বাংলাদেশি বাউলের বিষাদ

পাতাল থেকে বেরিয়ে ট্রেন ততক্ষণে কুইন্স প্লাজা প্ল্যাটফর্মের কাছাকাছি। লাউডস্পিকারে ভেসে আসে ট্রেন অ্যাটেন্ডেন্টসের সতর্ক বার্তা। তখনো চোখ বন্ধ সজলের। ট্রেনে এয়ারকন্ডিশনের সোঁ সোঁ শব্দ। কড়া ব্রেক করায়, বড় একটা ঝাঁকুনি দিয়ে থামল ট্রেন। হঠাৎ এমন ঝাঁকুনি খেয়ে চোখ খুলল সজল। চালকের এমন বেপরোয়া ট্রেন পরিচালনায় যাত্রীরা বড় বিরক্ত। সজলও ভ্রু কুঁচকে আসনে সোজা হয়ে বসতে গিয়ে চোখে পড়ল, পাশের সিটে পড়ে থাকা ব্যাগটির ওপরে। সেই মেয়েটির ব্যাগ, একটু আগে যে মেয়েটি পথ দেখিয়েছিল ওকে। ব্যাগটি তাড়াতাড়ি তুলে নিল সে, এপাশ-ওপাশ দ্রুত চোখ ফেরাল। না, কেউ তাকে খেয়াল করেনি। আশ্বস্ত হলো সে। মনে মনে বলল, হায়রে ভুলো মন!
সজলের কাছে এমন ব্যাগ, ওয়ালেট, সেলফোন, ল্যাপটপ, ক্যামেরা খুঁজে পাওয়া নতুন কোনো ঘটনা নয়। পত্রিকা অফিসে কাজে যোগদানের আগে দীর্ঘদিন ট্যাক্সি চালিয়েছে সে। এই ট্যাক্সি চালাতে চালাতে এই নিউইয়র্ক শহরকে ভালোবেসেছে ভীষণ। কত দেশের মানুষের সঙ্গে হয়েছে চেনা-জানা। বই না পড়েও কথায় কথায় কত দেশ সম্পর্কে জেনেছে। কোনো মানুষ দেখে সজল প্রায় নিশ্চিত বলে দিতে পারে, কোনো দেশ হতে এসেছে সে ।
মানুষের সঙ্গে কথা বলতে বলতে, মানুষের জন্য ভালোবাসা দানা বেঁধেছে ওর মনে। আরও গভীরভাবে ভালোবেসেছে সে নিউইয়র্কের আকাশ, ম্যানহাটনের রাজপথ, অট্টালিকা। ভালোবেসেছে হাডসন রিভার আর ইস্ট রিভারের জল। বেল্ট পার্কওয়ে দিয়ে যেতে যেতে যে সমুদ্র বাতাস লাগে গায়, সেই হিমেল হাওয়া সবার মনকে নাড়া না দিয়ে যায় না ।
হাডসন নদীর ওপারে তীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিউজার্সি শহর। রাতে ওয়েস্ট সাইড হাইওয়ে দিয়ে যেতে যেতে দেখা যায় ঘরের আলো জানালা টপকে এসে মিশেছে হাডসনের জলে। সেই কালো জলের ভেতরে আলোর খেলা দেখতে দেখতে মনে হয় মায়াবী কোনো নারী যেন দাঁড়িয়ে আছে মায়ার আলো হাতে নিয়ে। দোল খায় নদীর জল! দোল খায় মায়াবী সেই নারী!
কোলের ওপরে সেই বিদেশিনীর ব্যাগ নিয়ে, আজ তেমনি দোল খাচ্ছে সজল । দোল খেতে খেতে ভাবছে সেই বিদেশিনীর কথা। খুঁজে কি পাবে সে, কোনো নাম-কোনো প্রত্যাশিত ঠিকানা?
ঘরে পৌঁছেই এক সাগর প্রত্যাশা নিয়ে ব্যাগ খুলল সজল। ব্যাগের ওপরে ভাঁজ করে রাখা হালকা জ্যাকেটটি সরিয়ে রেখে, তন্ন তন্ন করে খুঁজে চলেছে সে। জ্যাকেট সরিয়ে ওর নজরে পড়ল, কয়েকটা গামের প্যাকেট, একটি ছোট মেকআপ বক্স, ছোট একটি আয়না, কয়েকটা লিপস্টিক, কিছু বাজারের স্লিপ, ট্রেনের মেট্রো কার্ড। ব্যাগের অন্য পকেট খুলে দ্রুত খুঁজতে থাকে সে । কিছু খুচরা পয়সার ভেতরে ছবি-নামসহ পায় একটি আইডি কার্ড। আইডি কার্ডটি সেই বিদেশিনীরই। ছবি দেখে নিশ্চিত হলো সজল। কার্ডের ওপরে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগোসহ বিদেশিনীর নাম। ইংরেজির ক্যাপিটাল অক্ষরে লেখা ‘SHARLYEN SILVERMAN’।
নামটি জোরে জোরে কয়বার উচ্চারণ করল সে। বলল মনে মনে, বাহ! চমৎকার নাম তো! নামের কোথায় যেন একটা মিল খোঁজার চেষ্টা করল সজল। তবে কি সে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে বিদেশিনীকে খুঁজতে? কাজটি তত সহজ নয়, ভাবল মনে মনে। তবে নিরাশ হয়নি এখনো, খুঁজে চলেছে সে। এবারে একটা ওয়ালেট পেল সজল। ভাবল নিশ্চয় এখানে কোনো ক্লু পাওয়া যাবে। ওয়ালেট খুলেই সে দেখে অনেকগুলি ক্রেডিট কার্ড সারি সারি সাজানো। ক্রেডিট কার্ডে বিদেশিনীর নাম, কয়েকটা ১০০ ডলারের নোট, কিছু খুচরা ডলার ওয়ালেটে ভাঁজ করে রাখা ।
সমস্ত ব্যাগ তন্ন তন্ন করে খুঁজল সে, না নেই; কোথাও নেই কোনো ফোন নম্বর। ভাবল বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে, ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্টে আইডি কার্ড দেখিয়ে নিশ্চয় শার্লিনকে খুঁজে পাবে সজল। কিন্তু আজ যে শনিবার, উইকেন্ড। আগামীকালও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। ম্যানহাটনের ফিটনেস ক্লাবে, যেখানে মেয়েটি নেমেছিল, সেখানে গিয়ে কি খুঁজে দেখবে একবার? কিন্তু কোন ফিটনেস ক্লাবেই বা সে যাবে? এমনি হাজারো প্রশ্ন তখন সজলের মাথায়।
হঠাৎ ক্রেডিট কার্ডের কথা মনে হলো ওর। একটু আশার আলো যেন খুঁজে পেল সে। পুরো ঘটনার বিবরণ টেনে, ক্রেডিট কার্ড কোম্পানিকে অনুরোধ করা যেতে পারে শার্লিনের ফোন নম্বরের জন্য। যেই ভাবা সেই কাজ। ফোন করল সজল। ফোনের ওপারে একটি মেয়ে কণ্ঠ। মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে বরাবরই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে সজল। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা সে জন্য ওকে ‘মেয়ে রাশি’ বলে হাসি-তামাশা করত। অত্যন্ত বিনয়ী হয়ে ঘটনা বর্ণনা করে শার্লিনের ফোন নম্বর পেতে চাইল সে। নম্বরটি পেলে সে এক্ষুনি ফিরিয়ে দিতে পারে ব্যাগটি। সজলের নাম-ধাম সব নোট করে নিল, তারপরই পাওয়া গেল অতি কাঙ্ক্ষিত সেই নম্বর!
ফোন নম্বর পেয়ে আনন্দে নেচে উঠল সজলের মন!
আবারও দেখা হবে! কথা হবে! মহাআনন্দ নিয়েই ফোন করল সে। অপেক্ষায় সজল! রিং টোন বাজে কিন্তু সাড়া মেলে না। কিছুটা হতাশ হলো সে, নম্বর সঠিক কি না, সে কথাও মনের ভেতরে উঁকি দিয়ে গেল মুহূর্তেই। মেসেজ রাখবে কি না ভাবছে সজল। এমনি ভাবতে ভাবতে আবারও ফোন করল সে। কয়েকবার রিং টোন বাজার পরে ওপার থেকে মেয়ে কণ্ঠ ভেসে আসে।
বলে, ‘হ্যালো’
সজল বলল, ‘তুমি কি শার্লিন?’
মেয়েটি বলল, ‘হ্যাঁ’
সজল বলল, ‘আমি সজল, কিছুক্ষণ আগে তুমি একটি মানুষকে পথ দেখিয়ে দিয়েছিলে, মনে আছ?’
শার্লিন উৎকণ্ঠা নিয়ে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ , মনে আছে।’ সজল একটু মজা করার জন্য বলল, ‘তুমি কি কিছু হারিয়েছ?’
শার্লিন তাড়াতাড়ি জবাবে বলে, ‘আমার ব্যাগটি আমি ভুল করে ট্রেনে ফেলে এসেছি।’
সজল আবারও রসিকতা নিয়ে বলে, ‘আমি পথ হারিয়েছিলাম, আর তুমি হারালে তোমার ব্যাগ; আমরা দু জনেই লুজার।’ জোরে শব্দ করে হাসল সজল ।
শার্লিন বলল, ‘প্লিজ হেসো না, আমার বড় দুঃখের সময় আজ!’
সজল এবার সরাসরি বলল, ‘আমি পেয়েছি তোমার ব্যাগটি।’
শার্লিন প্রায় চিৎকার করে বলল, ‘ও রিয়েলি!, কিন্তু তুমি আমার ফোন নম্বর পেলে কোথায়?’
সজল শান্ত গলায় বলল, ‘তোমার ক্রেডিট কার্ড কোম্পানির কাছ থেকে।’
শার্লিনের কণ্ঠে ঝরল আনন্দধারা, বলল, ‘গ্রেট!, রিয়েলি ইউ আর জিনিয়াস; ইউ আর মাই লাইভ সেভার!’
সজল হেসে বলে, ‘এ আর এমন কি, এটা তো আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।’
শার্লিন সেই আবেগ নিয়ে জবাবে বলে, ‘ইউ আর এ ভেরি অনেস্ট ম্যান!’
শার্লিনের কাছ থেকে এমন কমপ্লিমেন্ট পেয়ে গর্বে ভরে গেল ওর মন। সে শার্লিনের কাছে জানতে চাইল, কখন কীভাবে সে ব্যাগটি ফেরত দিতে পারে ।
শার্লিন একটু ভেবে নিয়ে বলল, আজকে আর তোমার আমার এখানে আসার প্রয়োজন নেই, ধরে নিলাম ব্যাগটি পেয়েছি আমি; বলেই আবারও সেই মনকাড়া হাসি!
হাসতে হাসতে শার্লিন জিজ্ঞেস করল সজলকে, ‘আগামীকাল রোববার, ছুটির দিন; তুমি কি পারবে আসতে?’
সজল বলল, ‘হ্যাঁ পারব, কিন্তু কোথায় এবং কখন?’
সজলকে লাইনে রেখে শার্লিন ভাবছে। কিছুক্ষণের নীরবতা।
নীরবতা ভাঙল শার্লিনের উত্তরে। সে বলল, ‘কালকে সকালে আমি সুইমিং শিখতে এখানে আসব; তুমি কি পারবে আমার সুইমিং ক্লাবে আসতে?’
জবাবে ‘হ্যাঁ বলে, অ্যাড্রেস চাইল সজল।’
অ্যাড্রেস দিতে দিতে শার্লিন বলল, আজ আমি যে প্ল্যাটফর্মে নেমেছিলাম, কাল তুমি সেখানে নামবে; পাতাল ট্রেন থেকে ওপরে উঠলেই লেগজিংটন অ্যাভিনিউ আর সিক্সটি থার্ড রাস্তার কোণে আমার ফিটনেস ক্লাব। সেখানে এসে আমার নাম বললে ওরা আমাকে ডেকে দেবে।
শার্লিনের আমন্ত্রণে সজল এত বেশি খুশি এবং আনন্দিত যে, শুধু ‘ওকে’ ছাড়া আর কিছুই বলতে পারল না।
ফোনের অপর প্রান্ত থেকে শার্লিন, ‘কাল দেখা হবে’ বলে ফোন রাখল ।
দীর্ঘদিন পর সজল আজ ফুরফুরে হাওয়ার ভেতরে, শার্লিনের ফেলে যাওয়া ব্যাগটি সঙ্গে নিয়ে খুশি মনে ঘরে ফিরল সে। ব্যাগটি টেবিলের ওপরে রেখে, সোফায় গা এলিয়ে দিল সজল। মাথার চুলে হাত বোলানো ওর ছোটবেলার অভ্যাস। তখন সজলের মস্তিষ্কের কোষে কোষে এক বিদেশিনীর অপরূপ মুখশ্রী, নাম যার ‘শার্লিন সিলভারম্যান’!
সোফা ছেড়ে বড় আয়নার সামনে দাঁড়াল সজল। কত দিন এভাবে আয়না দেখে না সে । কেন আজ সজল আয়নায় এভাবে নিজেকে দেখছে? আয়নার সজলকে জিজ্ঞেস করল তবে কি তার জীবনে এল প্রেম?
চোখের নিচে কালো দাগের মতো একটি রেখা পড়েছে, এত দিনে নজরে পড়ে ওর। সে আয়নার চোখে চোখ রেখে স্বগতোক্তি করল, ‘তোমার বয়স বাড়ছে সজল।’
আজ সজল ওর বয়স বাড়ার কথা মনে করতে চায় না। ওর ভেতরের তেজি ঘোড়াটি এখনো টগবগে আগেরই মতো।
সময় যেন যায় না সজলের। কাল সকাল অবধি অপেক্ষাটুকুও যেন আজ আর সয় না। এক রকমের অস্থিরতা, এক রকমের ভালো লাগা নিয়ে সে অতিবাহিত করছে সময়।
রাত গভীর। অনেক রাত অবধি বিছানায় এপাশ-ওপাশ করল সজল। নির্ঘুম কয়েকবার বাইরের বারান্দায় গিয়ে বসেছে। শরতের রাতের আকাশ। পুবের চাঁদটা ততক্ষণে ঢলে পড়ছে পশ্চিমে। গাছের পাতায় পাতায় চাঁদের আলোর লুটোপুটি খেলা, যেন জোছনার স্নিগ্ধ আলোয় স্নান করছে নিসর্গ!
ঘরে ফিরে কাগজ-কলম নিয়ে সে বসল টেবিলে। আজ রাতে কিছু লিখতে চায় সজল। না, এল না কোনো লেখা। শুধু অপেক্ষায় কাটছে নিশি, কিছুই এল না আজ সজলের কলম থেকে। মাঝে মাঝে এমনি হয় সজলের, হাজার চেষ্টা করে এক লাইন লেখাও খুব কষ্টের হয়ে যায়।
সকালে একটু দেরিতে ঘুম ভাঙল সজলের। বিছানায় শুয়ে শুয়ে আড়মোড়া দিল কিছুক্ষণ। ‘না আর আলসেমি নয়, ওঠো সজল; তৈরি হও,’ এমনি একটি তাগাদা অনুভব করল সে।
তাড়াতাড়ি স্নান সেরে আজ জিনস পরল সজল, সঙ্গে সাদা শার্ট। অনেক দিন পারফিউম ব্যবহার করে না সে। কিন্তু আজ যেন অন্য রকম সবকিছুতে। প্রিয় পারফিউম স্প্রে করতে করতে স্বগতোক্তি আবারও, ‘আজ শার্লিনের কাছে যাবে সজল!’
তাড়াহুড়ো করে ঘরের দরজা বন্ধ করে সজল এসে দাঁড়াল বাইরের বারান্দায়। মাথার ওপরে ওর চির চেনা একখণ্ড নীল আকাশকে সজল দেখে নিল আরও একবার। সকালের নরম মিষ্টি আলোর ধারা ছুঁয়ে গেল সজলকে। স্টেশন মাস্টারের কাছে সে জেনে নিল পথ। সজল আজ আর হারাতে চায় না।
নির্ধারিত সময়ে ট্রেন এল। শার্লিনের ব্যাগটি কোলে নিয়ে বসল সে। শার্লিনের জ্যাকেট থেকে ভেসে এল সুগন্ধী সুবাস! সেই সুবাসিত মন নিয়ে সজল ছুটে চলেছে ম্যানহাটনের পথে।
ম্যানহাটনের সমস্ত অলি-গলি সজলের অতি চেনা। শার্লিনের ফিটনেস ক্লাব খুঁজে পেতে ওর একটুও অসুবিধা হলো না।
সজল রিসেপশনিস্টের কাছে পরিচয় দিল নিজের। রিসেপশনিস্ট মেয়েটি ওকে বসতে বলে ভেতরের দিকে গেল। সোফায় বসতে বসতে ফিটনেস ক্লাবের চারিদিকটা ভালো করে দেখে নিল সে।
চমৎকার পরিপাটি করে সাজানো গোছানো, মেঝেতে দামি টাইলস, পরিষ্কার ঝকমক!
একটি গভীর শ্বাস নিল সজল। পাশের প্রকাণ্ড হলরুমটিতে ছেলে-মেয়েরা ট্রেডমিলে দৌড়াচ্ছে, দেখা যায় জানালা দিয়ে । সুইমিং পুলটা বোধ হয় ভেতরে, এখান থেকে কিছুই দেখা যায় না।
খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি । একটু পরে সুইমিং ড্রেস পরেই সজলের দিকে এগিয়ে আসছে শার্লিন। বড় একটি তোয়ালে কোমরে পেঁচিয়ে, অন্য একটি তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে হাসি মুখে শার্লিন সজলের দিকে । শার্লিনের খোলামেলা শরীরের দিকে ভালো করে তাকাতে পারছে না সজল । এক ধরনের আড়ষ্টতায় জড়সড় হয়ে উঠে দাঁড়াল সে।
খুব দ্রুত এগিয়ে আসতে আসতে ‘হায় সজল’ বলে হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়াল শার্লিন। সজলও বাড়িয়েছে হাত শার্লিনের দিকে ।
শার্লিনের ভেজা হাতের নরম পরশ অনুভব করল সজল। জলে ভিজে ভিজে আরও নরম তুলতুলে হয়েছে হাত দুখানি।
হ্যান্ডশেক শেষে সজল শার্লিনের দিকে বাড়িয়ে দিল ব্যাগটি ।
‘তুমি আমার জীবন বাঁচিয়েছ’ বলে ব্যাগটি হাতে নিয়ে, সজলকে খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে দেখ নিল শার্লিন। শার্লিনের এমন খোলামেলা অঙ্গ, সজলের লাজুক দৃষ্টি যেন মেঝেতেই গেছে থেমে।
যে শার্লিনকে দেখার জন্য কেটেছে নির্ঘুম রাত, এত কাছে পেয়েও আজ কেন পারছে না সজল ওপরে উঠতে?
সজলের ফিরিয়ে দেওয়া ব্যাগের ওয়ালেট থেকে, একশত ডলারের একটি নোট সজলের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে শার্লিন বলল, ‘আমি সত্যি কৃতজ্ঞ তোমার কাছে, নাও, এটি রাখ।’
হঠাৎ যেন বাজ পড়ল সজলের মাথায়!
দৃঢ় স্থির হয়ে আটকে গেল ওর হাত! আটকে গেল কণ্ঠ!
ধাক্কাটা খুব কষ্টে সামলে নিয়ে, শার্লিনের চোখের ওপরে চোখ রেখে জানতে চাইল সে, এটা কি টিপস? তোমার জীবন বাঁচানোর জন্য দিচ্ছ আমাকে?
শার্লিন হাসতে হাসতে বলল, আমেরিকান ভাষায় তাই, নাও, ধর।
সজল নিজেকে সামলে নিয়ে, খুব শান্ত-ধীর কণ্ঠে শার্লিনকে বলল, ‘না, আমার লাগবে না। ওটা তুমি রেখে দাও। তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, তোমার এখন ডলারের খুব প্রয়োজন। রেখে দাও আমার টিপস তোমার কাছে।’
ডলার ফিরিয়ে দিয়ে ‘বাই শার্লিন’ বলে মুহূর্ত দেরি না করে বেরিয়ে এল সজল ফিটনেস ক্লাব থেকে।
ম্যানহাটনের রাজপথে এখন বড় এলোমেলো হাঁটছে সজল। আজ শার্লিনের টিপস দেওয়াতে ওর এত অভিমান হলো কেন? দীর্ঘদিন ট্যাক্সি চালিয়েছে সে। যাত্রীর মূল্যবান কত জিনিস ফিরিয়ে দিয়েছে সজল। বিনিময়ে মিলেছে কত বকশিশ।
বকশিশ না পেলে ‘শালা বখিলের বাচ্চা’ বলে গালি দিতে দিতে আবারও স্টিয়ারিং ধরেছে সে।
সজলের সততার জন্য কত যাত্রী ওর সঙ্গে ছবি তুলেছে, নিউজ করবে বলে কেউ সাক্ষাৎকার নিয়েছে। এইতো সেদিন পত্রিকার কাজ করতে গিয়ে এক মহিলা পঁচিশ ডলার বকশিশ দিল, খুশি মনে সেই ডলার নিয়ে বন্ধুরা আড্ডায় খরচ করল। আজকের ওই একশত ডলার দিয়ে তো বন্ধুদের সঙ্গে জম্পেশ আড্ডা হতো। তা হলে কেন সে শার্লিনের সঙ্গে এমন আচরণ করল?
আজ শার্লিনের বকশিশ নিতে সজলের অহং-এ লাগল কেন? কেন আজ সজলের মনটা হঠাৎ মেঘে ঢাকা? কেন ওর প্রচণ্ড অভিমান হচ্ছে শার্লিনের ওপরে? শার্লিনের ওপরে ওর কিসের অধিকার?
এলোমেলো হেঁটে চলেছে সজল ম্যানহাটনের রাস্তায়। সজলের মনে তখন অন্য এক ভাবনার ভুবন। মেঘলা আকাশে ঘন কালো মেঘ। সজলের এলোপাতাড়ি হেঁটে চলা দেখে, ম্যানহাটনের আকাশচুম্বী অট্টালিকাগুলি প্রচণ্ড বিদ্রূপের হাসি হাসছে আজ। সেই বিকট বিদ্রূপের হাসির শব্দে প্রলয়ংকরী সুনামি চলছে সজলের ভেতরে-বাইরে।
বিড়বিড় করে কথা বলছে সজল। নিজেরই সঙ্গে নিজের কী ভীষণ বিরামহীন কথোপকথন।
পৃথিবীর রাজধানী হিসেবে খ্যাত ম্যানহাটনের রাজপথে আজ, বানভাসি মানুষের মতো ভেসে যাচ্ছে বাংলাদেশি বাউলের বিষাদ।