কেমন আছে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরা

করোনাকালীন এই সময় আমাদের সবার জন্যই কঠিন। কিন্তু বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য সময়টা আরও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের কাটাতে হচ্ছে ঘরবন্দী জীবন। অনেকে এখানে অভ্যস্ত হতে পারছে না। অনেকের দেখা দিয়েছে নানা সমস্যা। স্পিচথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপিসহ তাদের জন্য যে বিশেষ স্কুল, তার কার্যক্রমেও ব্যাঘাত ঘটেছে। ফলে তারা সাহায্য নেওয়ার সুযোগটাও তেমন পাচ্ছে না। অনেকে অনলাইনভিত্তিক সুবিধা পেলেও তাদের সংখ্যা খুবই নগণ্য।

অন্যদিকে গণমাধ্যমের কল্যাণে বর্তমান সময়ের বেড়ে যাওয়া পারিবারিক বিরোধ, কলহ, মতপার্থক্য, নারী নির্যাতনসহ অন্যান্য নানান সমস্যার কথা তো জনসমক্ষে আসছে। কিন্তু এই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের দুর্দশাগুলো রয়ে গেছে লোকচক্ষুর আড়ালে।

চলুন দৃষ্টি দিই মহামারির এই সময়ে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য তৈরি হওয়া কিছু সমস্যার দিকে:
• অনেকেই ঘরবন্দী এই জীবনে খাপ খাওয়াতে পারছে না। ফলে তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে অসহিষ্ণুতা।
• অনেক বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু রয়েছে, যারা তাদের দৈনন্দিন জীবনের সামান্যতম পরিবর্তন হলেও মেনে নিতে পারে না; তাদের মধ্যে দেখা দেয় অস্থিরতা।
• কিছু কিছু শিশুর মধ্যে কামড় দেওয়া, খামচি দেওয়াসহ অন্যান্য নানান আক্রমণাত্মক আচরণ খুব বেড়ে গেছে। মাঝেমধ্যে তারা নিজেকেও আঘাত করছে।
• দীর্ঘদিন বাসায় থাকার কারণে তাদের দৈনিক যে অনুশীলন, সেটা ঠিকমতো হচ্ছে না। ফলে তারা পূর্বে শেখা অনেক কিছুই ভুলে যাচ্ছে।
• তাদের স্বাস্থ্যসম্পর্কিত যেসব সমস্যা রয়েছে তার জন্য পর্যাপ্ত ট্রিটমেন্ট অথবা থেরাপিও তারা এখন পাচ্ছে না।
• মা–বাবার সময়ও ভাগ হচ্ছে বিভিন্ন কাজে। যাঁদের অন্য শিশুসন্তান রয়েছে, তাঁদের সেসব বাচ্চাকেও সময় দিতে হচ্ছে। ফলে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুটিকে আর আলাদাভাবে সময় দেওয়া হচ্ছে না।
• করোনাকালীন এই সময়ে যেসব হাইজিন মেনে চলা উচিত, সে সম্পর্কেও অনেকেই বুঝতে পারছে না। তাই এগুলো মেনে চলতেও তাদের অসুবিধা হচ্ছে।
• দেখা গেছে, এই সময়ে পারিবারিক দ্বন্দ্ব খুব বেড়ে গেছে, যার প্রভাবও শিশুটির ওপর পড়ছে। তারা মানসিক নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। বেড়ে গেছে হতাশা ও উদাসীনতা।

অভিভাবকেরা সব থেকে বেশি সময় কাটান শিশুদের সঙ্গে। তাই বলা হয়, একটি বিশেষ শিশুর সমস্যাগুলো সমাধানে সব থেকে বড় ভূমিকা রাখেন অভিভাবকেরাই। বর্তমান সময়টাও কিন্তু ভিন্ন নয়। অভিভাবকেরাই পারেন তাঁর বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুটিকে সাহায্য করতে। এর জন্য প্রয়োজন কিছু দিকনির্দেশনা, যেগুলো তাঁরা অনুসরণ করতে পারেন।

অভিভাবকদের করণীয় নিয়ে কিছু কথা:

যা যা করবেন:

• শিশুটিকে যথেস্ট সময় দিন। দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় শুধু তাকে নিয়ে কাটান।
• তার জন্য একটি দৈনন্দিন কার্যক্রমের তালিকা তৈরি করুন। যেখানে তার খাওয়া, ঘুম, অধ্যয়ন, খেলাধুলাসহ সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
• যেহেতু শিশুটির দৈনিক অনুশীলনটা তার স্কুল অথবা স্পিচথেরাপি সেন্টার বন্ধ থাকার কারণে হচ্ছে না, সে ক্ষেত্রে তার শিক্ষক বা স্পিচথেরাপিস্টের সঙ্গে কথা বলুন এবং ঘরেই শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করুন।
• মানসিকভাবে তাকে ভালো রাখার চেষ্টা করুন। শিশুর পছন্দ এবং অপছন্দকে গুরুত্ব দিন।
• যেসব শিশু খুব বেশি অসহিষ্ণু ও আক্রমণাত্মক ব্যবহার করছে, তাদের ক্ষেত্রে লক্ষ করুন—কী করলে শিশুটা এ রকম ব্যবহার করে।
• যাদের নিয়মিত অকুপেশনাল থেরাপিস্টের সাহায্য নিতে হয়, তাদের অভিভাবকেরা অকুপেশনাল থেরাপিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করুন এবং করণীয় জেনে নিন।
• খেলার ক্ষেত্রে শিশুটিকে নির্ধারণ করতে দিন সে কী নিয়ে খেলবে। খেলার মাধ্যমে তাকে নানা বর্ণ, শব্দ ও বাক্য শেখাতে চেষ্টা করুন।
• কোনোভাবেই যাতে স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, টেলিভিশনে আসক্তি না তৈরি হয়; সেদিকে খেয়াল রাখবেন।
• কিছুক্ষণ পরপর সাবান দিয়ে হাত ধোয়াসহ অন্যান্য হাইজিন মেনে চলতে সাহায্য করুন।
• দৈনিক অন্তত ১৫ মিনিট এক্সারসাইজ করায় অভ্যস্ত করুন। এ ক্ষেত্রে আপনি নিজে তাকে দেখিয়ে দিন এবং আপনাকে অনুসরণ করতে বলুন।

যা যা করবেন না:
• কোনো বিষয় নিয়ে শিশুটির ওপর জোর প্রয়োগ করা অথবা তাকে শাস্তি দেওয়া যাবে না।
• যেসব কাজে শিশুটি অসহিষ্ণু ও আক্রমণাত্মক হয়ে যায়, সেগুলো এড়িয়ে চলুন।
• দৈনিক অনুশীলনটা যেন বই পড়া বা মুখস্থ করার মতো করে না হয়। খেলার মাধ্যমে শেখানোর চেষ্টা করুন।
• অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রেই শিশুকে স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ ব্যবহার করতে দেবেন না।
• নিজেরা মানসিকভাবে সুস্থ থাকার চেষ্টা করুন। নিজেদের অস্থিরতা শিশুটির সামনে প্রকাশ করবেন না। না হয় এর প্রভাব তার ওপরও পড়বে, যার ফলে শিশুটির অস্থিরতা আরও বেড়ে যেতে পারে।

আমাদের দেশে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর সংখ্যা নেহাতই কম নয়। কিন্তু সচেতনতার অভাবেই এই শিশুরা অনেকটা পিছিয়ে থাকে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন থেকে। আমাদের উচিত তাদের সমস্যাগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া এবং সমাধানের চেষ্টা করা। তাহলেই তাদের দেশের সম্পদ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

*শিক্ষার্থী: যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।