এক প্লেট ভাতের 'প্রজেক্ট-১০০'

ক্যাম্পাসে যাই না কতদিন!
মুক্তমঞ্চে বসি না কতদিন!
ক্যাফের চা খাইনা কতদিন!
সাহিত্য লাইব্রেরিতে পড়ি না কতদিন!
একসাথে আড্ডা দেই না কতদিন!

করোনার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় এই চিন্তাগুলো যখন সারাক্ষণ মাথায় ঘুরছে, তখন লকডাউনের কারণে কর্মহীন হয়ে বসে আছে দেশের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী। দিনে এনে দিনে খাওয়া এই মানুষগুলোর জন্যও কিছু করা দরকার। বন্ধু এস এম নাঈমুল হাসান সিলেটের শাহজালাল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেরকমই একটি বিষয় নিয়ে কাজ করছেন জানতে পারলাম। নাঈমুলের 'প্রোজেক্ট-৬০' তখন ইতোমধ্যেই কাজ করছে সুবিধাবঞ্চিত বেদে সম্প্রদায়ের জন্য।

তারই অনুপ্রেরণায় অল্প কিছুদিনের মধ্যেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে যাত্রা শুরু করা হলো 'প্রোজেক্ট-১০০'। আমার সাথে যোগ দেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের আরও কিছু স্বপ্নবাজ তরূণ-তরূণী, যাদের মধ্যে নুজহাত তাবাসসুম উর্বি, মাহির শাহরিয়ার নবীন, রাফিদ ফারহানাসহ অনেকে। ফাইনাল প্রফের পর তখন হাতে অফুরন্ত সময়। পুরো ব্যাপারটা শুনে সাথে আরও জুটে গেল সবচেয়ে জুনিয়র সদস্য তৃতীয় বর্ষের সাকিব হোসেন তন্ময়।

ক্যাম্পাসকে ভীষণভাবে মিস করতে থাকা মানুষগুলোকে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে ক্যম্পাস থেকে ঘুরিয়ে আনাই ছিল লক্ষ্য। আর এই ভার্চুয়াল ক্যাম্পাস ভ্রমণে যুক্ত হতে দিতে হবে শুভেচ্ছামূল্য এক প্লেট ভাত! মানে একশ টাকা। এই হল ক্যাম্পাস ভিত্তিক আড্ডার প্লাটফর্ম প্রোজেক্ট ১০০'র মূলমন্ত্র। রথ দেখা আর কলা বেচা একসাথে বলা যায়। ক্যাম্পাসে থাকাকালীন যেসব বিষয় নিয়ে বন্ধুবান্ধব কিংবা সিনিয়র জুনিয়রে আড্ডা হত, জুম এপের ভার্চুয়াল ক্যাম্পাসেও আড্ডা হবে সেসব নিয়ে। আর আড্ডা দিতে দিতে এক প্লেট ভাত পৌঁছে যাবে লকডাউনে কর্মহীন মানুষগুলোর কাছে।

'আমার ক্যাম্পাস' নামের প্রোজেক্ট ১০০র প্রথম পর্বে অংশ নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা যেন ফিরে গেলেন পৃথিবীর সুস্থ সময়টাতে। ক্যাম্পাস নিয়ে সবার ভাবনা জানা গেল। কেমন মিস করছেন ক্যাম্পাসকে শোনা হল সেই গল্প। প্রথম এপিসোডে সবার আগ্রহ দেখে প্রোজেক্ট ১০০ পেল নতুন গতি। একে একে ক্যারিয়ার, গান, ডিবেট, ফুটবল, রিসার্চ, ট্রাভেলিং, সাহিত্য ছাড়াও আড্ডা হল আরো নানান বিষয়ে। প্রতি পর্বেই অতিথি শ্রোতা সবার ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছে প্রোজেক্ট ১০০। আড্ডা হয়েছে ক্যাম্পাসের ডেন্টিস্টদের সাথে, আড্ডা হয়েছে চমেকের বিদেশী ছাত্রছাত্রীদের সাথেও। ক্যাম্পাসের প্রতিটি কোণ স্পর্শ করার চেষ্টা করেছে প্রোজেক্ট ১০০। চমেক ক্যাম্পাসের মানুষগুলোও মন উজাড় করে সাহায্য করেছে প্রোজেক্ট ১০০ কে। ১০০ টাকা শুভেচ্ছা মূল্য হলেও ৮৬০০ টাকা পর্যন্ত পাঠিয়েছেন কেউ কেউ। বিনিময়ে আড্ডা দিয়েছেন ক্যাম্পাসের সিনিয়র জুনিয়র সবাই মিলে।

প্রোজেক্টের সঞ্চালক নুজহাত তাবাসসুম উর্বি বললেন, করোনাকালীন সময়ে সবাই যখন মানসিকভাবে খুবই বিধ্বস্ত, মেডিকেল ছাত্রছাত্রী বা ডাক্তাররা তখন আরও বেশি ঝুঁকিতে। আমরা প্রোজেক্ট ১০০ দিয়ে ক্যাম্পাসের এই প্রিয় মানুষগুলোর মুখে একটু হাসি ফিরিয়ে দিতে চেয়েছি। কিছুক্ষণের জন্য করোনাকে ভুলে নিজেকে সময় দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছি।

আরেক সঞ্চালক রাফিদ ফারহানা জানালেন, এতো বিষয় নিয়ে এতো মানুষের সাথে আড্ডা হচ্ছে, আমরা নিজেরাও নতুন অনেক কিছু শিখছি প্রতিদিন। এই প্ল্যাটফর্মটা না থাকলে আসলে এই মানুষগুলোর সাথে এভাবে কথা বলার সু্যোগই হত না।

সাকিব হোসেন তন্ময় মূলত কাজ করে যান আড়ালেই, পোস্টার ডিজাইন থেকে শুরু করে টেকনিকাল বিষয়গুলো দেখেন তিনি। আরেক উদ্যোক্তা মাহির জানালেন, আড্ডা ভিত্তিক এই কার্যক্রম থেকে আমরা প্রায় নব্বই হাজার টাকা তুলতে পেরেছি। যার বেশির ভাগই দিয়েছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

প্রোজেক্ট ১০০ এর মাধ্যমে এই পর্যন্ত তারা ১১টি পর্বের আড্ডায় পাওয়া অর্থ দিয়ে সারাদেশে সাত দফায় ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়। ত্রাণ পৌঁছে গেছে নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, পাবনা, নোয়াখালীসহ রাজশাহীতে অবহেলিত মুন্ডা সম্প্রদায় এবং রাঙামাটির ক্ষারাখ্যং এ চাকমা সম্প্রদায়ের কাছেও। সাহায্য পেয়েছে ১৫৯ টি পরিবার। ৬শ'র বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে তাদের এক প্লেট ভাত! যা দিয়ে সাত দিন অন্তত চলতে পারবে পরিবারগুলো।

এখনই থামতে চান না উদ্যোক্তারা। যতদিন সম্ভব দাঁড়াতে চান মানুষের পাশে জানালেন এমনটাই। সেই সাথে ক্যাম্পাসটাকেও নিয়ে যেতে চান ক্যাম্পাসের মানুষদের কাছে। এই বিতরণে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে মেডিকেল ও ডেন্টাল শিক্ষার্থীদের আরেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সন্ধানীর ক্র‍্যাক প্লাটুন ভলান্টিয়ার টিমগুলো। শুভেচ্ছা নিয়ে তারা পৌঁছে গেছে অসহায় মানুষের দ্বারে দ্বারে।

প্রোজেক্ট ১০০ সম্পর্কে আরও জানতে ঘুরে আসতে পারেন ফেসবুক পেজ থেকে- https://www.facebook.com/প্রজেক্ট-১০০-Project-100-112255283869940/

*শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ