ক্যাবচালকদের ন্যূনতম মজুরি ঘণ্টায় ১৭ ডলার

নিউইয়র্ক নগরের মেয়র বিল ডি ব্লাজিওর স্বাক্ষরের মাধ্যমে আমেরিকার প্রথম নগরী হিসেবে নিউইয়র্কে উবার, লিফটের মতো প্রযুক্তি নির্ভর ট্যাক্সিক্যাবের ওপর নিয়ন্ত্রণ কার্যকর হয়েছে। ১৪ আগস্ট থেকে আইনটি কার্যকর হয়েছে। আগামী এক বছর নিউইয়র্ক নগরে নতুন কোনো উবার, লিফট বা অ্যাপসভিত্তিক ট্যাক্সি চালানোর অনুমতি দেওয়া হবে না। এর আগেই ট্যাক্সি ও লিমোজিন কমিশন নতুন কোনো ট্যাক্সি ম্যাডেলিয়ন বিক্রি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে। এই আাইনে প্রথমবারের মতো নিউইয়র্কের ট্যাক্সি চালকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করা হয়েছে। অক্টোবর থেকে তাঁদের ন্যূনতম মজুরি ঘণ্টায় ১৭ দশমিক ২০ ডলার কার্যকর হবে।
সিটি কাউন্সিলে গৃহীত প্রস্তাবিত আইনে স্বাক্ষর করে মেয়র ডি ব্লাজিও বলেন, ‘নগরীর এক লাখ ট্যাক্সিক্যাব চালকের কথা আমরা চিন্তা করেছি। করপোরেট স্বার্থের আগে এসব পরিশ্রমী ক্যাবচালকদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।’ 

উবার, লিফটের মতো অ্যাপসভিত্তিক ট্যাক্সিক্যাব রাস্তায় নামার পর নিউইয়র্কে ক্যাবচালকদের জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। যারা গত তিন দশকের বেশি সময় ধরে ক্যাব চালানোর পেশায় ভালো করছিলেন, তাদের বেঁচে থাকার লড়াই শুরু হয়। পেশাগত উৎকণ্ঠা থেকে অন্তত ছয়জন ক্যাবচালক আত্মহত্যা করে। একের পর এক আত্মহত্যা আর টানা প্রতিবাদের মুখে নগরীর আইন প্রণেতারা নড়ে চড়ে বসতে বাধ্য হন। উবারের মতো বড় কোম্পানি নিউইয়র্কে আইন প্রণেতাদের থামাতে অনেক চেষ্টা করে। বিশাল অঙ্কের অর্থ দিয়ে লবিং করা ছাড়াও তারা সংকটে থাকা ক্যাবচালকদের জন্য বিকল্প তহবিলের প্রস্তাব দেয়। কোনো কিছুতেই কোনো কাজ হয়নি।
নিউইয়র্ক নগরে অ্যাপসভিত্তিক গাড়ির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে আগামী এক বছর নিবন্ধন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তকে জনগণের বিজয় হিসেবে দেখছেন মেয়র বিল ডি ব্লাজিও। নতুন এই আইনকে ঠেকাতে সব ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়েছে অ্যাপসভিত্তিক ট্যাক্সি কোম্পানিগুলো। একসময় নিউইয়র্ক নগরে দাপট দেখানো সেই ইয়েলো ক্যাবই কঠিন সংকটের মুখে। অ্যাপসভিত্তিক ক্যাবের কাছে হেরে যাচ্ছেন তাঁরা। ইয়েলো কিংবা গ্রিনক্যাব যেমন সব নিয়ম-কানুন মেনে, কর দিয়ে চালাতে হয়, উবার, লিফট, জুনুর মতো অ্যাপসভিত্তিক ট্যাক্সি সেবায় তার দরকার নেই।
নিউইয়র্কে বর্তমানে এক লাখ ৮০ হাজার টিএলসি ড্রাইভার থাকলেও নিবন্ধিত গাড়ি আছে এক লাখ ৩০ হাজার। এর মধ্যে ১৩ হাজার ৫৫৭টি ম্যাডেলিয়ন। আর অ্যাপসভিত্তিক শুধু উবারের সংখ্যাই ৬০ হাজারের বেশি। প্রতি মাসেই দুই হাজার ফর হায়ার ভেহিকল রাস্তায় নামছে। নিউইয়র্ক ট্যাক্সি ওয়ার্কার অ্যালায়েন্স বলছে, গেল ৫ বছরে তাদের আয় নেমে এসেছে অর্ধেকেরও কমে। ইয়েলো ক্যাবসহ সব ধরনের ক্যাবচালকদের আয়ের নিরাপত্তা ও সমতা বিধানের লক্ষ্যে আন্দোলন করে আসছে ট্যাক্সি অ্যালায়েন্স ইউনিয়ন। দাবি ছিল, সব ধরনের ট্যাক্সির জন্য একই ন্যূনতম ভাড়া নির্ধারণ, ম্যাডেলিয়নের মতো অ্যাপসের ভাড়া গাড়ির সংখ্যাও নির্দিষ্ট করে দেওয়া, ক্যাবিদের জন্য বেকার ভাতার সুবিধা। নতুন আইনে সব দাবিই থাকছে। আর এটি কার্যকর হবে আগামী অক্টোবর থেকে।
আগামী এক বছর নিউইয়র্ক নগরে নতুন কোনো গাড়ির নিবন্ধন করাতে পারবে না উবারসহ অ্যাপসভিত্তিক কোম্পানিগুলো। মেনে চলতে হবে ম্যাডেলিয়ন গাড়ির নিয়মও। নতুন আইনকে জনগণের বিজয় হিসেবেই দেখছেন কাউন্সিল মেম্বাররা।
ট্যাক্সি ওয়ার্কার্স অ্যালায়েন্সের চেয়ারপারসন ভৈরবী দেশাই বলেন, উবার-লিফটের মতো করপোরেট গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জয়ের মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে, ক্ষমতা বা অর্থ নয়, মানবতাই সবার আগে।
প্রস্তাবিত নতুন আইনের দীর্ঘ মেয়াদি ফল নিয়ে সন্দেহ থাকলেও ১৪ আগস্ট দেওয়া এক বিবৃতিতে নিউইয়র্ক ট্যাক্সি অ্যালায়েন্স বলেছে, হাজার হাজার অভিবাসী পরিবার যে অর্থনৈতিক সংগ্রাম করছে, এ আইন বাস্তবায়ন হলে তার কিছুটাও লাঘব হবে।
উবারের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, নিউইয়র্ক নগরের মেয়র ডি ব্লাজিও সময় না নিয়েই দ্রুত এই আইন পাশ করেছেন। এর ফলে উবারের অনেক চালক ক্ষতির মুখে পড়বেন।
এদিকে ১৪ আগস্ট নিউইয়র্ক নগরে উবার চালানোর অনুমতি গ্রহণের শেষ দিন থাকায় কুইন্সে উবার অফিসের সামনে দেখা গেছে দীর্ঘ লাইন। শেষ মুহূর্তে আরও ১০ হাজারের বেশি উবার নিউইয়র্কে চালানোর অনুমতি গ্রহণের জন্য আবেদন জানানো হয়েছে।
পাস হওয়া আইন কীভাবে সংকটে থাকা ক্যাব ইন্ডাস্ট্রিকে সাহায্য করবে, তা এখন দেখার বিষয়। পাঁচ বছর আগেও নিউইয়র্কে হলুদ ক্যাবের ম্যাডেলিয়ন (নগরীর ক্যাব পরিচালনা লাইসেন্স) ১০ লাখ ডলারের বেশি ছিল। এসব ম্যাডেলিয়নে বিনিয়োগ করেছেন ক্যাবিরা। নিজেদের জীবনের সব সঞ্চয় উজাড় করে তারা ম্যাডেলিয়ন কিনে জীবিকা চালাচ্ছিলেন। ধস নামার পর এসব ম্যাডেলিয়নের বাজার মূল্য দুই লাখ ডলারে নেমে আসে। আশা করা হচ্ছে, এখন আবার এর মূল্য বাড়বে। এক সময় দিনের ১০ ঘণ্টা কাজ করে যে ক্যাবিরা ৩০০ ডলার আয় করতে পারতেন, এখন তারা করছেন ১৫০ ডলার। হাজার হাজার অ্যাপসভিত্তিক ট্যাক্সির কারণে সেবা দেওয়ার জন্য যাত্রী সংকট বিরাজ করছে। হোটেল বা বিমানবন্দরে একজন যাত্রীর জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন দিচ্ছেন ক্যাবিরা।
নিউইয়র্কে ক্যাব চালকদের অধিকাংশই অভিবাসী। এর মধ্যে সব ধরনের ট্যাক্সি মিলে প্রায় ৪০ হাজার বাংলাদেশি কোনো না কোনোভাবে এ পেশার সঙ্গে জড়িত। সাম্প্রতিক সময়ে এ পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে ছিলেন। ট্যাক্সিক্যাবের সঙ্গে ড্রাইভিং স্কুল, ওয়ার্কশপ, বিমা, লাইসেন্সিং নিয়ে বহু বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে নিউইয়র্কে। নতুন আইন প্রণয়নের ফলে সবাই উপকৃত হবেন এবং এ খাতে আবার চাঞ্চল্য ফিরে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।
অ্যাপসভিত্তিক নতুন গাড়ির নিবন্ধন এক বছর বন্ধ রাখার পর এবার পার্কিংয়ের মিটার রেট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিউইয়র্ক নগর প্রশাসন। সর্বপ্রথম ব্রুকলিনে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। এরপর ধাপে ধাপে অন্যান্য বরোতেও মিটার রেট বাড়ানো হবে। ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২ থেকে ৪ ডলার পর্যন্ত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বাড়বে ম্যানহাটনে। সেপ্টেম্বর থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। যাত্রী পার্কিংয়ের ভাড়াও বাড়ছে। ঘণ্টায় সাড়ে তিন ডলার থেকে বেড়ে সাড়ে চার ডলার করা হচ্ছে। সঙ্গে প্রতি ঘণ্টায় যোগ হবে বাড়তি ভাড়া।
ম্যানহাটনের বাণিজ্যিক এলাকায় দ্বিতীয় ঘণ্টা থেকে সাড়ে ৭ ডলার পর্যন্ত করা হচ্ছে। পার্কিং মিটারের ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্তে অবশ্য মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন শহরবাসী। ব্রঙ্কস, ব্রুকলিন, কুইন্স ও স্ট্যাটেন আইল্যান্ডেও ঘণ্টায় ১ থেকে ২ ডলার পর্যন্ত ভাড়া বাড়ানো হচ্ছে। ব্রুকলিনে ৪ সেপ্টেম্বর থেকে, ম্যানহাটনে ১ অক্টোবর এবং কুইন্সে ১ নভেম্বর থেকে পার্কিং মিটারের রেট বাড়ানো হবে। ব্রঙ্কস ও স্ট্যাটেন আইল্যান্ডে মিটার ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে ৩ ডিসেম্বর থেকে।