কৃষি প্রকৌশলী ও টেকসই যান্ত্রিকীকরণই কৃষির ভবিষ্যৎ

উৎপাদন থেকে বাজারজাত পর্যন্ত প্রায় ১৪ শতাংশ শস্য বিনষ্ট হয়, যার পরিমাণ প্রায় ৫০ লাখ টন। তাই সঠিক যান্ত্রিকীকরণ করার কোনো বিকল্প নেই। ছবি: লেখক
উৎপাদন থেকে বাজারজাত পর্যন্ত প্রায় ১৪ শতাংশ শস্য বিনষ্ট হয়, যার পরিমাণ প্রায় ৫০ লাখ টন। তাই সঠিক যান্ত্রিকীকরণ করার কোনো বিকল্প নেই। ছবি: লেখক

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে কৃষি খাতকে সচল রাখতে এবং করোনা–পরবর্তী খাদ্যসংকট মোকাবিলায় বর্তমান সরকারের পাশাপাশি নানা উদ্যোগ নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। ক্রমাগত কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি অব্যাহত রাখা, টেকসই কৃষি যান্ত্রিকীকরণ এবং কৃষিপণ্যের বাজারজাতকরণ ও বিপণনের মাধ্যমে ন্যায্য মূল্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার।

বর্তমান সরকার কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে নানাবিধ উপায়ে খাদ্যনিরাপত্তা বিধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যার সঙ্গে পুষ্টি উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচনের সম্পর্ক রয়েছে। প্রকৃতিগত কারণে প্রতিবছর দেশে ০.৪৩ ভাগ হারে কৃষিজমি হ্রাস পেলেও দেশে স্বাধীনতা–পরবর্তী সময়ের তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেড়েছে চালের উৎপাদন। কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে চাল উৎপাদন বাড়ছে বাংলাদেশে এবং চলতি অর্থবছরে (২০১৯-২০২০) উৎপাদন ৩ কোটি ৬০ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) পূর্বাভাস বলছে।

অন্যদিকে উৎপাদন থেকে বাজারজাত পর্যন্ত প্রায় ১৪ শতাংশ শস্য বিনষ্ট হয়, যার পরিমাণ প্রায় ৫০ লাখ টন। উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রতিটি ক্ষেত্রে সঠিক মাত্রায় যান্ত্রিকীকরণ করা গেলে শস্যের অপচয় কমিয়ে ৫ শতাংশে আনার মাধ্যমে প্রায় ৩২ লাখ টন শস্যের অপচয় রোধ করা সম্ভব, যার বর্তমান বাজারমূল্য চালের দর ৩৬ টাকা কেজি হিসাবে প্রায় ১১.৫ হাজার কোটি টাকা। শস্য উৎপাদনের পর নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে উৎপাদনে বড় ধরনের ফারাক তৈরি হচ্ছে। এসব দূর করতে খামার যান্ত্রিকীকরণ করার কোনো বিকল্প নেই।

ক্রমাগত কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি অব্যাহত রাখা, টেকসই কৃষি যান্ত্রিকীকরণ এবং কৃষিপণ্যের বাজারজাতকরণ ও বিপণনের মাধ্যমে ন্যায্য মূল্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। ছবি: লেখক
ক্রমাগত কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি অব্যাহত রাখা, টেকসই কৃষি যান্ত্রিকীকরণ এবং কৃষিপণ্যের বাজারজাতকরণ ও বিপণনের মাধ্যমে ন্যায্য মূল্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। ছবি: লেখক

কৃষি উন্নয়নের যে বিপ্লব সাধিত হয়েছে বাংলাদেশে, তা এখন কারও অজানা নয়। খাদ্যশস্য উৎপাদনে দেশে যে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে, তার পেছনে বেশ কটি কারণ বিদ্যমান থাকলেও ধানের নতুন নতুন জাত এবং প্রযুক্তির উদ্ভাবন অন্যতম। সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপ, কৃষিবিজ্ঞানী ও সম্প্রসারণবিদদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং কৃষকের পরিশ্রম কৃষিবিপ্লবের উন্নয়নের ধারাকে আরও বেগবান করেছে। কৃষি উৎপাদনে এই সাফল্যকে টেকসই করার মাধ্যমে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কৃষিকে টেকসই যান্ত্রিকীকরণের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিকল্প নেই। এ বিষয়টি উপলব্ধি করেই কৃষিব্যবস্থার আধুনিকায়নের তথা যান্ত্রিকীকরণের জন্য তিন হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার বিষয়টি নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণে সার্বিক ও সমন্বিত উন্নয়ন এবং অগ্রগতিতে প্রয়োজন পরিকল্পিত পদক্ষেপ। গত বোরো মৌসুমেই বাংলাদেশ কৃষি যান্ত্রিকীকরণের নতুন যুগে প্রবেশ করেছে।

কৃষি মন্ত্রণালয় আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই দেশের প্রচলিত পদ্ধতির কৃষিকে আধুনিক যন্ত্রনির্ভর কৃষিতে পরিণত করার উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়েই কাজ করছে। সেচ, জমি তৈরি এবং শস্য মাড়াইয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রায় শতভাগের কাছাকাছি চলে গেলেও চারা রোপণ (ট্রান্সপ্লান্টিং) এবং ধান কর্তনের (হারভেস্টিং) ক্ষেত্রে যন্ত্রের বব্যবহারে বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে। এই দুই ক্ষেত্রে যান্ত্রিকীকরণে জোর দিয়েছে সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় গত বোরো মৌসুমে কৃষকদের সরাসরি ৬০ শতাংশ ভর্তুকিতে কম্বাইন্ড হারভেস্টার দেওয়া হয়। সামনে আমন মৌসুম। বিগত সময়ে বিভিন্ন কর্মসূচি এবং প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকের মধ্যে ভর্তুকি মূল্যে সরবরাহকৃত প্রায় ৯০০-১০০০টি রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টারকে সচল করার পাশাপাশি নতুন করে মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই নতুন রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টার ভর্তুকি মূল্যে সরবরাহের উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। কারণ, যান্ত্রিক পদ্ধতিতে রোপণের জন্য বিশেষ পদ্ধতিতে ধানের চারা তৈরি করতে হয়। তা ছাড়া যন্ত্রের সঙ্গে পরিচিতি, চালনা কৌশল, মাঠের সমস্যা দূরীকরণ ইত্যাদি কাজের জন্য সময়ের প্রয়োজন। প্রয়োজন প্রশিক্ষিত জনবলের। হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই দক্ষ জনবল তৈরি করা সম্ভব। অন্যথায় সরবরাহ করা যন্ত্রপাতি থেকে কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া যাবে না।

টেকসই কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সময় বাঁচবে। ছবি: লেখক
টেকসই কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সময় বাঁচবে। ছবি: লেখক

কৃষক পর্যায়ে ব্যবহৃত কৃষিযন্ত্রের সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে সুফল পেতে হলে দক্ষ ব্যবস্থাপনার কোনো বিকল্প নেই। কৃষি যন্ত্রপাতির দক্ষ ব্যবস্থাপনার জন্য কৃষি প্রকৌশলীদের কাজে লাগানো এখন সময়ের দাবি। একজন কৃষি প্রকৌশলীই কোনো একটি নির্দিষ্ট এলাকার মাটি, ফসল, ফলন, কৃষকের চাহিদা এবং সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করে উপযুক্ত যন্ত্রপাতি নির্বাচন, শনাক্তকরণ এবং প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

কোনো একটি দেশের টেকসই যান্ত্রিকীকরণ ও কৃষি প্রকৌশলী একসূত্রে আবদ্ধ। ভর্তুকিতে কৃষক পর্যায়ে উন্নত প্রযুক্তি এবং যন্ত্রপাতি কৃষকের মধ্যে দেওয়ার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণকে সাময়িকভাবে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হলেও টেকসই রূপদানে কৃষি প্রকৌশলীদের কাজে লাগাতে হবে এবং স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। কৃষি প্রকৌশলীদের কাজে লাগিয়েই তৈরি করা যাবে দক্ষ যন্ত্রচালক। একজন কৃষি প্রকৌশলী গবেষণা প্রতিষ্ঠানে উদ্ভাবন ও উন্নয়নকৃত প্রযুক্তি এলাকাভেদে মূল্যায়ন, উন্নয়নে কার্যকরী সুপারিশ প্রদান, কৃষক পর্যায়ে পরিচিতিকরণ, কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদান এবং কৃষি যান্ত্রিকীকরণে গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং মাঠপর্যায়ে যোগসূত্র স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে বলে বিশ্বাস করি।

কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক রাজধানীর বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের সভাকক্ষে কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে বলেন, উদ্ভাবন বা নতুন আবিষ্কার এমন হতে হবে যেন তা ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষক সহজে ব্যবহার করতে পারে। এ ছাড়া যে দেশ থেকেই যন্ত্রপাতি আনা হোক না কেন, তার বিক্রয়োত্তর সেবা, খুচরা যন্ত্রাংশের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। মন্ত্রী আরও বলেন, গ্রামের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন কৃষির উন্নয়ন এবং কৃষিভিত্তিক শিল্পের উন্নয়ন। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের টেকসই রূপদানের মাধ্যমে সম্ভাবনাময় এই দেশে কৃষিভিত্তিক টেকসই শিল্পোন্নয়নের প্রসার ঘটানো সম্ভব বলে বিশ্বাস করি।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে কৃষি খাতকে সচল রাখতে এবং করোনা–পরবর্তী খাদ্যসংকট মোকাবিলায় সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। ছবি: লেখক
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে কৃষি খাতকে সচল রাখতে এবং করোনা–পরবর্তী খাদ্যসংকট মোকাবিলায় সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। ছবি: লেখক

কৃষির আধুনিকায়ন চলমান। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব। প্রতিনিয়ত বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে। পাশাপাশি তা সংযোজিত হচ্ছে কৃষি উন্নয়নে। কৃষি ও কৃষকের চাহিদাগুলো বিবেচনা করে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশে কৃষি যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, উদ্ভাবন ও উন্নয়নকাজে নিয়োজিত গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কাজের সঙ্গে মাঠের কার্যকর যোগসূত্রের অভাব প্রতিনিয়তই পরলিক্ষিত হচ্ছে। কৃষি প্রকৌশলী তথা কৃষি প্রকৌশল বিভাগ—এই সেতুবন্ধের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে লাগসই কৃষিযন্ত্র কৃষক পর্যায়ে পৌঁছে দিতে পারবে—এটি আমার দৃঢ়বিশ্বাস।

সবশেষে বলব, করোনাকে ভয় নয়, সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমেই জয় করা সম্ভব। তেমনি আগামীর কৃষিকে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে লালন–পালন করে ভালোভাবে বাঁচিয়ে রাখতে পারলে, আমরা ভালোভাবে বেঁচে থাকব। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘এক ইঞ্চি জায়গাও খালি রাখা যাবে না।’ প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত এই বাণীকে বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন কৃষির উৎপাদন এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের সব ক্ষেত্রে টেকসই কৃষি যান্ত্রিকীকরণ। বিভিন্ন মেয়াদি এলাকাভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তার বাস্তবায়নে কৃষিযন্ত্রের যথাযথ ব্যবহারের জন্য কৃষি বিভাগে নিয়োজিত সব কৃষি প্রকৌশলীর গুরুত্ব দিয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে।

*লেখক: ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ফার্ম মেশিনারি অ্যান্ড পোস্ট হারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর