ সালে ওয়াশিংটন ডিসি, শিকাগো ও নিউইয়র্ক সিটিতে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ‘হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান’ ঐক্য প্রচেষ্টায় ধর্মীয় স্বাধীনতাবিষয়ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনার সিম্পোজিয়ামে আন্তধর্মীয় সংলাপে মতবিনিময়ে অংশ নেন। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) আমন্ত্রণে ২০১৩ সালে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় ‘ডেভেলপমেন্ট স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ উইথ ফেইথ বেইজড অর্গানাইজেশন অ্যান্ড রিলিজিয়াজ লিডারস ইন পপুলেশন, ফ্যামিলি প্ল্যানিং, রিপ্রোডাক্টিভ হেলথ অ্যান্ড জেন্ডার প্রোগ্রাম’ আন্তর্জাতিক ট্রেনিং প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন। এ ছাড়া সার্ক ট্যুরে ১৯৯৭ সালে আমন্ত্রিত হয়ে ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানে বিভিন্ন কনফারেন্সে যোগ দেন।

একজন সাদা মনের অসাধারণ মানুষ ছিলেন ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান। তাঁর জীবনাদর্শে সবকিছুই ছিল অনুকরণীয় ও অনুসরণযোগ্য। তিনি নিজেই হয়ে উঠেছিলেন একটি ইনস্টিটিউট। একজন আদর্শ শিক্ষক, সৎ, নীতিবান, মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন, নিরহংকারী, উদার, সদালাপী ও সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখ এই সাদা মনের মানুষটা অকালে আকস্মিকভাবে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে চলে গেলেন। সময়ে মৃত্যু মানুষের জীবন ঠিকই কেড়ে নিয়ে যায়, কিন্তু মেধাচর্চা ও জ্ঞানবিকাশে যে মানুষেরা দেশ ও জাতিকে সেবা দিয়ে যান, তাঁরা রয়ে যান স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে মানুষের হৃদয়ে আজীবন। কৃতীমান এ শিক্ষাবিদকে বাঙালি জাতি ও মুসলিম বিশ্ব আরবি ভাষা সাহিত্য ও ইসলামি শিক্ষাবিস্তারে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য চিরকাল গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।


লেখক: ড. মুনিম খানের বোন