চায়ের রাজধানী শ্রীমঙ্গলের পথে পথে

এই প্রথম লম্বা ভ্রমণ করছি। ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গল। রাত সাড়ে আটটায় বাসা থেকে বের হয়ে বিমানবন্দর স্টেশনে ৯টা ৬ মিনিটে পৌঁছালাম। ১০টা ১৭ মিনিটে আমাদের ট্রেন উপবন এক্সপ্রেস এসে পৌঁছাল। ইতিমধ্যে আমরা কিছু সেলফি তুললাম এবং ফেসবুকেও আপলোড দিয়ে দিলাম। আমরা চারজন মিলে যাচ্ছি। আমি ও আমিন ভাই পাশাপাশি বসে আছি। তাঁর নাম আমিনুল ইসলাম, আমি আমিন ভাই বলে সম্বোধন করি। এতে তাঁর কোনো আপত্তি নেই। সবুজ ভাই ও তাঁর বন্ধু নুরনবী ভাই বসে আছেন। আধুনিক ছেলেরা যা করার, তাঁরা তাই করছেন, ফেসবুকিং এই যুগের ব্যাধিও বলা যায়। আধুনিক যুগের আধুনিক ব্যাধি। আমি বসে লিখছি। লিখতে খুব কষ্ট হচ্ছে। কারণ, ডায়েরি রাখার ব্যবস্থা নেই। বাঁ হাতের তালুর ওপর ডায়েরি রেখে লিখছি। ট্রেনের ঝকঝকানি ভালোই লাগছে, চোখে ঘুম আসার মতো, কিন্তু আমার ঘুম আসছে না। গাজীপুর স্টেশনে পাঁচ মিনিটের জন্য আমাদের ট্রেন জিরিয়ে নিল। তারপর আবার ছুটল তার গন্তব্যের দিকে। ট্রেনে ওঠার পর একটি কবিতা খুব মনে পড়ছে,

‘ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে
ট্রেনের বাড়ি কই?’
মনের মধ্য অন্য রকম একধরনের আনন্দ কাজ করছে। মনে হচ্ছে আমিই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। দুঃখ–কষ্টহীন মানব।

মাঝেমধ্যে ফেসবুকে আপলোডকৃত ছবির লাইক ও কমেন্টগুলো দেখছি।

বন্ধুদের সঙ্গে লম্বা জার্নি সবচেয়ে অনন্দের হয়। কিন্তু আমার যাত্রাসঙ্গী সব বড় ভাই হওয়ায় সবকিছু ভেবেচিন্তে করতে হচ্ছে। যদি সব বন্ধু হতাম, এতক্ষণে গান-বাজনা আর হাঙ্গামায় বগির অন্য যাত্রীদের কাছ থেকে শত অভিযোগ পেতে হতো। যাহোক, এখন আর সেগুলো হচ্ছে না।

রাত ১১টা ৫৮ মিনিটে ভৈরব বাজার স্টেশনে পৌঁছালাম, এই স্টেশনে প্রচুর হকার দেখা গেল কেউ চিপস, কেউ বাদাম, কলা, ডিম নিয়ে ক্রেতার মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করছেন, কাজটা তাঁরা অতি দ্রুত করছেন। কারণ, ট্রেন বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে না। ট্রেনের বগিতে চা-কফির ব্যবস্থা আছে। দুজনে দুই কাপ কফি নিলাম। চলন্ত ট্রেনে চা-কফি পান করা খুবই কষ্টকর। খুব সাবধানে কফিটা শেষ করলাম। ট্রেনের ঝকঝকানির শব্দে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, ঠিক মনে নেই।

রাত ২টা ২৫ মিনিটে জেগে উঠি এবং বিমানবন্দর স্টেশন থেকে কিনে নেওয়া কেক ও বিস্কুট দিয়ে হালকা নাশতা করে নিলাম। শ্রীমঙ্গলে প্রচুর শীত পড়েছে, তা আগে থেকেই জানতাম। তবে সেই অনুযায়ী শীতের প্রস্তুতিটা নেওয়া হয়নি। তাই শীতের একটি পোশাক খুবই অনুভব করছি। কিছুক্ষণ পর শাল ও চাদরওলা এল। আমিন ভাই দর-কষাকষি করে দুটি একই রঙের শাল কিনে নিলেন। আপাতত শীত নিয়ে ভাবনা আর নেই।

শ্রীমঙ্গল স্টেশনে নামার কথা থাকলেও ঘুমের কারণে তা সম্ভব হয়নি। তাই পরের স্টেশনে আমাদের নামতে হয়। আলহামদুলিল্লাহ ট্রেন থেকে নেমেই শ্রীমঙ্গলে যাওয়ার ট্রেন পেয়ে গেলাম। আল্লাহর অশেষ রহমতের কারণেই ট্রেনটি পেয়েছিলাম। তা না হলে চার-পাঁচ ঘণ্টা স্টেশনই থাকতে হতো।

শ্রীমঙ্গলে এসে পরিচিত এক ভাইয়ের বাসায় উঠলাম। আগে থেকেই সব ঠিকঠাক ছিল। সকাল ৮টায় বের হওয়ার কথা থাকলেও আমরা দেরি করে পৌনে ১০টায়, ঘুম থেকে উঠে তড়িঘড়ি করে বের হয়ে পড়ি। শরীফ ভাই আগে থেকেই সারা দিনের জন্য সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করে রেখেছিলেন। অটোরিকশায় লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের উদ্দেশে রওনা হলাম।

পথে পথে চা-বাগানের ঢেউ দেওয়া দৃশ্য আর আঁকাবাঁকা ও উঁচু-নিচু রাস্তা আমাদের খুবই আনন্দিত ও বিমোহিত করছে। এই অনুভূতি কলমের ভাষায় প্রকাশ করা খুবই কঠিন। বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অপরূপ, তা বইয়ের পাতায় বেশ পড়েছি, কিন্তু আজ নিজের চোখে দেখে মুগ্ধ হচ্ছি। যতই পথ চলছি, ততই প্রকৃতিপ্রেমে পড়ে যাচ্ছি। জীবনের পুরো সময় এই প্রকৃতির মধ্যে কাটিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা করছে। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়।

টিকিট নিয়ে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে প্রবেশ করলাম। ভেতরে প্রবেশের পর চোখে পড়ল লম্বা লম্বা গাছের সারি। গাছগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো গোড়ার দিকে যতটুকু মোটা, আগার দিকে ঠিক ততটুকুই মোটা। এখানের পাহাড়গুলো আকাশমুখী বেশ উঁচু, ঝোপঝাড় ও অপরিচিত লতাপাতা দিয়ে ভরা, বেশির ভাগ বাঁশঝাড় লক্ষ করলাম। জঙ্গলের সরু রাস্তা দিয়ে প্রায় ৪০ মিনিট হাঁটার পর লেবুবাগানের দেখা পেলাম। পাহাড়ের আগাছা পরিষ্কার করে লেবুবাগান করা হয়েছে। লম্বা লম্বা সুপারিগাছও রয়েছে, চোখে পড়ার মতো।

বাগানের মধ্যে কিছু বসতি ঘর দেখতে পেলাম, ঘরগুলো মাটি দিয়ে তৈরি। আমার কাছে মাটির তৈরি ঘরের আলাদা একটা গুরুত্ব রয়েছে। আমাদের আশপাশে যা আছে তার মর্যাদা ও গুরুত্ব কম। যা নেই বা দুষ্প্রাপ্য, তার মর্যাদা অনেক, মাটির ঘর আমার কাছে তেমনি।

ইতিমধ্যে আমিন ভাই ও সবুজ ভাই একটি করে কচি লেবু পেড়েছিলেন। চুরি বলা যাবে না! কারণ, পরে মালিকের কাছে থেকে অনুমতি নেওয়া হয়। তারপর মাটির ঘরের উঠানে এসে দাঁড়ালাম। অল্প বসয়ী এক নারী রান্না করছেন এবং মাছ কাটছেন। তাঁর কাছ থেকে লবণ নিয়ে লেবু খেতে লাগলাম। লেবু খেতে খেতে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান থেকে বের হয়ে আবার রওনা হলাম মধুপুর চা–বাগানের উদ্দেশে।

মধুপুর চা–বাগানে প্রবেশের পর এক চাচা এগিয়ে এলেন, আমাদের গাইড দেওয়ার জন্য। আমরা চাচাকে জানিয়ে দিলাম, আমাদের গাইড লাগবে না। কিছুটা সামনে যেতেই চোখে পড়ে ভ্যানের ওপর আনারস ও ঝালমুড়ি বিক্রির চিত্র। সামনে গিয়ে তাঁদের ভাষা শুনে অবাক হই এবং জিজ্ঞেস করি চাচা এইটা কোন অঞ্চলের ভাষা। তিনি আমাদের ভোজপুরি ভাষার কথা বলেন। আগে কখনো এই ভাষা শুনিনি। তবে বাংলায় যে ভাষার বৈচিত্র্য আছে, তা সবারই জানা। অঞ্চলভেদে ভাষাও ভিন্ন ভিন্ন হয়।

পাহাড়ের ঢালে চা–বাগানের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখে যে কেউ মুগ্ধ হবে। মনে হচ্ছে বিধাতা তাঁর সৌন্দর্য এখানে দিতে কোনো কার্পণ্য করেননি। চারদিকে সবুজে সবুজময়। চোখের পলক পড়তে চায় না। সময় স্বল্পতার কারণে আমরা সেখানে বেশিক্ষণ থাকতে পারিনি। তারপর নুরজাহান চা-বাগান, হরিণচড়া গলফ মাঠ, কালীঘাট চা-বাগান ঘুরে ঘুরে দেখেছি।

শ্রীমঙ্গল ঘুরতে এসে সাত রঙের চা পান করেননি এমন কাউকে পাওয়া যাবে না। আমরাও নীলকণ্ঠ চা স্টোর থেকে চা পান করে রেলস্টেশনের দিকে রওনা হলাম। এবং রাতের ট্রেনে ফিরে এলাম ঢাকায়।

সময় চলে যায়, তবে স্মৃতিগুলো থেকে যায় আজীবন। তেমনি চায়ের রাজধানী শ্রীমঙ্গল ভ্রমণের স্মৃতিগুলো মনের মণিকোঠায় থেকে যাবে আজীবন। হয়তো আবার স্মৃতিচারণা করে ঘুরে বেড়াব এই চায়ের রাজধানীতে।

শিক্ষার্থী: সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা