একটি স্বপ্নের ব্যাগ ও একজন আড়ালের কারিগর

প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।

কর্মব্যস্ত নগরীতে একটা দৃশ্য খুবই সাধারণ। স্কুলের বাচ্চারা বিশাল এক বইয়ের ব্যাগ কাঁধে চড়িয়ে হেঁটে যাচ্ছে। কখনোবা সেই ব্যাগ চড়ছে মা–বাবার কাঁধে। সন্তান-অভিভাবক দুইয়েরই হাঁসফাঁস অবস্থা ‘বিদ্যার বোঝা’ টানতে টানতে। আদতে এই ‘বিদ্যার বোঝা’ কতটুকু কার্যকর, তা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়ে যায়। তাই সেদিকে আর না এগোনোই শ্রেয়।

এই চিরপরিচিত দৃশ্যের মধ্যেই একটা ছবি ভীষণ মন ভালো করে করে দিতে পারে। অনেক চেষ্টা করেও চিত্রগ্রাহকের নামটা খুঁজে পাওয়া গেল না বলে দুঃখিত। তবে তিনি শুধু একটা ছবি নয়, একটা বাঁকবদলের গল্পকে ফ্রেমবন্দী করেছেন।

ছবিতে দেখা যাচ্ছে, একজন মা তার ছেলেকে ক্রিকেট অনুশীলনের জন্য মাঠে নিয়ে যাচ্ছেন। ছেলেটা মনের আনন্দে যেন দুহাত মেলে উড়ে চলছে। ক্রিকেট সরঞ্জামের ভারী ব্যাগটা ছেলের বদলে মা বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এবং এই ব্যাগটা নিঃসন্দেহে ‘বিদ্যাবোঝাই ব্যাগ’–এর তুলনায় বেশ ভারী। আর গল্পের মূল টুইস্টটা এখানেই।

ছোট্ট ছেলেটা কি ব্যাগটা নিজে বয়ে নিয়ে যেতে পারত না? অবশ্যই পারত। এতে কি তার কষ্ট হতো না? উত্তরটা হচ্ছে ‘না, হতো না’। কারণটা জানেন কি?

এই ব্যাগটা ছেলেটার স্বপ্ন দিয়ে ভরা। সেই স্বপ্নের ভারী ওজনও তার কাছে নস্যি। আর তার মা এই ব্যাগ নিজ কাঁধে তুলে নিয়ে ছেলেকে একটা অমূল্য ম্যাসেজ দিলেন যে ‘তোর এই স্বপ্নযাত্রায় আমি পাশে আছি।’

বিশ্বাস করুন, স্রেফ এই ছোট্ট একটা ভরসার বার্তার অভাবেই যে রোজ কত স্বপ্নের অকালমৃত্যু ঘটছে, কত সম্ভাবনাময় প্রতিভা হারিয়ে যাচ্ছে, তা কল্পনারও বাইরে।

আমাদের অভিভাবকেরা তাঁদের নিজেদের অপূর্ণ ইচ্ছার বাস্তবায়ন করার জন্য সন্তানের সেই ভারী ‘বিদ্যাবোঝাই ব্যাগ’ মাইলের পর মাইল টানতে রাজি, অথচ সন্তানের চাওয়া-পাওয়ার কথাটা শুনতে পর্যন্ত রাজি নন।

অথচ আপনারা শুধু একটিবার সন্তানের কাঁধে হাত রেখে তার স্বপ্নযাত্রায় ভরসাটা দিন না! দেখবেন আপনার সন্তানের মধ্যে কী পরিমাণ মানসিক শক্তির সঞ্চার হয়। তার নিজের পছন্দের পথচলা কখনোই মসৃণ হবে না। অনেক বাধা-বিপত্তি, প্রতিকূলতা আসবে, কঠিন সময় আসবে। কিন্তু জানপ্রাণ দিয়ে হলেও সে যেকোনো মূল্যে সেই পথ উতরে যাবে। স্রেফ নিজের স্বপ্ন ছোঁয়ার নেশা আর আপনার ভরসার জোরেই!

বলছি না যে সন্তান সব সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে। বয়স ও অভিজ্ঞতার অভাবে অনেক কিছুই তার অজানা থাকতে পারে। কিন্তু সে জন্য তার ওপর মোটেও বল প্রয়োগ করবেন না দয়া করে। প্রথমে তার পয়েন্ট অব ভিউ ও যুক্তিগুলো শুনুন এবং তাতে ভুল কিছু থাকলে সেগুলোকে তুলে ধরে আপনার যুক্তিগুলো দিয়ে সরলভাবে তা বারবার বুঝিয়ে বলুন। এতে অবশ্যই তার মনে কোনো দ্বিধা থাকবে না এবং সে অত্যন্ত সহজেই বুঝবে। তবে অবৈধ বা অনৈতিক কোনো ইচ্ছা বাদে অন্য যেকোনো ইচ্ছাকেই ‘হ্যাঁ’ বলা উচিত, তাতে যতই বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হোক না কেন। জীবনটা অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটা সময়। এই ক্ষুদ্র সময়টা সন্তানকে আপন মনে সাজিয়ে নিতে দিন ও পাশে থাকুন। আপনি ও আপনার সন্তান হাত ধরাধরি করে সুখের চূড়ায় একদিন নিশ্চিতভাবেই উঠবেন।

অন্যথায়, আপনার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে নিজের স্বপ্নকে বলি দিয়ে আপনার সন্তান হয়তোবা অনেক বড় কিছু হবে। অনেক অর্থ আয় করবে, আপনাদের সুখী করবে এবং নিজেও সুখী হওয়ার ভান করবে। তবে শৈশবকালের সেই ছোট্ট মনের ডানা ছেঁটে ফেলার আক্ষেপ তাকে সারা জীবন ধরে মনের ভেতর পোড়াবে। এমনও হতে পারে, এই আক্ষেপ জেদে পরিণত হয়ে সেও তার সন্তানের ওপর তার নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেবে। এমন ঘটনা আমাদের চারপাশে অহরহই ঘটছে।

এই ঘুণে ধরা সমাজব্যবস্থায় সন্তানের স্বপ্নের ব্যাগ কাঁধে তুলে নেওয়া অভিভাবকের সংখ্যা প্রায় নেই বললেই চলে। তবে যেই গুটিকয়েক নেপথ্যের কারিগরেরা ভরসার হাত বাড়িয়ে দিয়ে সাহস জোগান, মনের অন্তঃস্থল থেকে তাঁদের স্যালুট জানাই।