করোনায় বিপর্যস্ত পৃথিবী: কেমন হবে ভবিষ্যৎ শিক্ষা

‘আমার শেখার ক্ষেত্রে অন্তরায় একমাত্র জিনিসটি হলো আমার শিক্ষা’, উক্তিটি বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের। যিনি ১৫ বছর বয়সে স্কুল ড্রপআউট হন, প্রচলিত বা গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থাকে অপছন্দ করতেন।

১৬৬৫ সালে সমগ্র ইউরোপে যখন বেবুনিক প্লেগের বিস্তার ঘটে তখন নিউটন ট্রিনিটি কলেজের ছাত্র। কলেজটি মহামারির কবলে পড়ে বন্ধ হয়ে যায়। তখনকার সময়েও আজকের দিনের মতো এমন লকডাউন জারি করা হয়েছিল আর এই লকডাউনেই বাড়িতে আটকে থাকা অবস্থায় নিউটন তাঁর বিখ্যাত মহাকর্ষ সূত্রটি আবিষ্কার করেছিলেন, যা বিশ্বকে চিরতরে বদলে দিয়েছিল। মহামারি সময়ে ‘সামাজিক দূরত্বের’ ওই সময়কে পরবর্তীকালে নিউটন ‘অবিস্মরণীয় বছর’ হিসেবে উল্লেখ করেন।

মাইকেল ফ্যারাডে শ্রমজীবী ​​শ্রেণির জন্য সামাজিক ‘ভালাই’ প্রোগ্রামগুলোর অংশ হিসেবে খ্যাতিমান বিজ্ঞানীদের বিনা মূল্যে দেওয়া বক্তৃতাগুলোতে নিয়মিত উপস্থিত হতেন। আর এর মধ্য দিয়েই তিনি তাঁর মেন্টর হাম্ফ্রে ডেভির সাক্ষাৎ এবং পরবর্তী সময়ে তাঁর সঙ্গে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। আমরা এখন যে বিদ্যুৎ সুবিধা ভোগ করছি, তা মূলত মাইকেল ফ্যারাডেরই আবিষ্কার।

ফলে দেখা যাচ্ছে, কাঠামোগত পরিবেশের বাইরে গিয়ে ‘চিন্তাভাবনা’ এবং ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা’ তাঁদের ক্ষেত্রে ‘যুগান্তকারী’ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে এবং বিজ্ঞানের চেহারা বদলে দিয়েছে।

অতি সম্প্রতি সার্স ভাইরাস পৃথিবীতে আঘাত হানার ফলে অনেক দেশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। যেটা আফ্রিকায় ইবোলা বিস্তারেও একই পরিণতি ডেকে এনেছিল। বলা হচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সারা বিশ্বের অনেক দেশে স্কুল এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একই সময়ে এবং একই কারণে এভাবে লকডাউনে যেতে দেখেনি।

ইউনেসকোর তথ্যসূত্র অনুযায়ী, বিশ্বের ১৯০টি দেশের ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন (৯০ শতাংশ) শিক্ষার্থী এখন গৃহবন্দী। ফলে সশরীরে ক্লাসে গিয়ে শিক্ষা অর্জনের পথ রুদ্ধ। এমতাবস্থায় ভাইরাস সংক্রমণের সেকেন্ডে ওয়েভ যদি ছড়িয়ে পড়ে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেটি বৈশ্বিক শিক্ষাব্যবস্থা অনলাইননির্ভর হয়ে ওঠার নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করবে। কারণ, সংক্রমণ রোধে আরও বেশি দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হবে।

বহু বছর ধরে বিশেষজ্ঞরা ডিজিটাল শিক্ষা বাস্তবায়নের ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করে আসছিলেন। কিন্তু প্রক্রিয়াটি ছিল একই সঙ্গে ধীর এবং হতাশজনক। ফলে প্রথা ভেঙে শিক্ষক–শিক্ষার্থীরা নতুন শিক্ষাপদ্ধতি গ্রহণ করতে দ্বিধান্বিত ছিলেন। কিন্তু বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির বিস্তার ওই প্রক্রিয়াতে কার্যত ‘আগুনে ঘি ঢেলেছে’। দেশের পর দেশ যখন করোনার মোকাবিলায় লকডাউনকেই একমাত্র পন্থা হিসেবে বেছে নিচ্ছে, তখন ইন্টারনেটভিত্তিক শিক্ষাই একমাত্র উপায় হিসেবেই পরিগণিত হয়েছে।

গুরুমুখী শিক্ষা বা স্কুল–কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের কাছে গিয়ে শিক্ষা অর্জন করাটাই প্রচলিত প্রথা। কিন্তু লকডাউনের কবলে পড়ে সে প্রথা আজ ভাঙতে হয়েছে। শতাব্দীপ্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, লেকচারভিত্তিক শিক্ষণপ্রক্রিয়া, প্রোথিত প্রাতিষ্ঠানিক পক্ষপাত এবং সেকেলে ক্লাসরুম ব্যবস্থা শোচনীয় এবং দুঃখজনক। আধুনিক বিজ্ঞান বা প্রযুক্তির ক্রমবিকাশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে শিক্ষাক্ষেত্রে যে পরিবর্তন আনা জরুরি, সেটা কোভিড-১৯ ‘চোখে আঙুল দিয়ে’ দেখিয়ে দিল (অনেকটা শক্তিশালী দেশের স্বাস্থ্যক্ষেত্রে দুর্বলতা দেখিয়ে দেওয়ার মতোই!)। ফলে বিশেষজ্ঞ কিংবা নীতিনির্ধারকদের তুলনামূলক কম সময়ের মধ্যে এই পরিবর্তনের ওপর বিভিন্ন বিষয় ভাবতে হচ্ছে।

শিক্ষাকে প্রভাবিত করে এমন দ্বৈত ফ্যাক্টর ব্যয়বহুল আধুনিক প্রযুক্তি এবং এর নেতিবাচকতা ব্যতিরেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা প্রথা ভেঙে নতুন শিক্ষাপদ্ধতি বা পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে?

সময় যত গড়াবে, ততই সবকিছু স্পষ্ট হবে। এখানে আমাদের আলোচনার বিষয় কোভিড-১৯ কীভাবে শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে বাধ্য করছে। যদিও এই মহামারি শিক্ষার্থীদের যথেষ্ট ক্ষতি সহ্য করতে বাধ্য করেছে, তা–ও শিক্ষাব্যবস্থায় এই রূপান্তরের কিছু ব্যবহারিক সুবিধা আমরা অস্বীকার করতে পারি না। আমাদের মতো দেশে ইন্টারনেটের লভ্যতা নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন থেকেই যায়। এখনো একটি বড় অংশের কাছে এ সুবিধা নেই। তাই অনলাইন শিক্ষার সুবিধা তারা নিতে পারে না। যদিও অনেকের কাছে এখন মুঠোফোন আছে, তবু অনলাইননির্ভর শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য যে পরিকাঠামো প্রয়োজন, সেই পরিকাঠামো চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। তবে এটাও সত্যি যে যদি কোভিড-১৯ আমাদের আক্রমণ না করত, তাহলে অনলাইন শিক্ষা একটা অলীক স্বপ্ন হয়েই থেকে যেত।

নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক অর্জুন আপ্পাদুরাই এই সংকট সময়কে সমাজের জন্য একদিক দিয়ে ‘সম্ভাবনা’ বলে মন্তব্য করেছেন। করোনাকালের সংকটে আজকের নেতিবাচক পরিপ্রেক্ষিতও যদি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এরূপ কোনো ইতিবাচক অভিমুখ খুলে দেয়, তাতে মন্দ কী? অতএব দেখে নেওয়া যাক পরিবর্তনগুলো।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করোনার কারণে বন্ধ হওয়ায় এখন আর মুখোমুখি বা সশরীরে শ্রেণিকক্ষে গিয়ে অধ্যয়ন করার বাস্তবতা নেই। শিক্ষার্থীরা যাতে পড়াশোনা চালু রাখতে পারে, সে জন্য ওই ব্যবস্থা অনলাইনে প্রতিস্থাপিত হয়েছে, অর্থাৎ ক্লাসরুমে যেমন শিক্ষক এবং ছাত্ররা একে অন্যকে দেখতে পায়, ঠিক তেমনই জুম, গুগল ক্লাসরুম, গুগল হ্যাংআউটস, ওয়েবএক্স বা এই ধরনের ভিডিও কনফারেন্সিং সফটওয়্যারগুলোর মাধ্যমে শিক্ষক ইন্টারনেটের সাহায্যে ছাত্রদের দেখতে পান এবং ছাত্ররা শিক্ষককে।

এই অনলাইননির্ভর শিক্ষার ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে সহজে সংরক্ষণ। শিক্ষক তাঁর লেকচার অনলাইন ক্যামেরা দিয়ে রেকর্ড করতে পারেন। শিক্ষা সহায়ক উপকরণ (যেমন নোটস) এখন কাগজের পাতায় সীমাবদ্ধ নেই। পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন, পিডিএফ, স্লাইডশেয়ার কিংবা ইউটিউব লিংকের মাধ্যমে সেগুলা ইন্টারনেটে সংরক্ষণ করতে পারছেন। ফলে শিক্ষার্থীরা নিজেদের সময়–সুযোগ অনুযায়ী সেগুলো ব্যবহার করতে পারছে।

ইন্টারনেটে সংরক্ষণের ক্ষেত্রে গুগল ড্রাইভ কিংবা ড্রপবক্সের মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার হচ্ছে, যেগুলোতে শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থীরা ডেস্কটপ, ট্যাবলেট কিংবা স্মার্টফোনের মাধ্যমে সহজে প্রবেশ করতে পারে। উপস্থিতি রেকর্ড করার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে গুগল স্প্রেডশিট এবং গুগল ক্লাসরুম। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমেও উপস্থিতির রেকর্ড রাখা হচ্ছে। এখানে কোনো কারচুপির সুযোগ নেই। প্রশাসনিক কাজে সেটা ব্যবহার করা যায়। আসছে মূল্যায়নের পদ্ধতিতেও পরিবর্তন।

শিক্ষার্থীদের কাজের মূল্যায়ন

শিক্ষার অন্যতম প্রতীয়মান দিক হলো, বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে শিক্ষার্থীদের কাজের মূল্যায়ন করা। করোনার আবির্ভাবের ফলে দিকটি বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের কাজের মূল্যায়নের সবচেয়ে জনপ্রিয় দুটি পদ্ধতি হচ্ছে ইনডিভিজ্যুয়াল রেডিনেস অ্যাশিউরেন্স টেস্ট বা (iRAT) এবং টিম রেডিনেস অ্যাশিউরেন্স টেস্ট বা (tRAT)। সহজভাবে বলতে গেলে এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় শিক্ষার উপকরণ সরবরাহ করে নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর স্বতন্ত্র বা দলবদ্ধভাবে কাজ করতে দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট সময় পরে শিক্ষক ওই কাজের ওপর টেস্ট কিংবা কুইজ নিয়ে বিষয়টির ওপর মতামত দিয়ে থাকেন। এই পদ্ধতিকে এখন আধুনিকীকরণ করে বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, যেমন গুগল ক্লাসরুম, জুম, মুডল, হোয়াটসঅ্যাপে ব্যবহৃত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ মিসরের হেলবান বিশ্ববিদ্যালয় জুমের ‘Breakout Room’ ফিচার ব্যবহার করে উক্ত পদ্ধতির মাধ্যমে সহজে শিক্ষার্থীদের কাজের মূল্যায়ন করছে। হেলবান বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও মিসরের আরও কিছু বিশ্ববিদ্যালয় কৌশলটি ফলপ্রসূ বলেই মনে করছে। খাদ্য, বস্ত্র কিংবা বাসস্থানের মতোই ইন্টারনেট সময়ের পরিবর্তনে মৌলিক মানবাধিকারে পরিণত হবে। একইভাবে তথ্য আমাদের প্রথমিক প্রয়োজনে পরিণত হবে। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে ইন্টারনেট অপরিহার্য হয়ে উঠবে। শিক্ষাক্ষেত্র এখন ইন্টারনেট ছাড়া বিকল। মহামারির এই বর্তমান পরিস্থিতিতে ইস্তাম্বুলের বিলগি ইউনিভার্সিটি যথার্থই মন্তব্য করেছে, শিক্ষাক্ষেত্রে আধুনিকীকরণ এখন আর ‘বিকল্প’ কোনো কিছুই নয়, এটি এখন বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। সুতরাং এই অস্বাভাবিক সময়ে শিক্ষার চাকা সচল রাখতে ইন্টারনেটের ভূমিকা অপরিসীম।

দক্ষতানির্ভর শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। যে শিক্ষা দক্ষতা প্রদান করে না, সে শিক্ষা ক্রমান্বয়ে গুরুত্ব হারাবে। ফলে কাগুজে ডিগ্রিসর্বস্ব শিক্ষার দিন ফুরিয়ে এসেছে। প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল এই বৈশ্বিক পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর দক্ষতা এবং কঠিন অবস্থা থেকে দৃঢ়ভবে ফিরে আসার গুণাবলি তরুণ প্রজন্মের জন্য যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ, সেটি মহামারি স্পষ্টই জানিয়ে দিচ্ছে।

করোনা–পরবর্তী বিশ্বে কর্মক্ষেত্র নিয়োগকর্তারা অন্যান্য দক্ষতার পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি যে দক্ষতাগুলো সন্ধান করবেন সেগুলো হলো সৃজনশীলতা, যোগাযোগের দক্ষতা,আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা, পারস্পরিক সহযোগিতা এবং দলগতভাবে কাজ করার দক্ষতা। এর আরও একটি কারণ হতে পারে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো করোনার কারণে সৃষ্ট ক্ষতি খুব দ্রুতই পূরণ করতে চাইবে এবং পরবর্তী সময়ে এ ধরনের যেকোনো পরিস্থিতি সহজে মোকাবিলায় দক্ষ জনবল নিয়োগ তাদের জন্য একান্ত অপরিহার্য হয়ে পড়বে।

অতএব ভবিষ্যৎ শিক্ষাব্যবস্থা তথ্যভিত্তিক শিক্ষার গণ্ডি থেকে বের হয়ে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বিকাশে সাহায্য করবে। ভবিষ্যতে পরীক্ষার প্রশ্নগুলো বিশ্লেষণাত্মক হবে এবং মুখস্থবিদ্যা আর কোনো কাজে আসবে না।

করোনা–পরবর্তী সময়ে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে শিক্ষকের ভূমিকা নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করবে। একজন শিক্ষক যিনি জ্ঞানের ধারক ও বাহক, যিনি শিক্ষার্থীদের শিখিয়ে থাকেন বা জ্ঞান দান করে থাকেন, এটাই প্রতীতি। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশে এ ধারণা আর উপযুক্ত নয় বলে বলছিলেন কোপেনহেগেন ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের শিক্ষক স্যান্ডি ম্যাকেঞ্জি এবং ট্যালেন্টএডের (TalentED) প্রতিষ্ঠাতা পূর্ণিমা লুথ্রা।

ভবিষ্যৎ শিক্ষাব্যবস্থায় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে শিক্ষকদের ভাবতে হবে। কারণ, এটি শিক্ষার আনুষঙ্গিক অংশে পরিণত হবে। ভবিষ্যতে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের দক্ষতায় পরিবর্তন আসবে।

করোনা–পরবর্তী দূরশিক্ষণ বিপ্লব ঘটাতে চলেছে। শিক্ষার্থীরা বাড়িতে বসেই অভিনব পন্থা ব্যবহার করে পড়াশোনা এবং ভবিষ্যতে কাজ, দুটিই চালিয়ে নেওয়ার সুযোগ পাবে। ফলে আমরা ক্যাম্পাস থেকে ক্যাম্পাসহীন পরিবেশের দিকে এগিয়ে যাব। শীর্ষস্থানীয় অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য দূরশিক্ষণব্যবস্থার বিকাশ ঘটাচ্ছে। যেমন হার্ভার্ড সামার স্কুল প্রোগ্রামে সব কোর্স এখন অনলাইনে পড়ানো হচ্ছে। শিক্ষাদান, প্রশিক্ষণ—সবই এখন অনলাইননির্ভর হয়ে উঠবে। তার কারণ, আংশিকভাবে বলা যায় ক্যাম্পাস শিক্ষার উচ্চ মূল্যে। পিউ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের করা গবেষণায় এরূপ মন্তব্য করেছেন টেকনোলজি এলএলসির প্রেসিডেন্ট।

অনলাইনে যাবতীয় সেমিনার, আলোচনা সভার মাধ্যমে জ্ঞানচর্চার সুযোগ তৈরি হবে। যেটাকে ওয়েবিনার বলা হয়। আমরা দেখেছি, বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে সমাবর্তন অনুষ্ঠান পালন করেছে। উল্লেখ্য, শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে স্থান–কাল গৌণ হয়ে উঠবে।

বাড়বে অনলাইন কোর্সের জনপ্রিয়তা

অনলাইন কোর্সের জনপ্রিয়তা তুলনামূলকভাবে বেড়ে যাবে। অনলাইন কোর্স দ্রুত প্রসার লাভ করবে, এর এমন একটি উদাহরণ হলো কোর্সেরা (অনলাইনভিত্তিক কোর্স করার প্ল্যাটফর্ম)। সিএনবিসির তথ্য অনুযায়ী, কোভিড-১৯–এর প্রসার ঘটলে মার্চ মাসে মাঝের দিকে কোর্সেরাতে আগের তুলনায় ২৫ লাখ শিক্ষার্থী কোর্স করতে আবেদন জানায়। সংখ্যার হিসাবে সেটা গত বছরের তুলনায় ৫২২ শতাংশ বেশি। অন্যান্য অনলাইন কোর্স সাইটেও ব্যবহারকারী একইভাবে বেড়ে চলেছে।

গবেষণা বলছে, ২০২৫ সাল নাগাদ অনলাইন কোর্স ব্যবসার বাজারদর ৩৫০ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে পৌঁছাবে। এসব সাইট ব্যবহারকারীরা নির্দিষ্ট কোর্স সম্পন্ন করার পরে সার্টিফিকেট পেয়ে থাকেন। চাকরির ক্ষেত্রে এসব কোর্স সার্টিফিকেটের কদর বাড়বে।

কোভিড-১৯ শিক্ষার ক্ষেত্রে সাধারণ লক্ষ্য বাস্তবায়নে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের পথ প্রশস্ত করেছে। যেমনটা চীনে লক্ষ করা যায়, সেখানে শিক্ষার্থীরা বাড়িতে বসে যাতে পড়াশোনা নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতে পারে, সে জন্য সরকার দূরশিক্ষণব্যবস্থার উদ্যোগ নেয়। এ কাজে কম খরচে ইন্টারনেট প্রদান করার শর্তে সরকারের সঙ্গে বেসরকারি কোম্পানিগুলো এগিয়ে আসে। উন্নয়নশীল দেশে সবার ক্ষেত্রে শিক্ষার সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে বা শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি কোম্পানিগুলো এভাবে এগিয়ে আসতে পারে।

করোনা–পরবর্তী সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের গুরুত্ব বাড়বে। শিক্ষক–শিক্ষার্থীরা ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ইত্যাদি ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখবে। মূল্যভিত্তিক শিক্ষাই হবে করোনা–পরবর্তী সময়ের শিক্ষাব্যবস্থা। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে এ পরিবর্তন দীর্ঘস্থায়ী হতে চলেছে।

আইই বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক এনরিকে ডানস মনে করেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যাতে এই পরিবর্তনে নিজেদের উপযোগী করতে পারে, সে জন্য বিভিন্ন পথ অবলম্বন করতে হবে। তিনি বলেন, ‘শিক্ষাক্ষেত্রে এটি পরবর্তী ধাপ হতে যাচ্ছে। অনেকেই ভাবছেন, বর্তমান সময়টা একটু ব্যতিক্রম, যেটা কোয়ারেন্টিনের পরে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। এটা ভুল ধারণা। শিক্ষা খাত হলো অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ এবং মহামারির পরে অবশ্যই এখানে পরিবর্তন আসবে।

ভারতীয় শিক্ষাবিদ উজ্জ্বল চৌধুরী এবং সুনয়ন ভট্টাচার্য শিক্ষাক্ষেত্রে এরূপ পরিবর্তনের ব্যাপারে বলেছেন, ‘অনেকেই মনে করছেন করোনা থেকে মুক্তির পর আবার আমরা পুরোনো শিক্ষাপদ্ধতি অবলম্বন করতে পারব, তাহলে তাঁরা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন। শিক্ষা চিরতরে পাল্টাচ্ছে এবং যাঁরা এই বদলের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারবেন না, তাঁরা নিজেরাই কার্যত ডাইনোসরের মতো বিলুপ্ত হয়ে যাবেন।’


*লেখক: আইন বিভাগ, দ্বিতীয় বর্ষ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]