ঢাবির শতবর্ষ: সাবেকের চোখে ফিরে দেখা

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

স্কুল-কলেজে পড়ার সময় পারিবারিক আবহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গল্প এক ঘোর লাগা অনুভূতি জাগাত; সেটা পরিবারের বড় ভাইদের পড়া ও হলে অবস্থানের কারণে। জগন্নাথ হলের ট্র্যাজেডিতে মাকে সারা রাত নির্ঘুম কাটাতে হয়েছে ছেলে হলে থাকার কারণে; এর আগে পরের ঘটনা মনে না থাকলেও ওটা পরিষ্কার মনে আছে। ভাইয়েরা ক্যাম্পাসের ঘটনা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলে মনের ভেতর অনিন্দ্য ভালো লাগার ঢেউ খেলে যেত অবচেতনেই।


ঢাবির নিরু, বাবলু, শহীদদের গল্প তাদের মুখে শুনে, না দেখলেও চেনা মুখ হয়ে গিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অব্যবহিত আগে–পরে সে ঘোর কিছুটা ছিল বৈকি! হলে অবস্থানের কারণে সে ঘোরে অবশ্য ঝাঁকুনি লাগতে খুব বেশি সময় লাগেনি।

আমাদের সময় বিশ্ববিদ্যালয়, ঘোর এক রাজনৈতিক অমানিশার মধ্যে চলছিল। হলগুলো ছিল সাধারণ, মধ্যবিত্ত, নিম্ন–মধ্যবিত্ত আর গ্রাম, মফস্বল ও ঢাকার বাইরে থেকে আসা ছেলেমেয়েদের আশ্রয়স্থল। প্রথমত, থাকার নিশ্চয়তা; দ্বিতীয়ত তুলনামূলক কম মূল্যে খাবারের নিশ্চয়তা, যদিও মান নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন ছিল; এখনো বোধ করি সে প্রশ্ন অমীমাংসিত। হলের ছাত্রছাত্রীরা জিম্মি ছিল গুটি কয়েক ছাত্র নেতা- কর্মী নামধারীর হাতে, যারা হল নিয়ন্ত্রণ করত; তারা দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের লেজুরবৃত্তিক রাজনীতির লেজ। সাধারণ ছেলেমেয়েদের জোর করে হুমকি–ধমকি এমনকি নির্যাতন করেও মিছিলে নিয়ে যেত; বিনিময় তো ছিল! হলে বিনা পয়সায় খাওয়া, দৃশ্যত আজীবন থাকার নিশ্চয়তা! উপুরি পাওনা হিসেবে বড় ভাইদের (!) থেকে আশীর্বাদ পাওয়া, প্লাস বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের দোকানপাট থেকে মাসোহারা, সহজ কথায় চাঁদা তোলা। হলে নেতাদের সুযোগ তৈরি করার একটা ফাঁদ পাতা থাকত; গণরুমের ব্যবস্থা করা। কারও নামে সিট বরাদ্দ না দিয়ে নিজেদের থাকার জন্য কিছু রাখা, বাদবাকি সাধারণ শিক্ষার্থী, বিশেষ করে নতুনদের এখানে জড়ো করা, থাকার ব্যবস্থা করা। যেখানে সর্বোচ্চ চার–পাঁচজনের থাকার জায়গা সেখানে ২০ থেকে ২২ জন রাখার রেকর্ডও আছে। মাঝেমধ্যে সংবাদপত্রে নিউজ হয় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে, আবার তা সময়ের অতলে তলিয়ে যেতেও দেরি করে না! অথবা অন্য কোনো নতুন কিংবা বড় ঘটনা আগেরটাকে গিলে ফেলে। রুমগুলো অবণ্টিত থাকে হলের দায়িত্বপ্রাপ্তদের গোচরেই। তাঁদের সিল, সম্মতি ছাড়া তো সম্ভব নয়! হলে খাবারের দাম কম হলেও আরেকটু কম হওয়া সম্ভব ছিল, যদি ছাত্রনেতা নামধারীরা ফাউ না খেত!


বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শতবর্ষে পদার্পণ করছে। ১৯২১ সালের ১ জুলাই যাত্রা শুরু হয়েছিল গৌরবের ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের। আমাদের গর্বের অংশ হতে পারা। তবে শতবর্ষে এসে কী নির্মোহভাবে বিবেচনা করা যায় বিশ্ববিদ্যালয় যে প্রতিশ্রুতি বা উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা কতদূর পালন করেছে; আর এখনই–বা কী দায়িত্ব পালন করছে। প্রযুক্তির অভূতপূর্ব অগ্রগতির কারণে যেকোনো বিষয় এখন বৈশ্বিক পরিসরে বিবেচনা করা, তুলনা-প্রতি তুলনা সহজতর হয়ে পড়েছে। আর দেশের অগ্রগামী বিদ্যাপিঠ হিসেবে তো বিভিন্ন পরিমণ্ডলে তাকে প্রতিনিধিত্ব করতে হয়। কাজেই তার অবস্থান দেশীয় ও বৈশ্বিক পরিসরে আলোচিত হচ্ছে। সে আলোচনা অনেক ক্ষেত্রে নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে অসুখকর। কারণ, দেশকে প্রতিনিধিত্ব করা এই প্রতিষ্ঠান দেশের জন্য বৈশ্বিক পরিসরে সম্মানজনক অবস্থান তৈরি করতে ব্যর্থ বা সক্ষম হচ্ছে না। এমন নয় যে তাকে অবস্থান তৈরি করতে হচ্ছে ববং তৈরি করা অবস্থান থেকে ক্রমাগত হটে যাচ্ছে অথবা অন্যরা বেশি অগ্রগতি করে একে পেছনে ফেলে দিচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে, হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হতে থাকবে; কারণ সহসা এর থেকে উত্তরণের সম্ভাবনা আপাতত নেই।


বিশ্ববিদ্যালয়ের দায় এ ক্ষেত্রে কতটুকু? বিশ্ববিদ্যালয়টি দেশীয় পটভূমিকায় ফেললে, বলতে হয় অনন্য। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে বিস্তৃত পরিসরে গড়ে ওঠা এর ক্যাম্পসটি যে কাউকে টানবে। সবুজের সমারোহ সঙ্গে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে মুখর। অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সূতিকাগার; আবেগের জায়গাও দখল করে আছে। এখান থেকে বের হয়েছে বা হচ্ছেও দেশকে নেতৃত্বদানকারী সব মানুষ; গবেষণা ও অন্যান্য বিষয়েও দেশের আর সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তুলনীয় নয়। এর শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা দেশসেরা। শিক্ষকেরা দেশসেরা—মেধা, মনন ও কর্মকাণ্ডে। কিন্তু অধুনা কিংবা বেশ কিছুদিন থেকেই তা যেন প্রশ্নের সম্মুখীন, চ্যালেঞ্জের মুখে। কারণ ওই যে বৈশ্বিক পরিসর নির্ধারিত অনুষঙ্গে তার দুর্বল অবস্থান; তারই প্রতিবেশী দেশের অন্য একাধিক প্রতিষ্ঠান জানান দিচ্ছে তাদের শক্ত অবস্থান। এখানকার শিক্ষার্থীদের অবস্থান কোথায়? উত্তরটা সহজ, কিছু বাদে অধিকাংশই অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়ায়, যা গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা। সে অন্ধকারের অতলে অনেকে হারিয়েও যায়। হারিয়ে যাওয়াদের দায় কেউ নেয় না। না রাষ্ট্র, না সমাজ, না বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় নেবে কী করে? সে ছেড়ে দিতে পারলেই হলো কিংবা কার কী হলো, তা দেখার ফুরসত কোথায়! দেখবেই বা কে? শিক্ষকেরা? সবাই না হলেও মেজরিটির নজর থাকে অন্যখানে, অন্য জায়গায়। সেই অন্যখান হয় রাজনীতি নয়তো প্রাইভেট সেক্টর; যেখানটা তাকে পার্থিব সম্প্রসারিত সুবিধা দেবে। এই সুবিধা সে ছাড়বে কেন? তার যোগ্যতা থাকলে কেন সেটা সে প্রয়োগ করবে না? সেটাই তারা করছে। এই জায়গাটাই সে তার সাবেক অনন্যতা হারিয়ে ফেলছে বা বিকিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। ধরা যাক যে ডাকসাইটে শিক্ষক ৪৫ শতাংশ নম্বর দিতে বরাবর ভীষণ কুণ্ঠিত ছিলেন; কখনো কম্প্রোমাইজ করেননি বা সে রকমটাই চাউর ছিল। সেই তিনিই একই বিষয়ে ৯৫ শতাংশ প্লাস নম্বর দিচ্ছেন। কারণ এ বা এ প্লাস দিতে হবে। সময় মানুষকে বদলে দেয়। কারণে–অকারণে বদলে দেয় বৈকি!


এবার অন্যদের দায়ের প্রসঙ্গে আসা যাক। কেন বিশ্ববিদ্যালয় তার মূল দায়িত্ব পালন করতে পারছে না,
মোটা দাগে বড় একটা কারণ—বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটা বিশেষায়িত জায়গা, যেখানে জ্ঞান অর্জন ও অন্বেষণের সঙ্গে গবেষণাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়; সে জায়গাটি দারুণভাবে উপেক্ষিত। প্রথমত, শিক্ষক-শিক্ষার্থী গবেষণায় উৎসাহী নন। দ্বিতীয়ত, গবেষণায় বরাদ্দের অপ্রতুলতা। এটা প্রবলভাবে দৃশ্যমান। এ দেশে কেউ পিএইচডি করতে চাইলে তার বহুত কাঠখড় তো পোড়াতেই হয়, তাতে কেউ রাজি থাকলেও আর্থিক সংগতি না থাকলে তার পক্ষে পড়া অসম্ভব। এমনকি যাঁরা কর্মজীবী, তাঁদের পক্ষেও এর ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব নয়, বিশেষ করে বেসরকারি খাতে কর্মরতদের জন্য, তিনি শিক্ষকতা পেশায় থাকলেও।


প্রতিষ্ঠান তাঁকে এ ব্যাপারে পৃষ্ঠপোষকতা করে না, করতে পারেও না। ছুটি নেবেন! খাবেন কী? আমরা এমন একটা অচল অবস্থায় আছি, রাষ্ট্রও দায়িত্ব নেবে না পড়াশোনা বা উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে। লোন দিতে পারে, সে পথেও হাঁটবে না। জীবনের কোন পর্যায়ে এসে তাঁরা লোন শোধ করে দেবেন, সে দায় রাষ্ট্র নেবে কেন! কিন্তু শিক্ষকদের কাছে তো দেশ–জাতির প্রত্যাশা অনেক; সেটাই স্বাভাবিক অথচ বাস্তবতা বলছে অন্য কথা। শিক্ষার টারশিয়ারি লেভেলে অবস্থা আরও ভয়াবহ, বিশেষ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের।এমনকি উচ্চতর পর্যায়েও শিক্ষা–সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডে জড়িতদের সঙিন অবস্থা। করোনা বিষয়টি আরও উদাম করে দিয়েছে। স্বাস্থ্য খাতের ভয়াবহতম অবস্থা নিয়ে সবাই সোচ্চার বলে বাদবাকি ক্ষেত্রেগুলো আলোচনার পর্যাপ্ত স্পেস, সময় ও গুরুত্ব পেয়ে উঠছে না। তবে ক্ষত তো ক্ষতই, দেখা যাক আর না যাক।

*সাবেক শিক্ষার্থী, সেশন ৯৬-৯৭; সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি বিভাগ
ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ, ইউডা