বিসিএস মোহ ও দুর্ভাগ্যে যাতনা

স্বপ্ন বুননই যাঁদের লক্ষ্য, তাঁরা তো স্বপ্নেই বিভোর থাকবেন। প্রিয় বিদ্যাপীঠের গণ্ডি পার হয়ে যখন চাকরির ক্ষেত্রে প্রবেশ করবেন, তখন তাঁদের এক অন্তহীন মাঠের মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে হয়। তখনই তাঁরা বেছে নেন সফল ক্যারিয়ারের সুন্দরতম দিকটি। সেখানে চলে আসে বিসিএসের নামটিও। তাই তাঁরা প্রাণপণে পরিশ্রম করে এক মহামন্ত্রে উদ্বুদ্ধ থেকে বিসিএস সীমানার তীরে আসেন। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ক্যাডারকেই নিশ্চিত করে চাকরির নিশ্চয়তা রক্ষা করতে চান। প্রাণপণ চেষ্টায় ব্রতী হয়ে সেটাকে লাভের চেষ্টা করেন। কেউ সফল হন, কেউবা বিফল মনোরথ নিয়ে ফিরে আসেন। প্রসঙ্গক্রমে আমরা ব্যক্তির সাফল্যের মনোরথকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকি। যাঁরা সামনের সারিতে আসেন, তাঁদের নিয়ে গর্ববোধ করি। তাদের অতি মেধাবীর কাতারে নিয়ে আসি।

অন্যদিকে যাঁরা বিফল মনোরথে ফিরে আসেন, তাঁদের আমরা মেধাবীর অন্তরায় নিমেষেই গণনা করতে কুণ্ঠা বোধ করি না। ফলে তাঁরা নিজেরা অনেকটা যেন শাপমোচনের খোলস থেকে বেরিয়ে খাণ্ডব দাহনের মধ্যে নিজেদের নিমজ্জিত রাখেন। আমরা তাঁদের কথা কতজনই-বা জানি, কতজনই-বা তাঁদের খোঁজ রাখার চেষ্টা করি। আমরা সবাই স্পর্শিত আলোর বিভাবরীকে নিয়ে ব্যস্ত থাকি যেখানে আলো ঠিকরে সোনালি আভা বেরিয়ে আসে। ফলে তাঁদের জীবনে নেমে আসে স্থবিরতা। কেউ দেখতে পায় না পেছনে পড়ার কাহিনি। শুনতে পায় না তাঁদের জীবন বাঁকের উপকথাগুলো। কেউ ঠাঁই দিতে চায় না সমাজে পড়ে থাকা পেছনের মানুষগুলোকে। ধন্য করে বেড়াই প্রতিষ্ঠিত মানুষের সম্মানে। একসময় যাঁরা স্বপ্ন দেখতেন, তাঁদের এখন স্বপ্ন বিক্রি করতে দেখি।

কেউ হয়তো দারিদ্র্যের মধ্যে বেড়ে উঠে ক্যাডার হয়েছেন, কেউবা মেধাবীর কাতারে থেকে এসে বিসিএসে চূড়ান্ত পর্যায়ে সাফল্য পেয়েছেন। আবার কারও জীবনে হার না-মানা কাহিনি নিয়ে এসে জয়ী হয়েছেন। তাঁরা সবাই মেধাবী বলে আমরা শতভাগ বিশ্বাস করি।

আমাদের দেশে কোন চাকরিকে কীভাবে আমরা মূল্যায়ন করব, তার কারণ ক্ষেত্রবিশেষে ভিন্ন হয়। আমার এক প্রাণবন্ত বন্ধুকে বিসিএসের ভাইভা বোর্ডে প্রশ্ন করা হয়, ‘তুমি ক্যাডারের পছন্দক্রমের বাছাইয়ে সর্বপ্রথমে এই ক্যাডারটি (ক্যাডারের নামটি উল্লেখ করলাম না) পছন্দ করলে কেন?’ উত্তরদাতা একপর্যায়ে গ্যাঁড়াকলে পড়ে বলে ফেলল, ‘এই ক্যাডারে আসলে সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধিসহ শক্তি প্রয়োগ (Power) করা যায়!’ ফল; ভাইভায় ফেল।

বেচারা অনেক বড় আশা নিয়ে ভাইভায় গিয়েছিল। হয়তো সমাজের রন্ধ্রে থেকে শক্তিপ্রয়োগ (Power) শব্দটি তাকে বেশি অনুপ্রাণিত করেছিল কিংবা আশান্বিত করেছিল। আমাদের সমাজে যাঁরা অন্ধ শ্লাঘা লোক, তাঁরা হয়তো এসব মনোভাব পোষণ করেন বলেই আমরা এখনো সেই শক্তিতত্ত্বের নান্দনিকতায় নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যাই। সে জন্য হয়তো শক্তি প্রদর্শনের মতো শব্দটি তাঁর মাথায় বিঁধেছিল। তাই, সমাজব্যবস্থার প্রায়োগিক দিক বিবেচনায় না নিয়ে চাকরি জীবনে উচ্চাভিলাষী মানব মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে। আস্তে আস্তে লক্ষ্যটুকু থিতু হয়ে সমাজের জৌলুশ বসনে নিজেকে স্থায়ী রূপ দিতে চায়। যাঁদের ইচ্ছা ছিল দেশসেবার, তাঁরাই আজ দেশ শাসন করার স্বপ্নে বিভোর।

আবার, যে কারও যে উদ্দেশ্যই নিহিত থাক না কেন, সামাজিক স্তরে এসে মানবসেবায় নিয়োজিত থেকে ব্রতী হতে পারবেন, সে উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে ভাইভায় উত্তীর্ণ হন। মহৎ পেশা হিসেবে মেনে নিয়ে নির্মোহতা চাকরির ক্ষেত্রে কাজ করে। বস্তুত সঠিক মূল্যায়নের মাধ্যমে উন্মোচন করার চেষ্টা করে।

ভবিতব্য বিষয়ে আমরা এটাকেই মেনে নিই। পরিবেশটাই এভাবে গড়ে তুলি। বিসিএস নিয়ে মাতামাতি। তারুণ্যে ভরপুর শিক্ষাজীবনের সুন্দরতম সোনালি অধ্যায়টুকু শেষ করে জীবনযুদ্ধে উৎসারিত হওয়ার নিমিত্তে অগাধ বই-পুঁথি নিয়ে বসে পড়েন। যাঁর যাঁর মেধার বিকাশ ঘটিয়ে চাকরি পেতে চেষ্টায় রত হন। একইভাবে বিসিএস পরীক্ষায় মেধার বিকাশ ঘটাতে পারঙ্গম ব্যক্তিরাই তাঁদের যোগ্যতাটুকু দেখাতে সক্ষম।

প্রিলিমিনারি পরীক্ষাতে ২০০ নম্বর উতরিয়ে কয়েক লাখ প্রার্থীর মধ্যে টিকে থাকা অনেক দুঃসাধ্যের ব্যাপার বলা চলে। তারপর ৯০০ মার্কসের রিটেনের মতো কঠিন পরীক্ষার বেসাতি! সেটা কঠিন এ জন্যই বললাম, ধৈর্যই এখানে সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। তার ওপর ৯০০ নম্বরের বিভাজনে আলাদাভাবে ওই সব বিষয়ে সম্যক ধারণা নিয়ে পরীক্ষার হলে প্রবেশ করতে হয়। এ তো শুধু জেনারেল বা প্রফেশনাল ক্যাডারদের জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু উভয় ক্যাডার হলে ১১০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা। মনে হয় সে এক কঠিন সময়ের আবর্তনে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখে কাউকে ফেলে দিয়ে আসা।

বাস্তব অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে এমন অনেককেই দেখেছি, লিখিত পরীক্ষায় দু-একটি তে অংশগ্রহণ করে বাকিগুলো থেকে মুক্তি চেয়ে পরীক্ষা থেকে বিদায়! আবার তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সহাস্যে প্রকাশ করেন, বিসিএস পরীক্ষা দিলে অতি মেধাবীর কাতারে চলে যেতেন! স্নিগ্ধতায় মুখর কথাগুলো শুনে আফসোস করি। তাই বলি, লিখিত পরীক্ষায় অতি কাঠিন্যের প্রাকৃত রূপ যাতে চূড়ান্ত ধৈর্যের সঙ্গে অত্যন্ত গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। তারপর ২০০ মার্কসের ভাইভা। প্রিলিমিনারির ২০০ নম্বর গণনায় নেওয়া হয় না। জেনারেল ক্যাডারের ৯০০ নম্বর এবং ভাইভার ২০০ নম্বর। সব মিলিয়ে ১১০০ নম্বর। যদি প্রফেশনাল ক্যাডারসহ গণনায় নেওয়া হয়, তবে সে ক্ষেত্রে ১৩০০ নম্বরের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়। যদিও ৩৪তম বিসিএস পর্যন্ত প্রিলিমিনারিতে ১০০ নম্বরের পরীক্ষাই বিদ্যমান ছিল। ৩৫তম বিসিএস থেকে ২০০ নম্বরের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয়ে থাকে।

সেই সব পরীক্ষা উতরে যাঁরা ভাইভায় ফলপ্রসূ, তাঁদের অবশ্যই মেধাবী কেন, অতি মেধাবীর কাতারে ফেলা যায়। তাঁদের প্রজ্ঞা, জ্ঞান, মেধা কাজে লাগিয়ে সেখানে প্রবেশ করেছেন। কিন্তু যাঁরা ভাইভা থেকে ফিরে আসেন, তাঁদের কোন কাতারে ফেলা হয়, জানি না।

অন্যান্য চাকরি তুলনায় স্বাভাবিকভাবেই বিসিএস ক্যাডার থেকে নিয়োগকৃত চাকরি ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করে। যেসব চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় তার মধ্যে বিসিএসেই সবচেয়ে বেশিসংখ্যক পদের বিপরীতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। যদিও জেনারেল ক্যাডারে সে অনুপাতে কমসংখ্যক পদই থাকে। তা ছাড়া অন্যান্য চাকরি তুলনায় পেশাগত বৈচিত্র্য চাকরি প্রত্যাশীদের আলাদাভাবে প্রলুব্ধ করে। হয়তো এ ধরনের চাকরির সান্নিধ্যে থাকলে সমাজে চাকরির মর্যাদা কিংবা জৌলুশ আরও কয়েক গুণ বেড়ে যায়! তাই তাঁদের বিসিএসের প্রতি মোহ জন্ম নেয়।

হ্যাঁ, তরুণেরা আজ বিসিএস নিয়ে ব্যস্ত। তাঁদের এই ব্যস্ততার মধ্যেই তাঁদের কোনো একটি স্বপ্ন কাজ করে। স্বপ্নটুকু বাস্তবায়নের মধ্যেই যেতে চায় সোনালি ভবিষ্যতের দ্বারপ্রান্তে। অনেক আত্মবিশ্বাসের বলয়ে এসে অতি পরিশ্রমের মধ্যে নিজের পাণ্ডিত্য প্রকাশে বলীয়ান হয়। তবে এই আত্মপ্রত্যয়ে বলীয়ান হওয়া নিঃসন্দেহে ইতিবাচক ধারণার ইঙ্গিত বহন করে।

অনেক চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে নিজেকে ভাইভার জন্য উপযুক্ত বিবেচনা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে ভাইভা হলো ভাগ্যনির্ধারক, যা আমি বুঝতে পেরেছিলাম স্বপ্নময় জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে। পরপর চারটি ভাইভায় উপস্থিত হয়েও সফলতার দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরে আসি। অভিজ্ঞতার মধ্যেও আমার জেনারেল ক্যাডারে লিখিত পরীক্ষার ঝুলিতে ৬২.৫০% নম্বর নিয়েও ভাইভায় অকৃতকার্য! যেখানে ১০-১২টি ভাইভা বোর্ড বসে, সেখানে একই বোর্ডে বারবার ডাক পাওয়া দুর্ভাগ্যেরই নামান্তর বটে।

সে না হয় মেনে নিলাম ভাগ্যের পরিহাস হিসেবে। কিন্তু গণিত বিষয় নিয়ে উভয় (Both) ক্যাডারে কোয়ালিফাই করেও ভাইভায় সরব উপস্থিতি জানান দিই। তাতেও হার মেনে পিছু হটতে হলো। অথচ গণিত বিষয়ে যতটি শূন্য পদের বিপরীতে আবেদন চাওয়া হয়, প্রফেশন্যাল ক্যাডারে ঠিক তত সংখ্যক প্রার্থীকে ভাইভায় পাওয়া কঠিন ব্যাপার। কিন্তু কপালের নিয়ন্তা ভাগ্যই বারবার বিড়ম্বিত করে ভগ্ন দশাকে আরও ভগ্ন করে ফেলে!

তার পরও আমরা নৈরাশ্যবাদে বিশ্বাসী নই। তাই আশা নিয়ে এগিয়ে চলি। কিন্তু আশার মধ্যেও যখন সীমাবদ্ধতা চলে আসে, তখন নৈরাশ্যকেই আলিঙ্গন করে বেঁচে থাকতে হয়। তাই মাঝেমধ্যে ভাবি, বিসিএস ভাইভায় পারঙ্গম বলতে যা বোঝায়, তা কখনো বুঝে উঠতে পারিনি। আঁচ করতে পারিনি জীবনযুদ্ধ একটি অসমতার স্থান। সম্ভবত নিজের ভাগ্যই সেখানে পথ খুঁজে দেখিয়ে দেয় তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে।

আবার ভাইভার মধ্যেই কারও কারও ক্ষেত্রে সঠিক মূল্যায়নের ভিত্তি গড়ে দেয়। ভাইভা ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক বলেই ভাগ্যের অন্বেষণে অনেকে স্বপ্নের সিঁড়িতে হোঁচট খেয়ে ফিরে আসে। মনে হয় ভাইভা ভাগ্যের সহায়ক কিংবা বিড়ম্বনায় পর্যবসিত এক অসহায়ত্বের প্রবেশদ্বার।

*লেখক: ব্যাংক কর্মকর্তা। [email protected]