অনেকটা অভিমান করে নিউইয়র্কে হীরা

শফিকুল হক হীরা
শফিকুল হক হীরা

সবাই এখন উদিত সূর্যের পূজারি। পুরোনোকে ছুড়ে দেওয়াই হয়তো নিয়ম। নয়তো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অধিনায়ক শফিকুল হক হীরা কেন ক্রিকেট বোর্ডে অবহেলিত হতে যাবেন? শুধু প্রথম অধিনায়কই নন, বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সবচেয়ে সফল ম্যানেজার তিনি। জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার প্রবর্তনের পরে প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে এই সম্মান পান। সম্প্রতি তিনি বেড়াতে এসেছিলেন নিউইয়র্কে। এখানে আসার পরে ওনার সম্মানে বাংলাদেশ স্পোর্টস কাউন্সিল অব নর্থ আমেরিকা এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। পরে জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশনও শফিকুল হীরাকে সংবর্ধিত করে। অনেকটা অভিমান বুকে নিয়ে নিউইয়র্কে এসেছিলেন তিনি। অভিমানের পাশাপাশি সালমান শাহের আত্মহত্যা নিয়ে নতুন করে আলোচনায় বিপাকে ছিল তাঁর পরিবার। সব মিলে এবারের আমেরিকা সফর ছিল শফিকুল হীরার জন্য মানসিকভাবে নিজেকে উজ্জীবিত করার জায়গা।
সোমবার দেশে ফিরে যাওয়ার আগে প্রথম আলোর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে বললেন অনেক ক্ষোভের কথা। জানালেন, বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের চলতি দক্ষিণ আফ্রিকা সফর নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ। বিসিবিতে তাঁর বর্তমান পোস্ট হাই পারফরমেন্স কমিটির প্রধান পরামর্শক। পদটা শুধু নামেই আছে। বাস্তবে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। এই নিয়ে বেশ কয়েকবার বিসিবিকে জানিয়েও কোনো ফল পাননি শফিকুল হীরা। দায়িত্ব নেওয়ার সাত মাসেও কোনো সভা ডাকা হয়নি। অবশেষে তিনি পদত্যাগপত্র জমা দেন। তারপরও কোনো সাড়া শব্দ নেই। তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হলো, নাকি হলো না, এই ব্যাপারেও কিছু জানানো হয়নি। পুরো বিষয়টি তাঁকে বেদনা দিয়েছে। এই বাহাত্তর বছর বয়সে এসে প্রিয় ক্রিকেট বোর্ড থেকে এমন ব্যবহার তিনি আশা করেননি। পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার পরে শফিকুল হীরার সঙ্গে ক্রিকেট বোর্ডের সম্পর্ক এখন কেবল কাউন্সিলর হিসেবে।
শুধু বোর্ড নয়, বিপিএলে (বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ) ও উপেক্ষিত শফিকুল হীরা। প্রথম বিপিএলে ঢাকা গ্ল্যাডিয়টর্সের উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। যে বার মাশরাফি বিন মর্তুজার নেতৃত্বে ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্স চ্যাম্পিয়ন হয়। পরের বার তাঁর ভূমিকায় দেখা যায় আরেক সাবেক ক্রিকেটার সানোয়ার আহমেদকে। যার সময় ঘটে মোহাম্মদ আশরাফুলের ম্যাচ পাতানোর অভিযোগে অস্বীকৃতির ঘটনা। তিনি দায়িত্বে থাকলে এমন ঘটনা কখনো হতো না বললেন শফিকুল হীরা।
অবহেলা-উপেক্ষা সত্ত্বেও জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রতিটি পদক্ষেপ আন্তরিক ভালোবাসায় অনুসরণ করেন। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে বাংলাদেশের ভরাডুবির কারণ হিসেবে তাঁর ক্ষুরধার বিশ্লেষণ হলো-‘দক্ষিণ আফ্রিকায় যে দলটা গেছে সেখানে টেস্ট সিরিজে সাকিব আল হাসান না থাকায় ও তামিম ইকবাল দল দুর্বল হয়ে যায়। যারা খেলেছে, তারা আগের দিনও জানত না তাদের ব্যাটিং অর্ডার কত নম্বরে। এই অনিশ্চয়তা প্রভাব ফেলেছে তাদের খেলায়। রুবেলকে কেন প্রথম টেস্টে খেলানো হলো না আমি জানি না। তাসকিনের জায়গায় রুবেলের অভিজ্ঞতা আরও কাজে লাগত।’
দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে বাঁ হাতি একজন স্পিনার খুব প্রয়োজন ছিল বলে জানালেন শফিকুল হীরা। বললেন, ‘প্রোটিয়াসদের টপ অর্ডার ব্যাটিংয়ে প্রথম ছয়জনই ডান হাতি। যেহেতু সাকিব ছিল না, মেরাজের ওপর চাপ পড়েছে বেশি। তিনজন সিমার খেলানোর কোনো কারণ ছিল না। দুজন স্পিনার নেওয়া যেত। সে ক্ষেত্রে তাইজুল আসতে পারত। বাম হাতি স্পিনার যে কতখানি কার্যকর মমিনুলের বোলিংই তার প্রমাণ। নেটে সম্ভবত ও ১০ / ১২ ওভার বল করারও সুযোগ পায় না। অথচ সেই মমিনুলই তিন উইকেট নিল।’
প্রথম টেস্টে টসে জিতে কেন ব্যাটিং নিল না বাংলাদেশ দল, এটা পুরো দেশবাসীর মতো শফিকুল হীরাও প্রশ্ন, ‘ফিল্ডিং নেবার সিদ্ধান্ত কে নিল, সেটাই আমি জানতে চাই? অধিনায়ক মুশফিক, নাকি কোচ হাথুরাসিংহে, নয়তো কি ম্যানেজার মিনহাজুল আবেদিন নান্নু? এটা আমার কাছে স্পষ্ট হয়নি। যে দলে দুজন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় অনুপস্থিত, তাদের ব্যাটিং নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ ছিল।’ সাকিব আল হাসানকে টেস্ট সিরিজে কেন ছুটি দেওয়া হলো, এই নিয়ে বেশ উষ্মা প্রকাশ করলেন শফিকুল হীরা। ‘অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সিরিজ খেলার পরে সে তো ২২ দিন ছুটি পেয়েছে। তারপর কেন তাঁর ছুটির দরকার পড়ল, আমার মাথায় আসে না। আর প্রতিপক্ষ যেখানে দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দল! তাদের সঙ্গে নিজেদের সেরাটা দিয়েই তো আমাদের লড়াই করার কথা। জিম্বাবুইয়ে কিংবা ওয়েস্ট ইন্ডিজ হলেও একটা কথা হতো। কারণ এখন তারা ক্রিকেটের সাফল্যে আমাদের চেয়ে পিছিয়ে আছে।’
সালমান শাহের মৃত্যুর ঘটনায় কিছুদিন আগে আমেরিকায় রুবি নামে, সামিরার এক পারিবারিক বন্ধু বেশ আলোড়ন তুলেছিল। উনি এক ভিডিও বার্তায় জানান, সালমান শাহকে হত্যা করা হয়েছে। সামিরা, আজিজ মোহাম্মদ ভাই ও আরও অনেকে মিলে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। পরে রুবি আবার পুরো ঘটনা অস্বীকার করলেও সালমানের মা নীলা চৌধুরী পুনরায় তদন্ত করতে বলেন। এই নিয়ে শফিকুল হীরা বলেন, ‘রুবি একজন মানসিকভাবে অসুস্থ মহিলা। ওর কথার কোনো গুরুত্ব নেই। আর আমি নীলা চৌধুরীর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছি।’
শফিকুল হক হীরা আরেকটি পরিচয় উনি একজন টি টেস্টার। বাংলাদেশে তাঁর মতো হাতে গোনা দু-একজন আছেন যারা চায়ের স্বাদ পরীক্ষা করতে পারেন। পঞ্চাশের দশক থেকে অবসর নেওয়া পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন দেশি ও আন্তর্জাতিক চা কোম্পানিতে দীর্ঘদিন চাকরি করেছেন।