করোনা কি চলে গেছে

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

সাত মাসের বেশি সময় বিশ্ব কোভিড-১৯ ভাইরাসের মহামারিতে টালমাটাল। বাংলাদেশের মানুষ চার মাসের বেশি সময় ধরে করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করে চলছে। শুরুতে আমরাও অপরিচিত এ রোগের সংক্রমণ ঠেকাতে অন্যান্য দেশের মতো লকডাউন, সাধারণ ছুটি, জনচলাচলে সীমাবদ্ধতা তৈরি ইত্যাদি বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করেছি; কিন্তু জীবিকার তাগিদে ও করোনার কারণে সৃষ্ট সার্বিক অর্থনৈতিক অচলাবস্থাকে গতিশীল করতে সরকার ধাপে ধাপে জনজীবনকে স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, স্বাস্থ্যবিধি মেনেই সবকিছু করার জন্য। স্বাস্থ্যবিধিগুলো কী, তা কমবেশি আমরা সবাই জানি। যেমন: অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করা, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার মেনে চলা আর বারবার হাত ধোয়া। কিন্তু এবার ঈদুল আজহার আগে-পরে মানুষের উৎসাহ–উদ্দীপনা আর চলাফেরা দেখে মাঝেমধ্যে মনে হয়েছে, করোনো বলে আসলে কি কিছু ছিল বা থাকলেও মনে হয় এখন নেই।

দীর্ঘদিনের চেনা জীবনে করোনা যখন মানুষের জীবনযাপন পরিবর্তন করে দিচ্ছিল, ঈদুল আজহার সময় রাস্তায় মানুষের স্বাভাবিক চলাচল দেখে মনে হলো ভাবখানা এমন, যেন কোনো কিছুরই পরোয়া করি না। ইংরেজিতে যেমন আমরা বলি ‘হু কেয়ারস’। নেই কোনো মাস্ক, নেই কোনো শারীরিক দূরত্ব। রাস্তায়, দোকানে ও ফুটপাতে অনেক মানুষের মধ্যেই কোনো কোনো ধূমপায়ী ধূমপান করে যাচ্ছেন। কোরবানির পশুর হাটে তো কোনো উপায়ও ছিল না স্বাস্থ্যবিধি মানার। তা–ও যতটুকু সম্ভব ছিল অন্তত মাস্ক পরার, তা–ও পরেনি অনেক মানুষ। কে মানাবে কাকে? নিজেই যদি নিজের ভালো না বুঝি।

আবার কিছু কিছু মানুষ মাস্ক পরতে দেখা যায়, কিন্তু তা মুখে না থেকে থাকে মুখের নিচে চিবুকে। মাস্ক ব্যবহার না করলে যদিও জরিমানা করার বিধান রাখা হয়েছে, কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে যদি করোনার প্রাদুর্ভাবের এত দিন পরেও রাস্তায় দাঁড়িয়ে মানুষকে মাস্ক পরাতে আইনের প্রয়োগ করতে হয়, তাহলে নিজেদের বিবেকহীন জীব হিসেবেই পরিচয় দিতে হবে। গণপরিবহন চলাচলে কিছু নিয়ম বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। গণপরিবহনে সিটে জীবাণুনাশক স্প্রে করাসহ যাত্রীদের জীবাণুনাশক দিয়ে হাত পরিষ্কার করার নিয়ম ছিল, সেই সঙ্গে পাশাপাশি সিটে যাত্রী নেওয়ার বিষয়ে এখনো বিধিনিষেধ আছে। কিন্তু এখন নগরের অনেক গণপরিবহনেই যাত্রীদের মধ্যে কোনো দূরত্ব না রেখেই অনেকটাই আগের মতো যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে, ভাড়া কিন্তু করোনার জন্য নির্ধারিত বাড়তি ভাড়াই। এতে ঝুঁকি যেমন বাড়ছে, তেমনি মানুষের মধ্যে তৈরি হচ্ছে অসচেতনতা। শুরুর দিকে দোকানপাট বা মার্কেটে প্রবেশের সময় হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা জীবাণুনাশক স্প্রে করার অনেক কড়াকড়ি ছিল, তাপমাত্রাও মাপা হতো জনে জনে। এখন আস্তে আস্তে তা–ও শিথিল হচ্ছে। অনেক দোকানির মুখেও মাস্ক নেই। ক্রেতাদের মধ্যেও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার কোনো কড়াকড়িও নেই। এমন পরিস্থিতি দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, করোনা কি চলে গেছে? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে সব সময় করোনার ব্যাপারে বলা হতো, ‘আতঙ্কিত নয়, সচেতন হোন’। আমরা সবাই এই বার্তার প্রথম অংশটি গ্রহণ করেছি, শেষাংশটি এখনো গ্রহণ করতে পারিনি। বিগত চার মাসে আক্রান্ত হইনি, এই ধারণা থেকে আক্রান্ত হবই না, এমন আত্মবিশ্বাসী হয়ে যাওয়ার মতো অসচেতনতাও অনেকের মধ্যে তৈরি হয়েছে, যা মোটেও কাম্য নয়।

বলা হয়ে থাকে, কোনো অভ্যাস গড়তে বা কোনো অভ্যাস ত্যাগ করতে ২১ দিন সময় লাগে এবং তা স্থায়ীভাবে মানুষের অভ্যাসে পরিণত হতে ৯০ দিন সময় লাগে। কিন্তু আমরা দীর্ঘ চার মাস বা ১২০ দিনের অধিক সময় করোনার জন্য যেসব স্বাস্থ্যবিধি মানা উচিত, তার চর্চা করেও এখনো অভ্যাসে পরিণত করতে পারিনি। অভ্যাস পরিবর্তনের প্রচলিত তত্ত্বটিও আমাদের ক্ষেত্রে অকার্যকর হতে যাচ্ছে। সামাজিকভাবে কোনো অভ্যাস প্রচলনের বিষয়টিও অনেকটা মনস্তাত্ত্বিক। এটিও ভাইরাসের মতো একজন থেকে অন্যজনে সংক্রমিত হয়। শুরুতেই অনেকেই যখন মাস্ক পরা শুরু করেছে, দেখাদেখি বাকিরাও মাস্ক পরা এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মানা শুরু করেছে। এখন যখন কেউ কেউ মাস্ক পরা ছেড়ে দিচ্ছে, দেখাদেখি অনেকেই মাস্ক পরার অভ্যাস ত্যাগ করছে। করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবনযাত্রা, ব্যবসা–বাণিজ্যে, পেশাগত জীবনে যে পরিবর্তন এসেছে, সেই পরিবর্তিত পরিস্থিতে মানুষ যেভাবে নতুন করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে জীবন-জীবিকাকে সাজাচ্ছে, তার নাম দেওয়া হচ্ছে নিউ নরমাল। কিন্তু মানুষের অসচেতন চলাফেরা, ব্যক্তিজীবনের অসাবধানতা, সবকিছুকেই অ্যাবনরমাল করে দিতে পারে। বিশ্বের প্রতিটি দেশ করোনার থেকে রক্ষা পেতে মরিয়া হয়ে আছে। দিনরাত চলছে একটি কার্যকর ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের। এরই মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আশঙ্কা করছে, আগামী দুই বছর বিশ্বকে করোনার সঙ্গে বাস করতে হবে। যেহেতু আমাদের হাতে এখনো কোনো প্রতিষেধক নেই, তাই প্রতিকারই একমাত্র হাতিয়ার। স্বাস্থ্যবিধি মানাই হচ্ছে একমাত্র কার্যকর পদক্ষেপ। আমাদের দেশে বিভিন্ন কারণে করোনা পরীক্ষার হার কমেছে, কিন্তু সরকারি হিসাবে কমেনি রোগী শনাক্তের গড়হার। প্রতিদিনের গড় মৃত্যুর হারও গত চার মাস থেকে প্রায় একই।

পার্শ্ববর্তী ভারতেও করোনার প্রকোপ অনেক বেড়েছে। কিছু দেশে করোনার বিধ্বংসী চেহারার পর প্রকোপ কমলেও বিশ্বব্যাপী প্রকোপ এখনো কমেনি। কিছু কিছু দেশে দ্বিতীয়বারের মতো (সেকেন্ড ওয়েভ) হানা দিচ্ছে করোনাভাইরাস। আশঙ্কা করা হচ্ছে, সেকেন্ড ওয়েভে করোনার প্রকোপ হতে পারে আরও ভয়াবহ। তাই এই ভাইরাস একেবারেই নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে সচেতনভাবে জীবন যাপন করার কোনো বিকল্প নেই। মনে রাখতে হবে, নিজের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিজেকেই নিতে হবে। জীবিকার জন্য যেমন আমাদের ঘর থেকে বের হতেই হবে, তেমনি সুস্থ জীবনের জন্য স্বাস্থ্যবিধি মানতেই হবে, পরিণত করতে হবে অভ্যাসে। তবেই সুরক্ষিত হবে মানুষ, সমাজ ও দেশ।


*অফিসার, ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড, সিডিএ অ্যাভিনিউ শাখা, চট্টগ্রাম