নিউইয়র্কে 'ব্রাজিলিয়ান ডে' উৎসব

নিউইয়র্কে ‘ব্রাজিলিয়ান ডে’তে হাজারো মানুষের ভিড়
নিউইয়র্কে ‘ব্রাজিলিয়ান ডে’তে হাজারো মানুষের ভিড়

ছুটির দিনে, বিশেষত রোববারে, আমরা-কবি মাহবুব হাসান, শিশুসাহিত্যিক নসরত শাহ আর আমি-তিনজন নিউইয়র্কের জাদুঘরে জাদুঘরে ঘুরে বেড়াই। যদি বলি পথে পথে ঘুরে বেড়াই তাহলেও বোধ হয় বাড়িয়ে বলা হবে না। আমাদের এই ঘুরে বেড়ানোর উদ্দেশ্য নিউইয়র্ক নগরীকে ভালো করে জানার আনন্দ লাভ।
শিল্প আস্বাদনে নিজের যোগ্যতা বাড়াতে হলে কিংবা ইতিহাস বোধকে শাণিয়ে নিতে হলে জাদুঘর দেখার বিকল্প নেই! ভ্রমণে এলে পরিকল্পনা মাফিক নির্দিষ্ট কয়েকটা জাদুঘরে কোনো রকমে একটা চক্কর দিয়ে ফিরে যাওয়া হয়। বাংলাদেশের কাছাকাছি কয়েকটা জাদুঘরে এমনি ঢুঁ-ও মেরেছি আমি। সব সময়ই অনুভব করেছি-এভাবে হবে না, জাদুঘরে বারবার যেতে হবে। জাদুঘর দেখতে হয় তাড়িয়ে তাড়িয়ে। ভাবতাম যদি কখনো নিউইয়র্কে যাওয়া হয় তাহলে নিউইয়র্ক নগরীর জাদুঘরগুলো দেখব-বাংলাদেশে থাকাকালেই এমনটা ভেবে রেখেছিলাম।
আড্ডায় বসে কথা বলতে বলতেই একদিন ঘুরে বেড়াবার এই পরিকল্পনা নিয়েছিলাম আমরা। আমাদের তিনজনের মধ্যে বাংলাদেশে একসময়ের বেশ সক্রিয় শিশুসাহিত্যিক নসরত শাহ দীর্ঘকাল ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। কবি মাহবুব হাসানও আছেন বেশ ক বছর হয়ে গেল। আমি আছি সবচেয়ে কম সময় ধরে। অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমরা নসরত শাহকেই দলনেতা মেনেছি। তিনি থাকেন কানেকটিকাটে। আমরা দুজন থাকি কুইন্সে। তিনজনে চেষ্টা করি প্রতি রোববারে একত্র হতে। এমনি এক রোববার ছিল ২ সেপ্টেম্বর ২০১৮। ঠিক সকাল এগারোটার দিকে আমরা একত্র হব ব্রায়ান্ট পার্কে। তারপর শুরু হবে আমাদের ভ্রমণ! তবে এই ভ্রমণ সরাসরি জাদুঘর দেখার উদ্দেশ্যে নয়। এবার আমরা নিউইয়র্ক নগরীকেই জাদুঘর হিসেবে বিবেচনা করব। ঘুরব আর জানব ম্যানহাটন বরোকে। এর প্রথম ধাপ হিসেবে ব্রায়ান্ট পার্কের পাবলিক লাইব্রেরি প্রাঙ্গণের বহিরঙ্গন দেখা ও অনুভব দিয়ে আমাদের দিনের কর্মসূচির শুরু হলো। ব্রায়ান্ট পার্কে আমরা কী দেখলাম আর অনুভব করলাম সে কথা আরেকদিন বলা যাবে। আজ বলব সেদিনের ব্রাজিলিয়ানদের আনন্দসঙ্গ নিয়ে।
ফেসবুকের কল্যাণে আমি নিয়মিতই জানতে পারছিলাম যে ‘ব্রাজিলিয়ান ডে’ আসছে। কিন্তু এটাও বুঝতে পারছিলাম, এটা ওদের জনসমাজের নিজস্ব উৎসব। কেমন একটা সংকোচ ছিল মনে। ফলে যাব কি যাব না ঠিক করতে পারছিলাম না। তবে যাওয়ার ইচ্ছেটা ছিল পুরোপুরি। নিয়তি বোধ হয় আমার ইচ্ছেকে বাস্তব করে তুলল। আমরা ব্রায়ান্ট পার্ক থেকে হাঁটতে হাঁটতে ৪৪ স্ট্রিটের কাছাকাছি পৌঁছলাম। ভাবছিলাম কাছাকাছি কী আছে দেখবার। হাঁটতে হাঁটতেই একসময় লক্ষ্য করলাম পুলিশ একটা জায়গায় ব্লক দিয়ে রেখেছে। আমার যে ‘ব্রাজিলিয়ান ডে’ দেখার ইচ্ছে ছিল তখনো আমার সে কথা মনে পড়ছিল না। পুলিশ যেখানে ব্লক করে রেখেছে সেখানে এসে বুঝলাম সেই ইচ্ছাটাই বাস্তব হতে যাচ্ছে। লক্ষ্য করলাম, হলুদ গেঞ্জি ও সবুজ হাফপ্যান্ট পরা অনেক নারী-পুরুষ। জামায় নানা ফ্যাশন থাকলেও ভিড়ের মধ্যে অনেকের পোশাকে হলুদ-সবুজে রঙেরই প্রাধান্য। ব্রাজিলের পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছিল কেউ কেউ। মঞ্চে শিল্পীর গাওয়া গানের সঙ্গে গলা মিলাচ্ছে অনেকেই। তখন মনে পড়ে গেল নিউইয়র্কের ‘ব্রাজিলিয়ান ডে’র কথা। ফেসবুকের বিজ্ঞাপনে তো এ রকম ছবিই দেখতে পাচ্ছিলাম।
গুগল সূত্রে জানলাম ‘ব্রাজিলিয়ান ডে’ সব সময়ই যুক্তরাষ্ট্রের ‘লেবার ডে’র আগের রোববার পড়ে। কেবল তাই নয়, নিউইয়র্ক সিটির ছুটির ক্যালেন্ডারে দিনটির উল্লেখ আছে। ব্রাজিলের স্বাধীনতা দিবসের স্মরণে এই দিনটি উদ্যাপন করা হয়। ১৯৮৪ সাল থেকে এইভাবে নিউইয়র্কে ব্রাজিলিয়ান ডে পালিত হচ্ছে। জেয়াও ডি ম্যাটোস নামে এক ব্রাজিলিয়ানের উদ্যোগে এটি পালন করা শুরু হয়। সেবার শ খানেক ব্রাজিলিয়ান জড় হয়েছিল। এখন ১৫ লাখ মানুষকে এই উদ্যাপন আকৃষ্ট করছে। ২০১৩ সালে দেওয়া এনওয়াইপিডির হিসেব এটা। লং আইল্যান্ড আর নিউ জার্সির লোকজনও যোগ দেয় এতে। এমনকি জাপান ও আফ্রিকা থেকেও উড়ে আসে অনেকে। এয়ারলাইনসের ট্যাগ লাগানো স্যুটকেসসহ আমরাই দেখলাম কয়েকজনকে। ব্রাজিলিয়ানদের উৎসব হলেও অন্য জাতি গোষ্ঠীর মানুষেরাও এই আনন্দ সম্মিলনে যোগ দেয়। এখন ‘দ্য ব্রাজিলিয়ানস’ খবরের কাগজ, টেলিভিশন ‘গ্লোবো ইন্টারন্যাশনাল’ এবং জেয়াও ডি ম্যাটোস যৌথভাবে এই উৎসবের নিয়ন্ত্রক।
গোটা যুক্তরাষ্ট্রে কতজন ব্রাজিলিয়ান থাকে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে ওয়াশিংটন ভিত্তিক একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ব্রাজিল ইনফরমেশন সেন্টারের (বিআইসি) মতে এক মিলিয়নের (১০ লাখ) মতো ব্রাজিলিয়ান রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে। এর মধ্যে নিউইয়র্ক, নিউ জার্সি ও কানেকটিকাট এই তিন রাজ্যেই থাকে তিন লাখের মতো ব্রাজিলিয়ান। আবার তাদেরই মতে এর মধ্যে এক লাখ থাকেন কুইন্সে।
যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী আমাদের দেশের মানুষও সংখ্যায় ব্রাজিলিয়ানদের কাছাকাছি। আমাদের সাংস্কৃতিক ঐক্যের পথ ধরে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশি জনসমাজেরও এমন একটা সর্বজনীন উৎসব থাকতে পারত। তবে তার জন্য দরকার জনসমাজের মধ্যেকার ঐক্য ও পরস্পরের প্রতি আস্থা। কিন্তু আমাদের সমাজ এখনো কৌম সমাজের স্মৃতি বহন করছে। ফলে ছোট ছোট এলাকা থেকে আসা মানুষেরা ছোট ছোট গোষ্ঠী গড়ে তুলছে। বড় ঐক্যের কোনো সম্ভাবনা দেখাচ্ছে না।
তাদের সামগ্রিক শৃঙ্খলা দেখে খুব ভালো লাগল। স্পষ্টভাবেই অনুভব করছিলাম যে, ব্রাজিলিয়ানদের এই আনন্দের উৎসবে উচ্ছ্বাস আর উদ্দীপনা থাকলেও উচ্ছৃঙ্খলতা একেবারেই ছিল না। না হলে গানের তালে তালে তরুণ-তরুণীরা উদ্দাম নৃত্য করলেও কেউ কারও গায়ে হাত দিতে দেখা যায়নি। ভালোবাসার মানুষেরা পরস্পর জড়াজড়ি করে থাকায় যেমন সংকোচ নেই তেমনি তাদের চলন বলনেও সতর্কতা। চলতি পথে কারও গায়ে একটু আধটু ধাক্কা লাগলেও কেউ কারও সঙ্গে লাগিয়ে দিচ্ছিল না ধমকাধমকি বা মারামারি।