ভাবনায় পরিশুদ্ধতা, কর্মে উৎপাদনশীলতা হোক শিশুর কর্মযজ্ঞতা

শিক্ষাঙ্গন থেকেই শুরু হোক শিশুর সমৃদ্ধির পথে যাত্রা। এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে আমাদের দেশের আগামীর শিশু পরিণত হোক মানবসম্পদে। আমাদের দেশে একটি শিশু জন্মের পর তার প্রথম পাঠশালা হয়ে থাকে তার পরিবার। তাই পরিবারের মানুষগুলোর সুস্থ ও মানবিক দিক একজন শিশুকে ভালো মানুষে পরিণত করে তার অদূর ভবিষ্যতে। পরিবারের মানুষের চিন্তা, চেতনা, ভাবনা একজন শিশুর মনে ভালো মানুষ হওয়ার বীজ বুনে দেয় জন্ম-জন্মান্তরের জন্য। এরপর সেই শিশুর জীবনে তার বড় পাঠশালা হয়ে ওঠে শিক্ষাঙ্গন, আমি যাকে বলি মেটাফিজিকস অর্থাৎ আসুন, চলুন, দেখি, রংধনুর শেষটা কোথায়?

পরিবারের আদর্শ, শিক্ষা আর সভ্যতার পাখায় ভর করে সে আরেকটি কারিগরের কারখানায় প্রবেশ করে, যেখানে তার পাশে ঢাল হয়ে থাকে একজন শিক্ষক। বাস্তবিকভাবে আমাদের দেশে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কটা এখনো পর্যন্ত চোর–পুলিশ খেলার মতো। অনেক সময় আমাদের ভাবগাম্ভীর্য, চেতনাদীপ্ত অথচ কর্কশ বচন ধীরে ধীরে শিশুর স্বাভাবিক বাকশক্তি কেড়ে নেয়। আমরা শিক্ষকেরা হয়তো এখনো শিক্ষার্থীদের ভাবাতে পারি না এ পৃথিবীতে তাদের প্রত্যাবর্তনের উদ্দেশ্য কী? এ সুন্দর পৃথিবীকে আরও সুন্দর করতে কী করতে হবে, তা না ভাবিয়ে আমরা তাদের মনের অজান্তে শিখিয়ে দেয়, যেভাবে পৃথিবীটা আছে তাকে সেভাবে রেখে কীভাবে তাকে শুধু ভোগ করা যায়।

বিখ্যাত ব্রিটিশ কবি ও শিল্পী উইলিয়াম ব্ল্যাক তার কবিতাগুচ্ছ ‘Songs of Innocence and Experience’–এ মানুষের জীবনের দুটি রূপ অর্থাৎ নীরহতা এবং অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলেছেন যে বিষয়টি এখানে একজন শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশের সঙ্গে তুলনা করা যায়। কবি তার লেখায় শিশুর সরলতার কথা বলেছেন, একজন শিশু যে কিনা জন্মের পর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সব ধরনের কলুষতার ঊর্ধ্বে থাকে, কিন্তু ধীরে ধীরে সে যখন বাস্তব জীবনে আসে, তখন তার মধ্যে স্বাভাবিক যে সরলতা, সে বিধাতা থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় নিয়ে এসেছিল তা হারিয়ে ফেলে। ‘Life of Experience’– এর নামে বাস্তবিকভাবে কিন্তু আমি, আমরা, আমাদের পরিবার, আমাদের সমাজ, ধ্যানধারণা, বিশ্বাস, লোভ ইত্যাদি দায়ী।

আমরা নিজ হাতে একজন শিশুকে অমানুষে পরিণত করি। যেমন একজন শিশু যখন জন্মগ্রহণ করে, তখন তাকে আমরা পরিবার থেকে জীবনবোধ অথবা ‘জীবন কী’ এই প্রশ্নটি মাথায় ঢুকিয়ে না দিয়ে বরং তাকে আমরা মনের অজান্তে স্বার্থপরের মতো তার জীবনের একটা উদ্দেশ্য ঠিক করে দেয়, যাকে আমরা ‘Aim in Life’ নামক রচনার মাধ্যমে সফলকামী একজন স্বার্থপর মানুষ হওয়ার বীজ বুনে দেওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ি। জীবনে তাকে কতটা সফল হতে হবে, এ ধরনের একটা প্রতিযোগিতা তার মধ্যে বপন করে দেয়, এতে আমরা ভুলে যায় যে আমার সন্তানটি সফলতার এই জুয়া খেলায় এক স্বার্থপর, নিষ্ঠুর ও নিকৃষ্ট এক আত্মার মানুষে পরিণত হচ্ছে ধীরে ধীরে। এটা অনেকটা তামাক ব্যবসার রঙিন বিজ্ঞাপনের মতো। যে বিজ্ঞাপনের একদিকে যেমন লেখা থাকে ‘cigarette is injurious to health’, তেমনি অন্যদিকে প্রশান্তিময় হৃদয়জুড়ানো আত্মা জয়ের তাগাদা থাকে। তাকে সফল ব্যক্তি হওয়ার মন্ত্র পড়াতে পড়াতে মানবিক হওয়ার মন্ত্র থেকে দূরে নিয়ে যাই আমরাই।

এখন প্রশ্ন হলো কারা আমাদের সন্তানদের এই দেশদ্রোহী হওয়ার মন্ত্র দিচ্ছেন? আমি, আপনি নয় তো? প্রকৃতপক্ষে এ দায়ভার আমাদের সবার। প্রথমে পরিবার, দ্বিতীয়ত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। আসুন, আমরা নিজেরা আগে বদলাই। আমরা নিজেরা জীবন কী তা নিয়ে ভাবতে শুরু করি, তবেই আমরা আমাদের আগামী দিন সুন্দর মানবসম্পদ পেতে পারি।

‘The Schoolboy' by William Blake’–এর কবিতার আলোকে যদি একজন শিশুর মনস্তাত্ত্বিক আবেদন বিশ্লেষণ করি, তবে দেখব একজন শিক্ষার্থী অনেক সময় তার শিক্ষাজীবনকে আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করতে পারে না। তার একমাত্র কারণ শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে সুসম্পর্কের অপ্রতুলতা। এটা আসলে কোনো শিক্ষকের নেতিবাচক দিক নয় বরং আমাদের সমাজে যেভাবে নিয়মতান্ত্রিকভাবে আমাদের পূর্ববর্তী শিক্ষকদের দেখে এসেছি তার ফল।

আমরা আসলে শিক্ষক রূপে অনেকটা ‘sage on the stage’ হিসেবে কাজ করি যেখানে আমাদের ‘referee in the field’ হিসেবে কাজ করার কথা। প্রকৃতির মাঝে, তার আশপাশের মানুষ, পরিস্থিতি, পরিবেশ, বিভিন্ন চরিত্রের মানুষ, দিনরাত্রির পালাবদল এগুলো থেকে একজন শিক্ষার্থী তার জীবনের সিদ্ধান্ত নিতে প্রস্তুত হতে পারে। আচ্ছা, শিক্ষক হিসেবে কি পাঠদানের সময় কখনো ভেবেছি আমাদের দেওয়া পাঠের মাধ্যমে সে পঠিত বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি নতুন কিছু আবিষ্কারের নেশায় মগ্ন কি না? তার মধ্যে জাগ্রত হওয়ার নেশা তৈরি করতে পেরেছি কি না? তার জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্য কী? হয়তো করি না, কারণ আমাদের সূচনা এবং উপসংহারে সমন্বয়হীনতা আছে।
আমরা মনের অজান্তে তাকে বিদ্যার বোঝা চাপিয়ে দিয়ে স্বার্থপর মহামানব বানানোর যন্ত্রে ঢুকিয়ে দেয়, যা পরবর্তী সময়ে তার নিজের আত্মসত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আমাদের মধ্যে থাকা শিক্ষিত মানুষগুলোকে আমার কাছে অনেকটা বিখ্যাত লেখক ক্রিস্টোফার মার্লোর লেখা একটি ইংরেজি নাটক, ‘The Tragical History of the Life and Death of Doctor Faustus’–এর প্রধান চরিত্র Doctor Faustus–এর মতো, যে কিনা অসম্ভব মেধা যেমন ধর্মশাস্ত্র, যুক্তিবিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র, আইনসহ জ্ঞানের প্রায় সব শাখায় বিচরণ সত্ত্বেও লোভ–লালসা থেকে নিজেকে ঊর্ধ্বে রাখতে পারেনি।

প্রচণ্ড উচ্চাকাঙ্ক্ষী আর ক্ষমতালোভী এই ব্যক্তি ডক্টর ফস্টাস চেয়েছেন এমন জ্ঞান অর্জন করতে, যার মাধ্যমে সে হয়ে উঠবে প্রবল ক্ষমতাশালী। প্রচলিত জ্ঞান অর্জনের একপর্যায়ে তার ধারণা হয়, ডাকিনী বিদ্যা ও কালো জাদু দ্বারাই তার ইচ্ছাপূরণ সম্ভব। তাই তিনি ডাকিনী বিদ্যা চর্চা শুরু করে এবং শয়তানের কাছে নিজের আত্মা বিক্রি করে ২৪ বছরের জন্য অতিমানবীয় ক্ষমতা অর্জন করে।

কিন্তু অর্জিত এই ক্ষমতা সে অতি তুচ্ছ কাজে ব্যয় করে এবং একসময় ২৪ বছর শেষ হয়ে যায়। জীবনের শেষ মুহূর্ত ডক্টর ফস্টাস প্রচণ্ড অস্থিরতা ও মানসিক অশান্তির মধ্যে কাটায়। ঘড়িতে রাত ১২টা বাজা মাত্র শয়তানের অনুচরেরা তাকে টেনেহিঁচড়ে নরকে নিয়ে যায়। ক্ষমতালোভী অথচ জ্ঞানী ফস্টাসের আর্তচিৎকার বজ্রকণ্ঠের মধ্যে চাপা পড়ে যায়। এ থেকে বোঝা যায়, শিক্ষা দীক্ষায় নয় বরং শিক্ষা হলো মননে।

এবার আসি শিক্ষার্থীর মানবিকতা চর্চায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আমাদের আসলে স্যানিটাইজার ব্যবহার করা, পায়ে স্যান্ডেল পরা—এগুলোকে এখনো আভিজাত্য ভেবে তাচ্ছিল্য করা হয়। আমরা এখনো পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন থাকাকে আভিজাত্যের একটা অংশ হিসেবে ভেবে থাকি। খাবার খাওয়ার আগে ও পরে ভালোভাবে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার ব্যবহার করা, ঘরে–বাইরে পায়ে স্যান্ডেল ব্যবহার করা, আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের যথাথত ব্যবহার ইত্যাদি সম্পর্কে সচেতন নই। আমরা চাইলেই কিছু শুদ্ধাচার যেমন Please, Thank you, My Pleasure, Excuse Me, Sorry, Nice to meet, May I, Lots of Love, Rest in Peace ইত্যাদি নিজেরা চর্চার মাধ্যমে আমাদের শিক্ষার্থীর পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অন্তত ব্যক্তিগতভাবে বিনম্র জাতি হিসেবে উপস্থাপন করতে পারি।

এবার আসুন, একটু ভেবে দেখি আমরা আমাদের চলার পথে কতটা মানবিক আর দায়িত্বশীল। অন্যভাবে বলতে পারি, নিজেদের পাশাপাশি আমরা সন্তানদের কতটা মানবিক আর দায়িত্বশীল করতে পেরেছি। আচ্ছা চলুন, নিজেকে নিজে একবার প্রশ্ন করে দেখি? আপনি নিজে রাস্তার আইল্যান্ড ধরে হাঁটার সময় পড়ে থাকা কলার খোসাটা তুলে ফেলেছেন কি?

আচ্ছা চলুন, ভেবে দেখি রাস্তা পারাপারে আমি, আপনি কি কখনো পদচারী–সেতু (ওভারব্রিজ) ব্যবহার করি কি না? নাকি ব্যস্ত রাস্তায় যন্ত্রদানবটিকে হাত দেখিয়ে দাঁড় করিয়ে নিজেকে খুব সচেতন বলে দেখানোর চেষ্টা করি?
এবার আসুন, ভেবে দেখি আমি আপনি কতটা সহযোগিতা, সহমর্মিতা, স্নেহ, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ইত্যাদি বোধ অর্জন করতে পেরেছি। আপনি মনে করে দেখুন তো? কখনো পেট পুরে পোলাও, কাচ্চি খেয়ে ঢেকুর তুলতে তুলতে কখনো ভেবেছেন কি না, আপনার প্রতিবেশীর ঘরে উনুন জ্বলেছে কি না?

সন্তানকে দামি খেলনাটা কিনে দেওয়ার সময় কখনো ভেবেছেন, পাড়ার গলিতে এমনও অনেক শিশু আছে যারা রিমোট হেলিকপ্টার দেখা তো দূরের কথা, মার্বেল খেলা আর এক্কা–দোক্কার ঘূর্ণিপাকে জীবনের হারিকেনটা নিভু নিভু হয়েছে কি না? আচ্ছা আমরা তো শিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন কলকারখানা পরিদর্শনে নিয়ে যাই, তাদের মধ্যে আকাশচুম্বী স্বপ্ন বুনি কিন্তু কখনো কি তাদের নিয়ে একটা এতিমখানা বা বৃদ্ধাশ্রম পরিদর্শন করেছি? আমার মনে হয় সবকিছুর মধ্যে একটা সমন্বয় থাকা ভালো। একজন শিক্ষার্থী যখন একটি বৃদ্ধাশ্রম বা এতিমখানা পরিদর্শন করবে, শিশু বয়স থেকেই তার মধ্যে পরিবার ও সমাজের প্রতি তার সহযোগিতা, সহমর্মিতা, স্নেহ–ভালোবাসা ইত্যাদি জাগ্রত হবে, নতুবা সে রক্তে–মাংসে গড়া মানুষ হবে ঠিকই, কিন্তু মানুষ শব্দের পূর্বে ‘অ’ বর্ণটি তাকে ছেড়ে যাবে না কখনো। আমরা সহজাতভাবে অন্যের দোষ চোখে দেখে বিশ্লেষণ করতে ভীষণ পছন্দ করি, কিন্তু নিজেকে অন্যের অবস্থান থেকে চিন্তা করতে দ্বিধাবোধ করি। এ ধরনের উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা শিশুদের অন্তর্নিহিত ভালো–মন্দকে জাগ্রত করতে পারি।

*লেখক: প্রভাষক, ইংরেজি, নোয়াপাড়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, রাউজান, চট্টগ্রাম