নিউইয়র্ক টাইমসে বেনামি লেখক নায়ক না কাপুরুষ?

ডোনাল্ড ট্রাম্প
ডোনাল্ড ট্রাম্প

‘অনৈতিক, অযোগ্য, রাষ্ট্রের স্বার্থের পরিপন্থী’। বুধবার নিউইয়র্ক টাইমস-এ এক নামবিহীন উপসম্পাদকীয়তে ট্রাম্প প্রশাসনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এই অভিযোগ তুলে নিজের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে আঙুল তুলেছেন। তিনি এতটা অযোগ্য ও ক্ষতিকর যে তাঁর হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে এই প্রশাসনের ভেতরে থেকেই অনেকে তাঁর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করে যাচ্ছেন। ‘আমি এই প্রতিরোধের অংশ, ট্রাম্প ক্ষমতা থেকে সরে না যাওয়া পর্যন্ত এই প্রতিরোধ চলবে’, তিনি জানিয়েছেন।

অজ্ঞাতনামা লেখকের এই অভিযোগের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ তুলেছেন ট্রাম্প। ‘মিথ্যাবাদী, দেশদ্রোহী, কাপুরুষ, দেশের অগ্রগতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী’। সাহস থাকলে এমন লোকের এখনই পদত্যাগ করা উচিত। টাইমসের প্রতি তিনি দাবি জানিয়েছেন, অবিলম্বে এই নিবন্ধের লেখক কে, তাঁর নাম ফাঁস করতে হবে।

হোয়াইট হাউসের ভেতর কে এই কাজ করতে পারেন, তা খুঁজে বের করতে ট্রাম্পের নির্দেশে এক তুলকালাম কাণ্ড শুরু হয়েছে। ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স থেকে শুরু করে তাঁর মন্ত্রিসভার প্রতিটি সদস্যকে লিখিতভাবে জানাতে হয়েছে তাঁরা কেউ এই কাজ করেননি। বৃহস্পতিবার ঘণ্টায় ঘণ্টায় এসব লিখিত অস্বীকারোক্তি ট্রাম্পের হাতে পৌঁছে দিতে হয়েছে।

সবাই বলছেন, ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে যা ঘটছে তা প্রহসন ভিন্ন অন্য কিছু নয়। তাতে অবশ্য খুব বিস্ময়ের কোনো কারণ নেই। ট্রাম্পের হোয়াইট হাউস প্রথম দিন থেকেই বিশৃঙ্খল। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে মিথ্যাচার, অযোগ্যতা ও মার্কিন স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর নীতির জন্য বিরোধী পক্ষের সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছেন ট্রাম্প। অন্যদিকে, তাঁর অনুগত সমর্থকদের কাছে তিনি ‘ঈশ্বরের কাছ থেকে পাওয়া একটি উপহার’। ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান দলের ৯০ শতাংশ সদস্য এখনো মনে করেন তিনি চমৎকার কাজ করছেন। তাঁদের বিশ্বাস, ট্রাম্পের রক্ষণশীল অ্যাজেন্ডার বিরোধীরাই পদে পদে বাধা সৃষ্টি করে চলেছেন। নিউইয়র্ক টাইমস এই বিরোধী পক্ষেরই একজন। সেই তালিকায় এখন যুক্ত হলেন নামধামহীন এক উপসম্পাদকীয়র লেখক।

যাঁরা ট্রাম্পকে অপদার্থ মনে করেন, তাঁদের চোখে অবশ্য এই নিবন্ধের লেখক এক সাহসী কাজ করেছেন। এমন নিঃস্বার্থ লোকজন এখনো প্রশাসনের ভেতরে রয়েছেন বলেই সিরিয়ার আসাদকে হত্যা করা হয়নি, ইরানের বিরুদ্ধে পারমাণবিক বোতাম টিপে ধরা হয়নি, অথবা রাশিয়ার সঙ্গে আঁতাতের প্রশ্নে তদন্তকারী রবার্ট ম্যুলারকে পদচ্যুত করা হয়নি। যাঁরা এই প্রতিরোধে যুক্ত, তাঁরা প্রকৃত নায়কোচিত কাজই করে চলেছেন।

এমনকি সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি কার্যত এই উপসম্পাদকীয়কে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র একধরনের শাসনতান্ত্রিক সংকটে পড়েছে, আর তার জন্য দায়ী স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। কেরি বলেছেন, আমেরিকার ক্ষমতা এখন এমন একজনের হাতে, যাঁর বল্গাহীন কার্যকলাপ ও নিজ দায়িত্ব পালনে অক্ষমতার কারণেই চলতি শাসনতান্ত্রিক সংকটের সৃষ্টি।

তবে দলনিরপেক্ষ এমন অনেকে আছেন, যাঁরা কাজটিকে মোটেই সাহসী বলে ভাবছেন না। আটলান্টিক মান্থলি পত্রিকায় ডেভিড গ্রাহাম, যিনি মোটেই ট্রাম্প-সমর্থক হিসেবে পরিচিত নন, এই উপসম্পাদকীয়কে ‘সফট ক্যু’ অর্থাৎ ক্ষমতা দখলের হালকা চেষ্টা বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর যুক্তি, হাজার হোক, ট্রাম্পকে এ দেশের মানুষ ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন। তাঁকে যদি সরাতেই হয়, তাহলে শাসনতান্ত্রিক পথেই এগোতে হবে। এই নিবন্ধের লেখক সঠিক হলে প্রশাসনের ভেতরেই এমন লোক রয়েছেন, যাঁরা নির্বাচিত না হয়েও একটি নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন। বব উডওয়ার্ড তাঁর নতুন বই ভয়তেও প্রশাসনের ভেতরে কেউ কেউ যে ট্রাম্পকে ঠেকাতে ব্যস্ত, তাকে একধরনের ‘প্রশাসনিক অভ্যুত্থান’ নামে অভিহিত করেছেন।

ট্রাম্পের সব কাজে যাঁরা অনর্থ খোঁজেন, এই উপসম্পাদকীয় লেখকের ভূমিকায় সাধুবাদ দিতে পারেন, কিন্তু এই বিষয়টি হয়তো তাঁরাও লক্ষ করে থাকবেন যে ট্রাম্পের অ্যাজেন্ডা নিয়ে তাঁর কোনো আপত্তি নেই। বস্তুত, তিনি মনে করেন ট্রাম্প আমলে যা অর্জিত হয়েছে, তা সাধুবাদের যোগ্য। কিন্তু এসবই হয়েছে ট্রাম্পের জন্য নয়, ট্রাম্পকে অগ্রাহ্য করে। তাঁর সব আপত্তি ট্রাম্পের ব্যক্তিগত ব্যবহার নিয়ে, তাঁর অ-প্রেসিডেন্টসুলভ আচরণ নিয়ে। লেখকের এই বক্তব্যের সঙ্গে ট্রাম্পের আদর্শগত বিরোধীদের একমত হওয়ার কথা নয়। ট্রাম্পের কারণে শুধু অতি-ধনীদের জন্য সহস্র কোটি ডলারের কর রেয়াতি দেওয়া হয়েছে, পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, সংখ্যালঘুদের জন্য ক্ষতিকর আইন গৃহীত হয়েছে, রক্ষণশীলদের স্বার্থ রক্ষা করে এমন বিচারব্যবস্থা গঠিত হচ্ছে, ওবামা আমলের স্বাস্থ্য বিমা কর্মসূচি বাতিলের পাঁয়তারা চলছে। প্রশাসনের ভেতরে থেকে যাঁরা ট্রাম্পের এই অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে মদদ দিচ্ছেন, তাঁরা কোনো অংশে ট্রাম্পের চেয়ে উত্তম, এ কথা ভাবার কোনো কারণ নেই।

টাইমসে প্রকাশিত নিবন্ধের লেখক বস্তুত কতটা ক্ষতিকর কাজ করেছেন, তার আরেকটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন আটলান্টিক পত্রিকায় ডেভিড ফ্রাম। তিনি বলেছেন, ট্রাম্প এমনিতে তাঁর আশপাশের সবকিছু সন্দেহের চোখে দেখেন। এখন যদি কেউ এসে তাঁকে পরামর্শ দেন রবার্ট ম্যুলারকে পদচ্যুত করা সঠিক কাজ হবে না, তাহলে তিনি যদি তাঁকে সেই লেখকের মতোই একজন ‘প্রতিরোধকারী’ ভেবে তাঁর পরামর্শ অগ্রাহ্য করেন, তাহলে?

এ কথা ঠিক, এই উপসম্পাদকীয়র ফলে ট্রাম্প সবার হাসির পাত্রে পরিণত হয়েছেন, কিন্তু ট্রাম্পের জন্য তার ফল হিতে বিপরীত প্রমাণিত হতে পারে। ট্রাম্পের সমর্থকেরা উদারনৈতিক তথ্যমাধ্যম ও ট্রাম্পবিরোধী এমন সব ব্যক্তি ও সংস্থার প্রতি সন্দেহ পোষণ করে থাকেন। এই ঘটনা তাঁদের মধ্যে সে সন্দেহ আরও ঘনীভূত করবে। এ বছর নভেম্বরের মধ্যবর্তী নির্বাচনে বিরোধী ডেমোক্র্যাটরা আশা করছেন, তাঁরা কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাবেন। তাঁদের এই আশার কারণ, একদিকে ডেমোক্রেটিক সমর্থকেরা ট্রাম্পকে হারাতে রাজনৈতিকভাবে অধিক সংগঠিত। অন্যদিকে ট্রাম্পের সমর্থকদের মধ্যে উৎসাহের অভাব খুবই স্পষ্ট। কিন্তু এমন একটি ঘটনার ফলে এই সমর্থকদের মধ্যেই হয়তো উল্টো প্রতিক্রিয়া হতে পারে, উদারনৈতিকদের ঠেকাতে তাঁরা ফের এককাট্টা হয়ে উঠবেন।

সবচেয়ে বড় কথা, ট্রাম্পকে যদি ঠেকাতেই হয়, তা করতে হবে শাসনতান্ত্রিক পথে। এই উপসম্পাদকীয়র লেখক যত আদর্শপ্রণোদিত হয়ে এই প্রতিরোধে অংশ নিয়ে থাকুন না কেন, রাজনীতিসচেতন কোনো লোকের পক্ষেই এই ‘মৃদু অভ্যুত্থান’ সমর্থনযোগ্য নয়। তিনি যদি নৈতিক কারণে ট্রাম্পের বিরুদ্ধাচরণ করে থাকেন, তাহলে তাঁর জন্য একমাত্র সম্মানজনক কাজ হবে প্রকাশ্যে এই প্রশাসন থেকে পদত্যাগ। কেবল তখনই তাঁকে ‘নায়ক’ নামে সম্বোধন করা সম্ভব।