করোনায় উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প

বৈশ্বিক মহামারি করোনায় থমকে গেছে বিশ্ব, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও ভঙ্গুর। দেশে করোনার প্রকোপ ছড়িয়ে পড়ায় গত মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বসে বসে অলস সময় পার করতে হচ্ছে লাখো শিক্ষার্থীকে। কিন্তু এই বিরূপ পরিস্থিতিতেও থেমে থাকেননি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী। যাঁরা নানা প্রতিকূলতাকে জয় করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার ভূমিকায় নিজেদের দাঁড় করিয়েছেন। এমন কিছু শিক্ষার্থীদের নবীন উদ্যোক্তা হওয়ার পেছনের গল্প আজ তুলে ধরা হচ্ছে।

মো. তানভীর হোসেন সুন্দরবনের হালাল মধু সরবরাহ কেন্দ্রের স্বত্বাধিকারী। তিনি বলেন, ‘বলা হয়, অলস মস্তিষ্ক শয়তানের আখড়া। তাই নিজেকে যতটা গতিশীল আর কাজের মধ্যে ব্যস্ত রাখা যায়, ততই উত্তম। বৈশ্বিক মহামারিতে গোটা দুনিয়া যখন থমকে যায় যায় অবস্থা, ঠিক তখনই অনেক ভেবেচিন্তে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে এর মধ্যে কিছু একটা করতেই হবে। চট করে মাথায় এল, যেহেতু সুন্দরবনের পাশেই আমার বাড়ি, সেহেতু এ সময়টাতে বসে না থেকে মধু সংগ্রহের মাধ্যমে মানুষের কাছে খাঁটি মধু পাঠাতে পারি, তাতে নিজেরও আয় হবে। আপাতত কাজ করছি খলিসা আর গরান ফুলের চাকের খাঁটি মধু নিয়ে। পণ্যের গুণগত মানের দরুন ইতিমধ্যে দেশে–বিদেশে সন্তোষজনক সবুজ সংকেত পেতে শুরু করছি। এই কাজে নিয়োজিত করার ফলে লাভবান হচ্ছি।’

উদ্যোক্তা জুয়েল মামুন বলেন, ‘করোনাকালে ভার্সিটি বন্ধ থাকায় যেহেতু বাড়িতেই বসে থাকতে হয়। সে জন্য ভাবলাম রাজশাহী গিয়ে আমের ব্যবসা শুরু করি। দেখতে দেখতে আমের মৌসুম চলে আসায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ গিয়ে ব্যবসায় লেগে পড়ি। আমাদের অনেকে আম নেওয়ার ফোন দিয়ে অর্ডার করে। অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে আম অর্ডার করে। এখন পর্যন্ত আমরা প্রায় ৩০ হাজার কেজি আম বিক্রি করেছি। আমরাও গ্রাহকদের হাতে কেমিক্যালমুক্ত আম পৌঁছে দিতে পেরে দারুণ খুশি। লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা বলতে গেলে বলব, এটা সম্ভাবনাময় খাত। এখানে প্রচুর সম্ভাবনা আছে। জেলা প্রশাসন একটু আন্তরিক হলে রাজশাহীর আমের সুনাম অক্ষুণ্ন রেখে দেশের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বাইরে পাঠানো সম্ভব হবে।’

অপর এক উদ্যোক্তা শরিফুল ইসলামের ভাষ্য, ‘বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারি আকার ধারণ করায় বাসায় অনেকটা অবসর সময় কাটাচ্ছি। এদিকে সময়টা চলছে আমের মৌসুম। ভাবলাম, শুধু শুধু অলস সময় না কাটিয়ে সীমিত মুনাফায় রাজশাহীর ফরমালিনমুক্ত আম মানুষের হাতে পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নিলে কেমন হয়! আমার বাল্যবন্ধু মশিউর স্নিগ্ধ একমত হওয়ায় উদ্যোগ নেওয়ার সাহস পেলাম। এভাবেই দুই বন্ধুর আম ব্যবসার যাত্রা শুরু। আমরা মূলত ময়মনসিংহ শহরকেন্দ্রিক আম ডেলিভারি দিয়েছি। মাত্র ১ মাসে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন জাতের প্রায় ৩ হাজার ৬০০ কেজি আম গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। আমাদের কোনো ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য ছিল না, শুধু একটাই উদ্দেশ্য ছিল, মানুষ যেন করোনার ক্রান্তিকালে কার্বাইডমুক্ত ফল খেতে পারে। নতুন একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে। নতুন এই অভিজ্ঞতা হতে পারে নিজেদের সফল উদ্যোক্তা করে তোলার প্রয়াস।’

উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প বলতে গিয়ে আজিম উদ্দীন বলছিলেন, ‘পুরো বিশ্ব করোনায় বিপর্যস্ত। এ কঠিন অবস্থার মধ্যেও আমি একজন উদ্যোক্তা হিসেবে গত বছরের মতো এবারও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফরমালিনমুক্ত আম নিয়ে ব্যবসা শুরু করি। তবে এবারের বিজনেসটা বড় চ্যালেঞ্জিং ছিল। স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে গ্রাহকের কাছে মিষ্টি সুস্বাদু আম সরবরাহ করা। তা ছাড়া ব্যাপক বৃষ্টিপাতের ফলে আমে নানা রকম সমস্যা দেখা যাওয়ায় খুব সাবধানতার সঙ্গেই বাগান থেকে বেছে বেছে গ্রাহকের কাছে সঠিকভাবে আম পৌঁছে দেওয়া। এটাও বড় চ্যালেঞ্জ ছিল আমাদের জন্য। সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে দক্ষতার সঙ্গে আমি চেষ্টা করেছি ভালো সার্ভিসের মাধ্যমে ক্রেতার সন্তুষ্টি অর্জন। একজন উদ্যোক্তা তাঁর বহুবিধ দক্ষতার মাধ্যমে যেমনি নিজেকে মেলে ধরার প্রয়াস পান, অপর দিকে কর্মসংস্থানেরও একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়। তাই আত্মনির্ভরশীলতার জন্য উদ্যোক্তা হওয়ার বিকল্প নেই। সর্বোপরি আমি একজন সফল উদ্যোক্তা হতে চাই।’

মো. আলিফ হোসেন আম বিক্রির অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে ভবিষ্যৎ জীবিকার দিকনির্দেশনাও দিলেন। তিনি বলছিলেন, ‘স্বপ্ন হলো সফলতার প্রথম ভ্রূণ। একজন নবীন উদ্যোক্তার কাছে স্বপ্ন দেখাটা দোষের কিছু নয়, বরং সেই স্বপ্ন থেকেই জন্ম নেয় ইচ্ছাশক্তি, আত্মবিশ্বাস, ধৈর্যশক্তি, তারপরই ধরা দেয় সফলতা। আমের রাজধানীখ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় বাড়ি হওয়ার সুবাদে অনলাইনের মাধ্যমে সারা দেশে কার্বাইডমুক্ত আম সরবরাহের নিশ্চয়তা দিয়ে আমের বিজনেস শুরু করি। ম্যাংগো মার্ট নামে অনলাইন গ্রুপ ও পেজ তৈরি করে এর মাধ্যমে প্রচারণা চালাতে থাকি। আর একজন নবীন উদ্যোক্তা হিসেবে এ বছর আমের বিজনেস ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং। এখন পর্যন্ত এ বছর প্রায় ছয় লাখ টাকার মতো আম সরবরাহ করেছি। এটি সম্ভব হয়েছে কঠোর পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করলে সম্মান হারিয়ে যায় না। পড়ালেখা করলেই চাকরি করতে হবে, এমন চিন্তাভাবনা থেকে বেরিয়ে আসুন, সমাজের প্রচলিত এই ট্যাবুগুলো আমাদের মতো শিক্ষিত নবীন উদ্যোক্তাদের হাত ধরেই মুছে যাক, ঘুরে দাঁড়াক দেশের অর্থনীতি, কমে আসুক দেশের বেকারত্ব।’

প্রথমবার উদ্যোক্তা হওয়ার কথা বলতে গিয়ে নূর নাসিম বলেন, করোনায় হাজারো মানুষ হারিয়েছেন তাঁদের কর্মসংস্থান। চারদিকে অভাব আর হতাশা বৃদ্ধি পাচ্ছে বিশাল আকারে। ক্যাম্পাস বন্ধ, দীর্ঘ সময় বাসায় অবস্থান করতে হবে। মাথায় চিন্তা এল এই মহামারির মধ্যে কিছু করতে হবে। আশপাশের অসহায় মানুষগুলোর জন্য কিছু করতে হবে। তারপরই রাজশাহীর আম নিয়ে কাজ শুরু করলাম। ফেসবুকের মাধ্যমে প্রচারণা শুরু করলাম। আলহামদুলিল্লাহ অল্প সময়ের মধ্যেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় আম ডেলিভারি দিয়েছি। লাভ যা হয়েছে, তা দিয়ে নিজের হাতখরচের পাশাপাশি বেশ কয়েকজন অসহায়ের পাশে দাঁড়িয়েছি। জীবনে প্রথমবার এ ধরনের অভিজ্ঞতা আমি বেশ উপভোগ করছি। সেই সঙ্গে একজন সফল উদ্যোক্তা হওয়ার মনোবাসনা জাগ্রত হয়েছে।’

* লেখক: শিক্ষার্থী, রাবি