করোনাদিনের উপলব্ধি: যান্ত্রিক জীবন ফেরত চাই না

ছাদবাগানে চাষ করে তাজা সবজি পেতে পারেন। ছবি: নকশা
ছাদবাগানে চাষ করে তাজা সবজি পেতে পারেন। ছবি: নকশা

আজকাল অনেককেই দেখি বাসার বারান্দায় বা ছাদে বাগান করার ছবি ফেসবুকে আপলোড করতে। হোম কোয়ারেন্টিনের দিনগুলোতে টবে ফুল, ফল বা সবজির গাছ লাগানোর প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। চমৎকার একটা ব্যাপার। আমার বাসায় বারান্দাতে আগে থেকেই অনেক গাছ আছে। অনেকে আছেন যাঁরা গাছের পরিচর্যার পেছনে অনেক সময় আর শ্রম দেন। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমাদের সে রকম মনপ্রাণ দিয়ে বাগান করার শখ নেই। বাসার বারান্দায় থাকা গাছগুলোতে নিয়মিত পানি দেওয়া, মাটি আলগা করা আর নির্দিষ্ট সময় পরপর সার দেওয়ার মতো হালকা কাজগুলোই শুধু আমরা করি। তাতেই যতটুকু আনন্দ পাই, তার মূল্য কিন্তু অসীম। যে দেখেছে শুধু সে-ই জানে একটা টবে হঠাৎ একদিন মাটি ফুঁড়ে গজিয়ে ওঠা একটা চারা দেখতে পাওয়াটা কতটা বিস্ময়কর। গাছের ডাল কেটে টবে লাগিয়ে দেওয়ার পর সেই ডালটা ধীরে ধীরে গাছে পরিণত হয়, ডালপালা মেলে, একসময় তাতে ফুল ফোটে। নিজের হাতে যত্ন নেওয়া একটা প্রাণকে পরিস্ফুটিত হতে দেখার মতো এত আনন্দ আমাকে হাজার টাকায় কেনা গয়না বা শাড়িও দিতে পারে না।

হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার ফলে সেই মার্চ মাস থেকে প্রতিদিন বারান্দায় কিছুক্ষণ বসে থাকাটা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কোন গাছ কতটুকু বড় হলো, কোনটাতে কুঁড়ি এল, কোন নতুন চারাটা গজাল—এসব আমি মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করি। আমার বারান্দাজুড়ে নিত্যনতুন কত অসাধারণ ঘটনা যে ঘটতে দেখি! সেখানে সারা দিন শব্দহীনভাবে প্রাণের শোরগোল চলে। আমি উপলব্ধি করি, প্রতিটি গাছের আলাদা জীবনকাহিনি আছে, তাদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম একেক রকম। আমি প্রকৃতির এই অপরিসীম ক্ষমতায় মুগ্ধ হই। বাসায় বন্দী থাকা এই সময়গুলোতে বারান্দার এক ফালি সবুজ তাই আমার মনকে প্রশান্ত করে। ধারণা করছি, যাঁরা এই সময়ে বারান্দা বা ছাদে বাগান করছেন, তাঁদেরও হয়তো গাছের যত্ন নেওয়া, তাতে ফুল ফোটানো বা সবজি ফলানোর কাজগুলো আনন্দ দিচ্ছে। আচ্ছা, আপনারা কি উপলব্ধি করতে পারছেন, একটা প্রাণকে জাগ্রত করতে পারা, তাকে লালন করে বড় করে তোলার মধ্যে কতখানি মানসিক প্রশান্তি আছে? আপনাদের কি মনে হচ্ছে, আপনারা প্রকৃতির কাছাকাছি চলে এসেছেন, প্রকৃতির জীবন চক্র কি আপনাদেরও আমার মতোই মুগ্ধ করছে?

বারান্দায় এমন বাগান মনে প্রশান্তি এনে দেবে। ছবি: অধুনা
বারান্দায় এমন বাগান মনে প্রশান্তি এনে দেবে। ছবি: অধুনা

আমরা, ‘মানুষ’ নামের প্রজাতিটা বড্ড নিষ্ঠুর। প্রকৃতিকে আর তার প্রাণসম্পদকে আমরা ভালোবাসি না। সেখান থেকে কেমন করে মিলেমিশে থাকতে হয়, তার কিছুই শিখি না। আমরা শুধু জানি কোনো সুন্দর জায়গায় বেড়াতে গিয়ে খাবারের প্যাকেটসহ নানা রকম ময়লা ফেলে সেই জায়গার পরিবেশের বারোটা বাজাতে। ছোট ছোট ছেলেরা কুকুরছানার গলায় দড়ি বেঁধে তাকে জোর করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, সদ্য জন্মানো বিড়ালছানাকে কোলে নিয়ে মজার নামে নানাভাবে কষ্ট দিচ্ছে—এসব দেখে আমরা বড় হয়েছি। অকারণে গাছের ডাল ভাঙা বা পাতা ছেঁড়ার অভ্যাসের কথা তো বাদই দিলাম। তাই দেশের নদীগুলো ভরাট হয়ে যাওয়া, সেগুলোর পানি দূষিত হয়ে পড়া আমদের বিচলিত করে না। প্রকৃতি, পরিবেশ বা প্রাণীর দুঃখ-কষ্ট বা বোবাকান্নাও আমাদের স্পর্শ করতে পারে না। কোনো বড় ঝড় এলে আমরা সুন্দরবন কেমন করে সেটিকে ঠেকাল, সেই খবর ফেসবুকে শেয়ার করি, কিন্তু কয়লাভিত্তিক সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করার ফলে সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে কি না, সে বিষয়ে প্রকৃতপক্ষে আমাদের বেশির ভাগ মানুষেরই তেমন মাথাব্যথা নেই।

এভাবেই আমরা পরিণত হয়েছি ব্যক্তিস্বার্থ আর লোভ-লালসার দাসে। আমরা এমনকি একে অন্যকেও ভালোবাসি না। এ কারণেই মানবসভ্যতার ইতিহাস শুধু হিংসা-বিদ্বেষে ভরা। প্রকৃতিতে সবল প্রাণী বেঁচে থাকার প্রয়োজনে দুর্বল প্রাণীকে হত্যা করে। এটা একটা জীবন চক্র। শুধু আমরা, মানুষই কারণে-অকারণে দুর্বলকে আঘাত করি। আমরা প্রত্যেকে শুধু নিজের জন্য বাঁচি। এ কারণেই আমাদের জীবনজুড়ে এত অন্যায়, অরাজকতা। এমনকি আমাদের পারিবারিক জীবনেও মা-বাবা, স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোনসহ এমন কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই যেখানে ন্যায় আর অন্যায়ের পাল্লাটা নিয়মিত ওঠানামা করে না। তাই করোনা সংক্রমণের এই দিনগুলোতে আমি মনে মনে আশা করছি পরিবেশকে ধ্বংস করার ফলাফল কতটা ভয়ংকর আকারে মহামারিরূপে আমাদের কাছে ফিরে এসেছে, তা একটু হলেও অনেকেই হয়তো উপলব্ধি করতে পারছেন।

ছাদে বাগান করলে নিতে হবে বাড়তি যত্ন। মডেল: জারা। ছবি: খালেদ সরকার
ছাদে বাগান করলে নিতে হবে বাড়তি যত্ন। মডেল: জারা। ছবি: খালেদ সরকার

ঘরে বসে থাকতে থাকতে একটু খোলা হাওয়ার জন্য আমাদের মন হাঁসফাঁস করছে। ফেসবুকে সুন্দর কোনো জায়গার ছবি দেখলে শুধু ভাবছি, কবে সব আগের মতো হবে, কবে প্রকৃতির মাঝে যাওয়ার সুযোগ পাব। আপনি কি মনে করতে পারবেন, শেষ কবে আপনি প্রকৃতির প্রতি এই টান অনুভব করেছেন? ভোগবিলাস আর হিংসা-বিদ্বেষে ঠাসা জীবনের চেয়ে কখনো কি আপনার প্রকৃতির মাঝে গিয়ে শান্তিময় কিছু সময় কাটানোকে এতটা জরুরি মনে হয়েছে? তাই অনুরোধ থাকবে, সবকিছু আগের মতো হয়ে যাওয়ার পর প্রকৃতিকে কাছে পাওয়ার জন্য আমাদের মনে আজকের যে আকুতি, তাকে যেন ভুলে না যাই। যেন প্রকৃতি আর পরিবেশের প্রতি আরেকটু যত্নশীল হই। সুন্দর জায়গায় বেড়াতে গিয়ে সেখানকার পরিবেশ নোংরা করার আগে, ছবি তোলার জন্য সব ফুল ছিঁড়ে নেওয়ার সময় প্রকৃতি আর তার জীবসম্পদকে কষ্ট দিচ্ছি কি না, তা একটু ভাবি।

সম্প্রতি আমরা কক্সবাজারে সৈকতের কাছাকাছি বা হালদা নদীতে ডলফিন ফিরে আসার কথা শুনছি, আবার সেগুলোকে হত্যা করার খবরও পাচ্ছি। রাজশাহীতে দুর্লভ প্রজাতির ২০০টি শামুকখোল পাখি এলাকাবাসীরা রান্না করে খেয়ে ফেলার খবরে আমরা ব্যথিত হয়েছি। আপনি যদি এখন হোম কোয়ারেন্টিনে না থেকে নিত্যদিনের যান্ত্রিক জীবন নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন, তাহলে হয়তো এই খবরগুলো আপনার চোখেই পড়ত না। আপনার মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা অন্য প্রাণীর প্রতি ভালোবাসাটুকু চাপাই পড়ে থাকত। আমাদের উচিত প্রাণী হত্যার এই ঘটনাগুলো যে কতটা অমানবিক, তা বাসার শিশুদের বুঝিয়ে বলা, যেন তাদের মনে ওই প্রাণীগুলোর প্রতি ভালোবাসার জন্ম হয়। তাদের বারান্দার টবে গাছ লাগাতে, তাতে পানি ঢালতে উৎসাহিত করা। আরও উচিত বারান্দার এক কোণে পাখিদের জন্য একটুখানি চাল রেখে দেওয়া আর শিশুদের পাখির চাল খাওয়ার দৃশ্য উপভোগ করতে শেখানো।

শহুরে জীবনে সবুজের ছোঁয়া পেতে অনেকেই টবের গাছ দিয়ে ঘর সাজান৷
শহুরে জীবনে সবুজের ছোঁয়া পেতে অনেকেই টবের গাছ দিয়ে ঘর সাজান৷

আমরা চাই না আমাদের শিশুরা আমাদের মতো নিষ্ঠুর হয়ে বড় হোক, তারা জীবনভর শুধু পাওয়া না-পাওয়ার হিসাব মিলাক। আমরা চাই তারা সবাই একটা মানবিক পৃথিবীতে বাস করুক, যেখানে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী মিলেমিশে থাকবে। আরও চাই শুধু স্বার্থ আর অর্থের মানদণ্ডে নয়, বরং মানবিক গুণাবলির চর্চার মধ্য দিয়ে প্রকৃতির সন্তান হিসেবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জীবনকে উপভোগ করতে শিখুক। কে জানে, করোনাভাইরাস আমাদের ঘরের মধ্যে আটকে রেখে প্রকৃতিকে মুক্ত করে দিয়ে হয়তো সেই বার্তাটাই মনে করিয়ে দিচ্ছে।

*উন্নয়ন পেশাজীবী ও কলাম লেখক