জাবির রসায়ন আঙিনায় রাসায়নিক অ-সাম্যবস্থা

প্রীতিলতা কিংবা জাহানারা ইমাম হল থেকে এখন আর কোনো রিকশা এসে থামছে না আমাদের সবার প্রিয় রসায়ন আঙিনায়। এম. এইচ কিংবা সালাম বরকত হল থেকে অনেক স্বপ্নপিপাসু ছাত্ররাও আজ আর ভীড় করছেন না এখানে। টিচার্স কোয়ার্টার কিংবা ঢাকা থেকে স্যার-ম্যাম'দেরও আসতে হচ্ছে না ক্লাস নিতে! পুরো আঙিনা জুড়ে সর্বত্রই একটা শুনশান নীরবতা।ল্যাবের অ্যাপারেটাসগুলো ঠায় পড়ে রয়েছে বেসিনে। ক্লিন করছেন না কেউ। রিয়েক্ট্যান্টগুলো সব বোতল বন্দী৷ বিক্রিয়া হচ্ছে না, তৈরি হচ্ছে না কোন নতুন উৎপাদও। টাইট্রেশনে ব্যুরেট-এর শেষ বিন্দুতেও বীকারে রাখা দ্রবণের কোন রং পরিবর্তন হচ্ছে না! ইনঅরগানিক ল্যাবের লবণগুলোতে ক্যাটায়ন কিংবা অ্যানায়ন নির্ণয় করতেও আসছে না কেউ!

হোয়াইট বোর্ডে মার্কার দিয়ে রিয়েকশন মেকানিজম লিখে লিখে বোর্ড টাকে ভরিয়ে তুলছে না কোন স্যার। কিংবা কোন স্যার হঠাৎই বলে উঠছেনা 'বোঝনি মনে হয়'! ক্লাসের ফার্স্ট বয়/গার্লদের টিউটোরিয়ালগুলোতে পাওয়া হচ্ছে না হায়েস্ট মার্ক। লাস্ট বেঞ্চারদের ক্রিয়েটিভিটিগুলো থেকেও সবাই বঞ্চিত হচ্ছে দিনের পর দিন।

সকাল সাড়ে ৮টার ক্লাস ধরতে হাঁপাতে হাঁপাতে আসছে না কেউ। কিংবা সকালের নাস্তা মিস করা স্টুডেন্টটাও ভাবীর দোকানে নাস্তার জন্য হানা দিচ্ছে না! দিবেই বা কিভাবে, সেই যে বন্ধ হলো ভাবীর দোকান, আরতো খুলেই নি!

মাত্র ৩০ মিনিট/কিংবা ১ ঘন্টার বিরতিতে কেউ লাঞ্চ করতে বটতলায় যাচ্ছে না এখন আর। কি উঁচু বট কি নিচু বট, সাজ সাজ রব রব বটতলার দোকানগুলোর একটার সাটার আজও পর্যন্ত খুলেনি! প্রাণের স্পন্দন একেবারেই থেমে গেছে।

বিকেলে ল্যাব শেষে সাভার, হেমায়েতপুর, ইপিজেড, বাইপাইল, নবীনগর, বিশমাইল, পানধোয়া, গেরুয়াতে টিউশনিতে যেতে পারছে না কেউ। অনার্স ফোর্থ ইয়ার কিংবা মাস্টার্সে পড়ুয়া মধ্যবিত্ত পরিবারের কোন শিক্ষার্থীকে রুম করিডোরে দাঁড়িয়ে মৃদু গলায় বলতেও শোনা যাচ্ছে না-

'মা'গো, আর কয়েকটা দিন। এরপর চাকরি পেয়ে আমিই পুরো পরিবারের হাল ধরব!'

কমন রুমের টিভি ছাড়া হচ্ছে না আর। রাত জেগে এল ক্লাসিকোর বার্সা-রিয়ালের খেলা দেখাও বন্ধ। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলেরও কোন খেলা নেই। তাই কমন রুমের চেয়ারগুলোতে অগ্রীম সিট রেখে দেওয়ার কোনো প্রতিযোগিতাও নেই আজ। টেবিল টেনিস ব্যাটজোড়া কিংবা ক্যারমের গুটিগুলোর স্থান হয়েছে তালা দেওয়া হলের আলমারিতে।

পড়তে পড়তে চোখের ঘুম তাড়ানোর জন্য কিংবা রাত ১২ টার ক্ষুধা নিবারণের জন্য কেউ আর ভীড় করছে না হলের ছোট্ট দোকানগুলোতে। শেষ রাতে সিংগারা, সমুচা কিংবা সেদ্ধ ডিম বিক্রি করা ইব্রাহীমদেরও আজ ছুটি! রাত ৩ টা, ৪ টা পর্যন্ত মিনমিনিয়ে হলের রুমে বসে পড়ছেও না কেউ আজ! রাত জেগে করিডোর কিংবা ছাদে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলা প্রেমিক/প্রেমিকাদেরও আজ ছুটি।

ফজরের আজান হচ্ছে। রাতের অন্ধকার কাটিয়ে সকালের নিভু নিভু আলোয় আলোকিত হচ্ছে প্রিয় ক্যাম্পাস। কিন্তু কারও আজ সকাল সকাল উঠার কোনো তাড়না নেই। নেই পরীক্ষার চাপ কিংবা সকালের ক্লাস ধরার তাড়া।

দিনের পর দিন অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে। এভাবেই অনিশ্চয়তায় কেটে যাচ্ছে দিনগুলো। একটা অদৃশ্য ভাইরাসের কাছে আজ আমরা কত অসহায়! তবে আবার সুসময় আসবে। ল্যাবে নতুন নতুন বিক্রিয়া হবে, উৎপাদ বাড়বে। হোয়াইট বোর্ডগুলো রিয়েকশন মেকানিজমে ভরে উঠবে। বটতলায় আবার ফিরবে প্রাণের স্পন্দন। হলগুলোতে চলবে ধুন্দুমার পড়াশোনা কিংবা কমন রুমে চোখ ধাঁধানো টেবিল টেনিস। আবার ব্যস্ত হয়ে উঠবে আমাদের এই আঙিনা তথাপি আমাদের সবার প্রিয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।

*লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, (৩৮ তম আবর্তন), রসায়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়