চামড়ায় সুদিন ফিরবে কীভাবে

মনে আছে ভেনেজুয়েলার কথা? এক বছরেরও কম সময়ের ব্যবধানে মুখ থুবড়ে পড়েছিল দেশটির অর্থনীতি। বিপুল তেলের মজুতে সমৃদ্ধ দেশটি একমুখী অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতার গ্যাঁড়াকলে পড়ে হয়েছিল অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতায় মুহ্যমান।

একমুখী অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা বাড়তে থাকলে আগামী বাংলাদেশেও ঘটতে পারে ভেনেজুয়েলা সংকটের পুনরাবৃত্তি। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় অংশ জুড়ে থাকা পোশাক শিল্পে ক্রমবর্ধমান সংকট যেন সেরকম কিছুরই আভাস দিচ্ছে। করোনার থাবায় তৈরি পোশাকের দাম ও রপ্তানি হ্রাস, বিদেশি অর্ডার বাতিল ও পোশাক কারখানা বন্ধের ঘটনা সেই আশঙ্কাকে ত্বরান্বিত করছে। পোশাক শিল্পের এই মহামন্দায় কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত সংকট এড়াতে অনতিবিলম্বে বাংলাদেশের অর্থনীতি বহুমুখীকরণ এবং পোশাক শিল্পের পরিপূরক হিসেবে বিকল্প কোনো খাত প্রস্তুত ও জোরদারকরণ এখন সময়ের দাবি।

এক সময় পাটশিল্প বাংলাদেশি অর্থনীতির বৃহত্তম খাত থাকলেও দেশি ও বিদেশি বাজারে পাটজাত পণ্যের চাহিদা হ্রাস ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে এ-দেশে পাটশিল্প বিকাশের সম্ভাবনা আজ মৃতপ্রায়।

চামড়া বর্তমানে তৈরি পোশাক শিল্পের পর প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী ও রপ্তানিযোগ্য পণ্য। বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ নানান প্রতিকূলতার মধ্যেও গত অর্থবছরে পোশাকশিল্পের পরে সর্বোচ্চ ১০১ কোটি ৯৭ লাখ ডলারের রপ্তানি আয়ের মাধ্যমে চামড়া শিল্প রপ্তানি আয়ে দ্বিতীয় অবস্থান ধরে রেখেছে। চামড়া খাত থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের সরকারি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

দেশীয় অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনয়নকল্পে বিকল্প খাত হিসেবে চামড়া শিল্প নজরদারি পাওয়ার ক্ষেত্রে অধিক দাবিদার। চামড়া শিল্পের বিকাশ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচন করতে সক্ষম, অধিক সমন্বয় ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এ সম্ভাবনাময় খাতটিকে দেশের অর্থনীতির দুঃসময়ের কান্ডারি করে তুলবে।

দেশীয় ট্যানারি শিল্পের প্রধান কাঁচামাল কাচা চামড়ার জোগানের প্রায় ৭০ ভাগ আসে কোরবানি পশুর চামড়া থেকে। বাংলাদেশে চামড়া শিল্পের কাঁচামাল প্রাপ্তির বিশাল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে কোরবানি চামড়া যথাযথ কাজে লাগানো সম্ভব হয়ে উঠছে না। গত বছর চামড়ার কাঁচামালের নজিরবিহীন মূল্য বিপর্যয়ের কারণে ধস নেমেছিল চামড়া শিল্পে। বিগত তিন দশকের ইতিহাসে গত বছর চামড়ার দাম ছিল সর্বনিম্ন। গত বছরের ন্যায় এবারও ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার ক্ষোভ আর ক্রেতা অভাবে কোরবানির চামড়া পানিতে ফেলে দেওয়া ও বিপুল চামড়া নষ্ট হওয়ার ঘটনা ঘটেছে রাজশাহী, চট্টগ্রামসহ দেশের বেশ কিছু জায়গায়। দেশের বেশির ভাগ জায়গায় প্রতিটি গরুর চামড়ার আকার অনুযায়ী গড়ে ১৫০ থেকে ৫০০ টাকায়, আর ছাগলের চামড়া ২ থেকে ১০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পরপর দু'বছর চামড়ায় এই নজিরবিহীন বিপর্যয় সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের চামড়া ব্যবসায় নিরুৎসাহিত করছে। কোরবানি এই মৌসুমে ক্ষুদ্র বিক্রেতা ও প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের চামড়ার ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার নেপথ্যে থাকা সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য ও মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজির দরুন মুখ থুবড়ে পড়ছে কোরবানির চামড়া বাণিজ্যের প্রায় সকল সম্ভাবনা। বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে শেষ মুহূর্তে কাঁচা চামড়া রপ্তানির ঘোষণাকে দুষছেন অনেকে।

ঈদুল আজহার আগেই সরকারি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, চামড়া খাতের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীদের বৈঠকের মাধ্যমে গৃহীত ফলপ্রসূ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের মাধ্যমে অনাকাঙ্ক্ষিত সিন্ডিকেটের দুর্ভোগ এড়ানো সম্ভব হতো বলে ধারণা বিশেষজ্ঞ মহলের।

কথায় আছে, ‘সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়’। সময়মতো উপযুক্ত সিদ্ধান্ত ও গৃহীত পদক্ষেপের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন না হওয়ায় এবারও গত বছরের পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে, ফলে লোকসান গুনতে হচ্ছে দেশের প্রান্তিক চামড়া ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সকলকে।

আগামী শনিবার থেকে ট্যানারি মালিকেরা চামড়া কিনতে শুরু করবে বলে জানানো হয়েছে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে। অতীত ও চলমান সমস্যাগুলোর পর্যালোচনার মাধ্যমে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ, নীতিমালা প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণসহ তদারকি বাড়ানোর মধ্য দিয়ে পুরো ব্যবস্থাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা গেলে কোরবানি মৌসুমের বাকি সময়টাতে সাম্প্রতিক দুর্ভোগ কিছুটা হলেও লাঘব করা সম্ভব হবে।

ভবিষ্যতে এ ধরনের বিপর্যয় এড়িয়ে চামড়া শিল্পকে বাঁচাতে সরকারি তৎপরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি এগিয়ে আসতে হবে বেসরকারি উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠানগুলোকেও। অপ্রতুল বিনিয়োগ ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাব এ-শিল্প বিকাশের অন্যতম প্রতিবন্ধক। চামড়া খাতের উন্নয়নকল্পে সরকারি বরাদ্দ বাড়ানোসহ সহজ শর্তে ঋণ প্রদান ও শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে চামড়া খাতের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে বলে দাবি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের। এখানে বেসরকারি বিনিয়োগের অনীহা দূরীকরণে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি চামড়া ব্যবসায় জড়িত সকলের সদিচ্ছা প্রয়োজন। সকল ধরনের বিনিয়োগ উপযোগিতা বাড়ানোর জন্য চামড়া শিল্পকে বহুমুখী করে গড়ে তুলতে হবে।

সেলক্ষ্যে রপ্তানিযোগ্য চামড়াজাত পণ্যের সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে বৈশ্বিক বাজার আকৃষ্ট করতে হবে। চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা নিশ্চিতকরণ ও সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ প্রদানের পাশাপাশি নিখুঁত প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য উন্নত প্রযুক্তির সম্মিলন ঘটাতে হবে। প্রশিক্ষিত চামড়া শ্রমিক আর কারখানায় আধুনিক যন্ত্রপাতির সেতুবন্ধনের মাধ্যমে চামড়াজাত পণ্য সংখ্যাসহ পণ্যের গুণগত মান বাড়ানো সহজতর হবে। প্রতি বছর কোরবানি মৌসুমে ট্যানারি সংকটের দরুন চামড়া প্রক্রিয়াকরণ নিয়ে বিপাকে পড়তে হয় ব্যবসায়ীদের। ট্যানারির সংখ্যাবৃদ্ধি ও পুরোনো ট্যানারিগুলোর সক্ষমতা বাড়ানো গেলে কোরবানির সময়ে চামড়া নিয়ে দুর্ভোগ কমবে ফলে বাড়বে চামড়া শিল্পের গতিশীলতা। কাঁচা চামড়া চোরাচালান ও সিন্ডিকেটে হয়রানি ও সকল ধরনের অব্যবস্থাপনা রুখতে জোরালো নীতিমালা প্রণয়নে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে। কোরবানির মৌসুমে যারা কাঁচা চামড়া চোরাচালান করে চামড়া শিল্পের বিকাশকে অনুরুদ্ধ করছে তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

বিগত বছরগুলোতে কাঁচা চামড়া রপ্তানি আয় ক্রমান্বয়ে কমলেও বেড়েছে চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি আয়। ইপিবির তথ্যমতে, গত অর্থবছরের (২০১৯-২০) জুলাই মাসে চামড়াজাত পণ্য ও চামড়া রপ্তানিতে আয় হয়েছে প্রায় ১০.৬ কোটি ডলার, যার প্রায় ৭০ শতাংশ এসেছে চামড়াজাত পণ্য (চামড়ার জুতা, ব্যাগ, বেল্ট, মানিব্যাগ ইত্যাদি) থেকে। চামড়া পণ্য থেকে ২২ শতাংশ ও শুধু চামড়া রপ্তানি থেকে আয়ের পরিমাণ মাত্র ৮ শতাংশ। এটা স্পষ্ট যে, বৈশ্বিক বাজারের চাহিদানুযায়ী আন্তর্জাতিক মানের চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানির মাধ্যমেই বেশি লাভের মুখ দেখবে বাংলাদেশ। অর্থাৎ, চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে নজরদারি বৃদ্ধি চামড়া শিল্পের সম্ভাবনাকে ত্বরান্বিত করবে।

সরকারি উদ্যোগে চামড়া শিল্পের উন্নয়নকল্পে গঠিত টাস্কফোর্সের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী প্রতিনিধির মেলবন্ধন জরুরি। টাস্কফোর্সের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের সরাসরি যোগসূত্র স্থাপন অভ্যন্তরীণ জটিলতা নিরসনে সহায়তা ভূমিকা পালন করবে।

বর্জ্য অব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ দূষণের দায় চামড়া খাতে দুর্দশায় মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। বর্জ্য শোধনের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিবেশ দূষণের দায় থেকে এ শিল্পকে মুক্ত করতে হবে, পরিবেশবান্ধব শিল্প হিসেবে গড়ে তোলার মাধ্যমে বিকাশের পথে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে চামড়া শিল্পকে।

চামড়া খাতের সকল সমস্যা সমাধান ও যথাযথ পরিচর্যার মাধ্যমে এ-শিল্পকে যথার্থভাবে দাঁড় করানো গেলে বিপুল কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে, চাপ কমবে বাংলাদেশি শ্রমবাজারে, ফলে বেকারত্বের সংকট অনেকাংশে দূর হবে।

করোনাকালীন সময়ে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ ক্রান্তিলগ্নে এসে পৌঁছেছে। মহামারির সময়কাল আরও স্থায়ী হলে বাংলাদেশের স্থবির অর্থনীতি আরও সংকটাপন্ন হয়ে উঠতে পারে। অনাগত আশঙ্কা নিরসনকল্পে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সকলে চামড়া খাতে আরও বেশি মনোযোগ দিয়ে চামড়া শিল্পে সুদিন ফিরিয়ে আনবেন, সেই অপেক্ষায় বাংলাদেশ।

লেখক: শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ