বাংলার গণমানুষের গায়ক এন্ড্রু কিশোর

ঢাকা ক্লাবের ইফতার আয়োজনে এন্ড্রু কিশোর। ছবি: সংগৃহীত
ঢাকা ক্লাবের ইফতার আয়োজনে এন্ড্রু কিশোর। ছবি: সংগৃহীত

সূর্যোদয়ের পর কৃষক লাঙল নিয়ে মাঠে যান; দিন শেষে গোধূলিতে ফেরেন। কর্মক্লান্ত কৃষকের সারা দিনের বিনোদন, সারা দিনের সাথি একটি রেডিও। কৃষকের মনে আনন্দ দেয়, তাঁকে কাজে উদ্বেল করে রেডিওর গান। শুধু কৃষক কেন? শ্রমজীবী সব মানুষের বিনোদন রেডিওকে কেন্দ্র করেই ছিল।

বাংলাদেশ বেতারে অনুরোধের আসর ছিল একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। আমি আশি ও নব্বই দশকের কথা বলছি। কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোরকে দেখেননি, তারপরও তাঁর সঙ্গে শ্রোতাদের আত্মিক সম্পর্ক হয়েছে শুধু রেডিওতে তাঁর গান শুনে। তত্কালীন বেতারের পাশাপাশি আরও একটি মাধ্যম শক্তিশালী ছিল, তা হলো বাংলাদেশ টেলিভিশন, এটি একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির দর্শকদের হাতে ছিল। তখন পর্যন্ত টেলিভিশন গ্রাম পর্যন্ত খুব বেশি বিস্তার লাভ করেনি, স্যাটেলাইট বা ইউটিউবও কল্পনাতেও ছিল না। তাই, রেডিওতে শোনা অনেক শিল্পীর ভিড়ে এন্ড্রু কিশোরের গাওয়া ছায়াছবির গান সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের সাথিতে পরিণত হয়েছিল।
নাগরিক জীবনে কি এন্ড্রু কিশোরের গানের প্রভাব কম ছিল? বাংলাদেশের সিনেমার যে গানগুলো বেশি জনপ্রিয় হতো, তা ছাত্রছাত্রী তথা সবাইকেই আন্দোলিত করত। বাংলা সিনেমায় অনেক আধুনিক গান ব্যবহৃত হতো। তা ছাড়া এন্ড্রু কিশোর আধুনিক, দেশাত্মবোধক গানও গাইতেন। স্বল্পসংখ্যক উচ্চাভিলাষী-আলট্রামডার্ন মানুষ বিদেশি ভাষার গানের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন; তাঁদের বলছি, এন্ড্রু কিশোরের গানে মা, মাটি, মানুষের প্রতি ভালোবাসার গন্ধ রয়েছে।
প্লেব্যাক কিং এন্ড্রু কিশোর আধুনিক, বাংলা সিনেমার গানে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করলেও রবীন্দ্র-নজরুলও গাইতেন ছাত্রজীবনে। তাঁর মতো জীবন-মৃত্যু নিয়ে এত জনপ্রিয় বাংলা গান আর কেউ কি গেয়েছেন? তিনি রক ধাঁচের গান, রোমান্টিক-বিরহের গান গেয়েছেন সমানতালে! সব ধরনের, সব রুচির গান দিয়েই তিনি মন জয় করেছেন শ্রোতাদের। যখন ছোট ছিলাম, তখন বুঝতাম না; মনে হতো নায়ক সোহেল রানা, ওয়াসীম, আলমগীর, ফারুক, জাফর ইকবাল, জসিম, ইলিয়াস কাঞ্চন, রুবেল তাঁরা নিজেরাই সিনেমায় গান গাইছেন! নায়কের লিপের সঙ্গে গায়কের গান এভাবে মিলে যায়! তাঁর গাওয়া গান সিনেমাকে করেছে হিট-সুপার হিট; দর্শককে করেছে হলমুখী। যে নায়কের সঙ্গে তিনি প্লেব্যাক করেছেন, তাঁর সঙ্গেই মানিয়ে গেছেন।
কপিরাইট অফিসের ছোট ভাই খালেদ হোসেন চৌধুরীর অনুরোধে শিল্পকলা একাডেমিতে একটি সেমিনারে অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছিল। দাদার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হলো শিল্পকলা একাডেমিতে কপিরাইট বিষয়ক সেই সেমিনারেই। অনুষ্ঠান শেষ করে বক্তব্য দিচ্ছিলেন অতিরিক্ত সচিব মহোদয়; উপস্থিত এন্ড্রু কিশোরকে কথা বলতে না দিয়েই! এতে আমাদের আপত্তি ছিল, আমরা বললাম, এখানে উপস্থিত আছেন কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোর ও প্রখ্যাত সুরকার আলাউদ্দীন আলী। আমরা তাঁদের কাছে কপিরাইট বিষয়ে কিছু কথা শুনতে চাই। সবাই অনেক অনুরোধ করার পর তাঁরা দুজন কথা বলার সুযোগ পেলেন। সেখানে কথা বললেন এন্ড্রু কিশোর; তিনি গানের রয়্যালটি নিয়ে কথা বলেছিলেন। তিনি বলেন, যদি গানের গীতিকার-সংগীত পরিচালক-সুরকার-কণ্ঠশিল্পী গানের রয়্যালটি ঠিকমতো পান, তবে তাঁদের কেউ একজন অসুস্থ হলে চিকিৎসার জন্য অপরের দ্বারস্থ হওয়া লাগবে না। ওই রয়্যালটি থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়েই সে বহুবার ট্রিটমেন্ট করতে পারবে। এ প্রসঙ্গে তিনি আমাদের দেশের বিভিন্ন ফোন কোম্পানি এবং এফএম রেডিওর কথা উল্লেখ করেছিলেন। আমরা দাদার কথার বাস্তবতাও পেলাম। কিন্তু রয়্যালটির বিষয়ে সমাধান হলো কি না বোঝা গেল না!
এরপর দাদার সঙ্গে আরও দেখা হয়েছে ঢাকা ক্লাবে রাজশাহী ইউনিভার্সিটি সেন্ট্রাল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের ইফতার পার্টিতে। আমি বলেছিলাম, দাদা, আমি আপনার বৃহত্তর রাজশাহীর নাটোরের ছেলে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়েছি; দাদা খুব খুশি হলেন। আমরা একসঙ্গে ছবিও তুললাম। তারপর দাদার সাথে দেখা হয়েছে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে; এটাই দাদার সঙ্গে সম্ভবত শেষ দেখা। একজন বড় তারকা যে কত সহজে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতে পারেন, তাঁকে না দেখলে তা অনুধাবন করতে পারতাম না। রাবিতে কোনো কনসার্ট হলে তিনি অবলীলায় রাজশাহী চলে যেতেন। আমি ছাত্র থাকাকালীন রাজশাহীতেও তাঁর কনসার্ট দেখেছি।

শিল্পকলা একাডেমিতে সেমিনারের পর এন্ড্রু কিশোরের সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত
শিল্পকলা একাডেমিতে সেমিনারের পর এন্ড্রু কিশোরের সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত


রাজশাহীতে জন্ম নেওয়া এন্ড্রু কিশোর প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান মহিউদ্দিন পরিচালিত ‘বড় ভালো লোক ছিল’ সিনেমায় ‘হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস...’ গানটি গেয়ে। তারপর তিনি একে একে আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অন্যান্য পুরস্কারও লাভ করেন। বাংলাদেশের প্লেব্যাকে যখন মাহমুদুন্নবী, বশির আহমেদ, আব্দুল জব্বার, সুবীর নন্দী, সৈয়দ আব্দুল হাদী, খুরশীদ আলমদের জয়জয়াকার, ঠিক তখনই সত্তরের দশকের শেষে সংগীত পরিচালক আলম খানের হাত ধরে এন্ড্রু কিশোরের আগমন। আলম খান-এন্ড্রু কিশোর জুটি বাংলা সিনেমায় অনেক হিট গান উপহার দেন।
নান্দনিক সুরকার আলম খান শিল্পী এন্ড্রু কিশোর সম্পর্কে বলেন যে এন্ড্রু কিশোর ঈশ্বর প্রদত্ত মেধা পেয়েছেন এবং সে সজ্ঞীতের চর্চাও করেছে বেশ। এন্ড্রু কিশোর আলম খানের মাধ্যমে প্লেব্যাকে এলেও সত্য সাহা, শেখ সাদী খান, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, আবু তাহের, আলাউদ্দীন আলীসহ নবীন-প্রবীণ অনেক গুণী সংগীত পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করেছেন। তাঁর গানের গলা চলচ্চিত্রের জন্যই সৃষ্টি বলে অনেকে অভিহিত করেছেন।
ক্ষণজন্মা এই কণ্ঠশিল্পী বাংলা গান ও অন্যান্য ভাষার গান মিলে মোট ১৫ হাজারের বেশি গান গেয়েছেন। প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ রাহুল ডি বর্মনের কাছে বলিউডে গানের ক্যারিয়ার গড়ার প্রস্তাব পেয়েও এন্ড্রু কিশোর তা প্রত্যাখ্যান করেন। এটি তাঁর দেশপ্রেমের প্রকাশ নয় কি? রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যানেজমেন্ট বিভাগে লেখাপড়া করা কিশোর দাদা চার দশকের বেশি সময় ধরে জনপ্রিয় ছিলেন। এই শিল্পী শেষ পর্যন্ত মরণব্যাধি ক্যানসারের কাছে হেরে গেলেন। আমরা আশা করেছিলাম তিনি ক্যানসারজয়ী হয়ে আবার আসবেন আমাদের মাঝে; মেলে ধরবেন গানের ডানা। কিন্তু কোথা থেকে কী হয়ে গেল! তাঁর গান যেন আমার মনেরই কথা! ভরাট কণ্ঠের গায়ক এন্ড্রু কিশোরের সঙ্গে গানের একটা আত্মিক সম্পর্ক ছিল। তাই তো তাঁর গানে এত দরদ! গান দিয়ে এন্ড্রু কিশোর কত মানুষকে জাদু করেছেন, তিনি নিজে কি জানতেন? তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের গান পরিবেশন করে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন।
এন্ড্রু কিশোরের গান শোনেননি এমন মানুষ বাংলাদেশে খুবই কম পাওয়া যাবে। বাংলাদেশের এমন কোনো হোটেল-রেস্তোরাঁ নেই, যেখানে এন্ড্রু কিশোরের গান বাজেনি। নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-তরুণ সবার কাছে প্রিয় কিশোর দাদার গান। একজন সংগীতশিল্পীর জীবনে এর চেয়ে বড় অর্জন আর কী হতে পারে?
কিশোর দাদার অনুপস্থিতি বাংলাদেশের চলচিত্রের সংগীতে অপূরণীয় হয়ে থাকবে। এক অচিন দেশের পথে যাত্রা শুরু হলো চিরচেনা এই গুণী শিল্পীর। তিনি গান গেয়েছেন গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের জন্য। তাই তো আজ বাংলার আকাশ-বাতাস শোকে স্তব্ধ! নিভৃতচারী, কালজয়ী এই কণ্ঠশিল্পী আমাদের জাতীয় সম্পদ। তিনি আজ আমাদের মাঝে না থাকলেও কর্মের ভেতরই হাজার বছর বেঁচে থাকবেন একজন দেশপ্রেমিক কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোর হয়ে। রাজশাহীতে তিনি ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চুর নামে গানের স্কুল গড়েছেন। দুস্থ শিল্পীদের বিপদে পাশে থেকেছেন নিয়মিত। অগণিত সালাম, ভালোবাসা আর বিনম্র শ্রদ্ধা রইল প্রিয় কণ্ঠশিল্পী, প্রিয় মানুষটির প্রতি।

লেখক: গল্পকার ও কবি