আনন্দীর নিজের কোনো ঘর নেই

জীবিকার তাগিদে কোদাল হাতে কাজে নেমেছেন আনন্দী। ছবি: লেখক
জীবিকার তাগিদে কোদাল হাতে কাজে নেমেছেন আনন্দী। ছবি: লেখক

‘ভাইবোন মিলা সংসারে মেলা মানুষ। বাপ সারা দিন খাইটা খাওন জোগাইতে পারত না আমগোর। দেশে অভাব আর অভাব। কোনো কাম নাই। বাপ-মায় ১৩ বছর বয়সে বিয়া দিছে এক আধপাগলার লগে। সারাটা জীবন আমার কাজ করতে করতে গেল। কোনো দিন জীবনে সুখ পাই নাই। জীবনে একটা ভালো কাপড় পইরা দেখি নাই। কোনো দিন কত পূজাপার্বণ যায়, শরীরের রক্ত পানি কইরা চারটা মাইয়া বিয়া দিছি। জঙ্গলে জঙ্গলে থাকছি। জামাই (স্বামী) আমার আধা পাগল। তাও আবার টাইফেড (টাইফয়েড) জ্বরে এক চোখে নষ্ট হয়ে গেছে। অন্যের জমিনে কাম কইরা খাই। কী এক অসুখ আইলো দেশে। কাম বন্ধ হয়া গেল গা আমগো। খিদায় কিছু মানে না, দাদা। সকাল থেইকা দানাপানি দেই নাই পেটে, কাম খুঁজতাছি। শেষে জলিল মিয়া ১২০ টেকা রোজ তার হলুদখেতে কামে লইল। হুনছি, সরকার গরিব মানুষেরে থাকার জায়গা দেয়। আমার তো কোনো থাকার জায়গা নাই। এই দেশের সরকার আমারে একটা থাকার জায়গা দিব, একটা থাহুনের ঘর বানাইয়া দিব, দাদা? ও দাদা, আপনেরা লেখালেখি করলে কিছু জুটব পোড়াকপালী আনন্দীর কপালে?’

আমার কোনো সাড়া না পেয়ে হাতে থাকা ধারালো কোদালের ফলায় মাটির বুকে ধুপ করে একটা কোপ বসিয়ে দিলেন আনন্দী। বুকের ভেতর মুহূর্তেই ছ্যাঁৎ করে উঠল আমার। ফোন রেকর্ডটা চালু করে মন দিয়ে শুনছিলাম আনন্দীকে, কল্পনা করছিলাম জীবনের গল্পটা। আনন্দীর মতো আরও বেশ কয়েকজন নারী কাজ করছিলেন জলিল মিয়ার হলুদখেতে। একজন আরেকজনকে কী যেন বলছিলেন, টিটকারি করছিলেন আনন্দীকে। সেদিন কথা বলে হলুদখেত থেকেই ফিরে এসেছিলাম।

ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার বাড়ি আনন্দীর। তাঁর স্বামী জনাকু বর্মণ।

আনন্দী নামটা রেখেছেন তাঁর ঠাকুরমা। জন্মের পর পুরো বর্মণপাড়ায় রব পড়ে যায়। বাপের দেশে কাজ নাই, কাজের মজুরিও কম, বাবার নেই এক টুকরা জমি। বিয়ের পর টাইফয়েডে এক চোখ নষ্ট হয় স্বামী জনাকু বর্মণের। তাই চার মেয়ে, দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে দিনমজুরের কাজ করে জীবন চলত। নিজের দেশেও যখন জায়গা নেই, তখন জাতিভাইদের পরামর্শে পরিবার নিয়ে চলে আসে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার পাহাড়ি এলাকা কৃষ্ণপুর গ্রামে। হলুদখেত, কলাবাগান আর সবজিখেতে দিনমজুরি করে চলতে থাকে সংসার। প্রথমে জঙ্গলে থাকলেও পরে স্থানীয় এক বাগানমালিক তাঁর বাগান পাহারাদার হিসেবে টংঘরে থাকতে দেন আনন্দীর পরিবারকে, স্থানীয় ভাষায় যাকে বলা হয় রায়াত থাকা।

অন্য জেলা থেকে আসার কারণে কৃষ্ণপুর বর্মণপাড়ায় ঠাঁই হয়নি আনন্দী বর্মণের; যদিও বর্মণপাড়ায় যারা আছে, তাদেরই মাথা গোঁজার ঠাঁই হয় কোনোমতে। বর্মণপাড়ার প্রায় সবাই হতদরিদ্র। চাটাই, ঝাঁটা, মাছ শিকার, দিনমজুরি করে কোনোমতে সংসার চলে। অন্যের বাগান পাহারা দিয়ে টংঘরের থাকেন আনন্দী, তাঁর প্রতিবন্ধী স্বামী জনাকু বর্মণ, দুই সন্তান ইমন বর্মণ ও জীবন বর্মণ।

সম্প্রতি এক মধ্যদুপুরে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার নাওগাঁও ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রামে আনন্দীর বাড়ির খোঁজ করতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় আমাকে। কৃষ্ণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পেছনে সরু একটা পথ সাপের মতো ধেয়ে গেছে দুপাশের আনারস আর আম, লেবুবাগানের মধ্য দিয়ে। বেশ কিছুক্ষণ পর একজনকে জিজ্ঞাসা করতেই আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল আনন্দীর থাকার টংঘরটা। বাড়িতে তাঁর ছোট মেয়ে এসেছে নাইয়র, মেয়ের জামাইসহ দুই বছরের নাতনি। ছোট ভাগনিকে নিয়ে আনন্দে মেতেছে ইমন আর জীবন। জনাকু লেবুবাগানে পানি দিচ্ছিলেন, আনন্দী রাঁধছিলেন। বাড়িতে মেহমান থাকায় আজ কাজে যাননি।

ইমন ও জীবন দুজনেই কৃষ্ণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। করোনায় স্কুল বন্ধ থাকায় বাড়িতে বাবার সঙ্গে কাজে সহায়তা করে তারা। যত কষ্টই হোক দুই ছেলেকে পড়াশোনা করাতে চান জনাকু বর্মণ।

ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার কৃষ্ণপুর গ্রামে এভাবেই কোদাল হাতে হলুদ তোলার কাজ করছেন জীবনসংগ্রামী নারী আনন্দী বর্মণ। ছবি: লেখক
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার কৃষ্ণপুর গ্রামে এভাবেই কোদাল হাতে হলুদ তোলার কাজ করছেন জীবনসংগ্রামী নারী আনন্দী বর্মণ। ছবি: লেখক

জনাকু বর্মণ বলেন, ‘আমার জীবন তো শেষ। সারা জীবন মানুষের কাজ করে নিজের একটা ঘরে থাকার সামর্থ্য হইলো না। পোলাপানরা যদি লেখাপড়া না করে এ রকম করে, তাইলে অগো অবস্থা আরও খারাপ হইব। তাই যত কষ্টই হোক, পোলা দুইডারে লেখাপড়া করাইয়া চাকরি-বাকরি করামু। তারপর আমরা দুইজন একদিন আর কোনো কাম কাজ করমু না।’

বহুদিন দেখা হয় না আনন্দীর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। মাকে শেষ দেখেছিলেন বছর পাঁচ আগে। বাড়ি আসা–যাওয়ার ভাড়ার টাকাই জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হয়, তাই বাড়িতে যাওয়া হয় না বলে জানিয়েছেন আনন্দী বর্মণ। এত অভাব–অনটন, তবু যেন চোখেমুখে কোনো দুশ্চিন্তা নেই, সদাহাস্যোজ্জ্বল আনন্দী একবেলা খেল কি খেল না, তাতে তাঁর কিছু আসে–যায় না। না খেয়ে হলেও দিন শেষে পরিবারের আধা পাগল স্বামী জনাকু, কলিজার টুকরো সন্তানদের নিয়ে নানান খুনসুটি আর আনন্দে মেতে ওঠে আনন্দীর পরিবার।

আনন্দীর জীবনের এমন অনেক স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তাঁর কোনো দিন বাড়ি ফেরা হবে কি না জানা নেই। নিজের জন্মভূমি, নিজের গ্রাম, পরিবার, স্বজন, সেই যে ছেড়ে এসেছেন ১৩ বছরে। জীবিকার তাগিদে কখনো ইটভাটায়, কখনো কৃষিকাজ, কখনো মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহসহ জীবনের নানান অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা একজন সাহসী আনন্দী সত্যি নারী সমাজকে এক বলিষ্ঠ প্রতিবাদ বলব আমি। এই কৃষ্ণপুর গ্রাম ছেড়ে আর কোথাও যেতেও চান না তিনি। নিজের যে জন্মভিটায় ঠাঁই হয়নি তার, সেখানে আর ফিরবেন না তিনি।

আনন্দী বলেন, ‘যত দিন বাঁইচা আছি, মাইনষের কাম কইরা খাইতে হইব। কিছু কিছু টেকা জমাইতাছি। একটা ছোট্ট থাকার জমি কিনমু, একটা ঘর করমু। আমরা না থাকি, পোলাপান দুইটারে মাথা গোঁজার ঠাঁই তো দিতে হইব। ভগবান কিছু মানুষ সৃষ্টি করছে শুধু কষ্টই পাবার লাইগা...।’

আনন্দী এবার চুপচাপ চোখ মুছলেন তাঁর আঁচলে। আমি আর কোনো প্রশ্ন না করেই জঙ্গলের ভেতর থেকে ফিরে আসছি, পেছন থেকে আচমকাই ডাক দিলেন আনন্দী। পেছন ফিরতেই শাড়ির আঁচল থেকে কয়েকটা কাগজি লেবু হাতে দিয়ে বলেন, ‘জানি আমগো মতো গরিবের ঘরে চাইড্ডা ডাইল–ভাত খাইবেন না। তাই এই কয়ডা লেবু লইয়া যান শরবত কইরা খাইয়েন।’

লেবুগুলো পকেটে ভরে সোজা চলে এলাম জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। পেছনে শুধু পড়ে রইল আনন্দীর সংসার, দূর থেকেও তাঁদের খুনসুটির আওয়াজ বাতাসে ভাসছিল বাড়ির ওপর থেকে।

ই–মেইল: [email protected]