সামাজিক দূরত্ব মানেই সামাজিকভাবে বয়কট নয়

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

করোনাভাইরাসের প্রকোপ সারা বিশ্বে এখন বেশ চরমে। বিশ্বের সব দেশ এ ভাইরাস প্রতিরোধে হিমশিম খাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন ভ্যাকসিন/ওষুধ আবিষ্কারের। বাংলাদেশ সরকার তাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করছে কীভাবে অর্থনীতির চাকা সচল রাখার পাশাপাশি করোনা মোকাবিলা করা যায়। তবে কোনোভাবেই যেন পেরে ওঠা যাচ্ছে না ভয়ংকর এই অনেকটা দানবীয় রূপ নেওয়া করোনাভাইরাসের সঙ্গে। তাই প্রতিদিনই সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নিশ্চিত হওয়া কিংবা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা। 

অজানা ও অচেনা এই করোনা নামের নিষ্ঠুর ভাইরাস যেন বাংলাদেশের মানুষকে নানারূপে শাসন করছে, ধ্বংস ও নষ্ট করে দিচ্ছে সামাজিক ও পারিবারিক জীবন। মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠের মতো সামাজিক দূরত্বের ক্ষেত্রেও মানুষের মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। কিছু মানুষ নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আবার তাঁর আশপাশেই কিছু মানুষ ঝুঁকি নিয়েই আড্ডায় মেতে উঠছেন ঘরে কিংবা বাইরে। সরকারের পক্ষ থেকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কঠোর নির্দেশনা থাকার পরও শহর কিংবা গ্রামাঞ্চলে অনেকেই সেটা মানছেন না, বরং তুচ্ছতাচ্ছিল্যে চারপাশের মানুষকে ফেলছেন চরম ঝুঁকিতে।
মানুষ সামাজিক জীব। তবে করোনাভাইরাসের ছোবলে থমকে গেছে যেন সেই সামাজিকতা। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো যাদের কর্মব্যস্ততার দরুন সাধারণ মানুষের মধ্যে সামাজিকতার বন্ধন ছিল অনেকটাই সাদামাটা, কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে তারাও সামাজিক বন্ধন বাড়ানোর জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন: ইংল্যান্ডে ও আয়ারল্যান্ডে সর্বোচ্চ ছয়জন মানুষের দল একত্র হতে পারবেন পরস্পর থেকে ছয় ফুট বা দুই মিটার দূরত্ব বজায় রেখে, স্কটল্যান্ড ও ওয়েলসে দুই পরিবারের সর্বোচ্চ আটজন মানুষ ঘরের বাইরে একত্র হতে পারবেন একইভাবে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে। পাশাপাশি উন্নত বিশ্বের করোনা-আক্রান্ত দেশগুলোতে এমন ভয়ংকর মহামারির সময় পরিলক্ষিত হয়েছে সামাজিক বন্ধন অটুট রাখার বিভিন্ন ঘটনা। অধিকাংশ স্থানে বাসিন্দারা করোনা-আক্রান্ত পরিবারগুলোকে দিয়েছেন সর্বোচ্চ সহযোগিতা। কেউ কেউ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বাজার করে আক্রান্ত প্রতিবেশীর দরজায় দিয়ে আসছেন নিজে থেকেই, অনেকেই মানসিকভাবে শক্তিশালী করতে আক্রান্তদের দিয়ে যাচ্ছে মানসিক সহযোগিতা (বাসার বারান্দা থেকে গান গেয়ে, কবিতা আবৃত্তি করে প্রভৃতি)। এমনকি তাঁরা করোনায় আক্রান্তদের কিংবা মৃত ব্যক্তিদের পরিবারকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে, সচেতনভাবে সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ রেখে সুস্থ হয়ে আগের অবস্থায় ফিরে আসতেও সর্বদা করে যাচ্ছেন সর্বোচ্চ সহযোগিতা। যেটা হয়তো করোনা-পূর্ববর্তী সময়ে উন্নত বিশ্বের অনেক বাসিন্দার কাছে ছিল অকল্পনীয়। কারণ তাঁরা সামাজিক বন্ধন অটুট রাখার চেয়েও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যস্ত ছিলেন নিজেদের কর্মচঞ্চল জীবন নিয়ে।

রয়টার্স প্রতীকী ছবি
রয়টার্স প্রতীকী ছবি

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপরূপ লীলাভূমি বাংলাদেশ, যেখানে অধিকাংশ মানুষই সামাজিক সম্পর্কের এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ। পারস্পরিক সম্পর্ক, সামাজিকতার সেতুতে চড়া সংস্কৃতিনির্ভর বাংলাদেশ। সামাজিকতা বজায় রাখা বাঙালির সহজাত নেশা। যুগ যুগ ধরে গড়ে ওঠা এই সামাজিক সংস্কৃতি থেকে হঠাৎ করে আলাদা হওয়া সহজ না। কিন্তু করোনার মরণ থাবা বাংলাদেশের শহর ও গ্রামে সৃষ্টি করেছে এক ভিন্ন দৃশ্যপট। যেখানে করোনা-পূর্ববর্তী সময়গুলোতে বাঙালিরা সবাই সবার বিপদে সব সময় নিজের জীবন বাজি রেখে এগিয়ে আসতে দ্বিধা বোধ করতেন না। সেখানে করোনার এমন ভয়াল রূপের সময়ে সবাইকে না তবে অনেককেই দেখা গেছে আক্রান্ত মানুষের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করতে, যা একদমই অপ্রত্যাশিত। আক্রান্ত মানুষের পরিবারকে করা হচ্ছে সামাজিক ও মানসিকভাবে অসম্মান। তাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে সচেতন থেকে যতটা সামাজিকভাবে সহযোগিতা করা উচিত, তা না করে বরং দেখা হচ্ছে বাঁকা চোখে। এমনকি অনেক জায়গায় দেখা গেছে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা না গেলেও, তাদের পরিবারের মানুষগুলোর সঙ্গে করা হচ্ছে দুর্ব্যবহার এবং সামাজিকভাবে অনেক ক্ষেত্রেই তাদের বয়কট করা হচ্ছে। আসলে আক্রান্ত ব্যক্তিরা ও তার পরিবারের প্রিয় মানুষগুলো এমন কোনো ধরনের খারাপ কিছু করেনি, যে কারণে তাদের অসহযোগিতা করতে হবে অথবা স্বাস্থ্যবিধি মেনে তাদের পাশে না দাঁড়িয়ে তাদের নিষ্ঠুরভাবে সামাজিক ক্ষেত্রে বয়কট করতে হবে। এমন মহামারি পরিস্থিতিতে সবাইকে যেমন সচেতন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে করোনা প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে, ঠিক তেমনি প্রতিবেশীদের ও চারপাশের প্রিয় মানুষগুলোকে মানসিকভাবে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করতে হবে। কারণ, এই বৈশ্বিক পরিবেশে সবাই মিলে সহযোগিতার মাধ্যমে সামাজিক সম্প্রীতি বজায় রেখে করোনাকে পরাজিত করা গেলে ভবিষ্যতে যেকোনো দুর্যোগ ঠেকানোর পথ আরও প্রশস্ত হবে। তাই সবার এমন মহামারি দুর্যোগের সময় যেমন নিজেকে থাকতে হবে সচেতন, কঠোরভাবে মানতে হবে সরকার ঘোষিত স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব, ঠিক তেমনি সমাজের মানুষগুলোর প্রতি হতে হবে মানবিক, করতে হবে সর্বোচ্চ লেভেলের মানসিক ও সামাজিক সহযোগিতা।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়