ভোটের উৎসবে বাঙালিদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ

এবার একটি ভোট কেন্দ্রে স্ক্যানার ইন্সপেক্টরের দায়িত্ব পেয়েছিলেন লেখক সোনিয়া কাদের। ব্রংকসের ইন্ডিয়ানা ভিলেজ নামে যে এলাকায় থাকেন তিনি সেখানে পথে ঘাটে সচরাচর মানুষজন দেখা যায় না। অথচ সকাল থেকে ভোটকেন্দ্রে ছিল উপচে পড়া ভিড়। তিনটি স্ক্যানার মেশিন পরিচালনায় দায়িত্বে ছিলেন সোনিয়াসহ দুজন। হিমশিম খেতে হচ্ছিল তাঁদের।
সোনিয়া বললেন, এত বছর আমেরিকায় ভোট দিই, কখনো ভোট কেন্দ্রে এত ভিড় দেখিনি। বর্তমান আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিভিন্ন বিষয়ে এক চোখা নীতির কারণে মানুষ এখন আগের তুলনায় সচেতন। আর ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালনের অনুভূতির কথা কী বলব। মানুষের এত ভালোবাসা পেয়েছি যে বলার নয়। দীর্ঘ ১৭ ঘণ্টা দায়িত্ব পালনের পরেও মনে হয়েছে আনন্দে ভাসতে ভাসতে বাসায় গিয়েছি।
এবার মধ্যবর্তী নির্বাচনে নিউইয়র্ক সিটিতে ছিল ডেমোক্র্যাটদের জয়জয়কার। অভিবাসী মানুষের মধ্যে তাই আনন্দের বন্যা। নিউইয়র্কের গুরুত্বপূর্ণ কমিউনিটি বাঙালিদের এবারের নির্বাচনে নিজেদের কোনো প্রার্থী ছিল না। তবে তারা নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়েছে ডেমোক্র্যাটদের। আলেকজান্দ্রিয়া ওকাশিও করটেজ কিংবা জেসিকা রামোসের প্রতি বাঙালিদের উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখে মনে হয়েছে ওরা যেন তাদের ঘরের মেয়ে। অভিবাসী মানুষ হিসেবে সবার সুখ-দুঃখ, প্রত্যাশা, বঞ্চনা সব যেন একাকার হয়ে গিয়েছিল নির্বাচনী প্রচারে। তারই প্রতিফলন ঘটেছে ৬ নভেম্বর, মধ্যবর্তী নির্বাচনের দিনে। এত বড় জয়ের মধ্যে অনেকের কণ্ঠে হাহাকারও ঝরেছে। যেমন এলমহার্স্ট এলাকার বাসিন্দা নুরুল আলম, জীবনে প্রথমবারের মতো ভোট দিতে গিয়ে একটু বেশি উৎফুল্ল ছিলেন। ভোটকেন্দ্রে মানুষের ভিড় বেশ উৎসবের আমেজ দিয়েছে তাঁকে। তবে এর মাঝেও তিনি ভুলে যাননি নিজের দেশকে। এই নিয়ে বলেছেন, ‘বাংলাদেশে যেরকম ভোট ব্যবস্থা আশা করি, সেটা পাই না। এখানে প্রার্থীরা প্রথমে দল থেকে নির্বাচিত হন, তারপর নির্বাচনে অংশ নেন। বাংলাদেশে তো প্রার্থী নির্বাচনের কোনো প্রক্রিয়াই নেই।’ 

এত সুশৃঙ্খল নির্বাচনী ব্যবস্থা যে ভাবাই যায় না—এমন অভিব্যক্তি সোনিয়া কাদেরের। বাংলাদেশে নির্বাচনী কেন্দ্রে মারামারি লাগে, ব্যালট বাক্স ছিনতাই হয়, এখানে সেটা চিন্তাই করা যায় না। এত সুশৃঙ্খল চারদিক। তিনি বলেন, এখানে তরুণেরা ভোট দিতে আসে না। বয়স্কদের ভিড় বেশি। বাঙালিরা কখনো ভোট মিস করে না। এটা বাঙালিদের একটা ভালো দিক। স্ক্যানার ইন্সপেক্টরের কাজ করতে গিয়ে সারা দিন কত জাতির, কত সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি যে বলার নয়। আমি নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে মিশতে ভালোবাসি। রাত নয়টায় কাজ শেষ হওয়ার পরে কো-অর্ডিনেটর আমার নাম ধরে ধন্যবাদ দিয়েছে। সবাই তালি দিয়ে আমাকে অভিনন্দিত করেছে। ডেমোক্র্যাট পার্টির সদস্য হিসেবে অনেক দিন ধরে কাজ করছি। তবে এই প্রথম এমন একটি সম্মানিত কাজের দায়িত্ব পেলাম।
সোনিয়া কাদের মতো নির্বাচনী কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করেছেন লেখক শেলী জামান খান। বোর্ড অব ইলেকশনে ‘দোভাষী’র দায়িত্ব কাজ করার জন্য ‘স্ট্যান্ড বাই’ বসেছিলেন সকাল সাতটা থেকে। জ্যাকসন হাইটসের পিএস সিক্সটি নাইন স্কুলে দায়িত্ব ছিল তাঁর। শেলী জামান জানান, ‘২০০৩ সালে দোভাষীর কাজ শুরু করার পরে ভোটারদের এমন প্রাণবন্ত আর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ আগে কখনো আমার চোখে পড়েনি। বাঙালি ভোটারদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে ঠান্ডা উপেক্ষা করে এত মানুষ এসেছে যে ভোটকর্মীদের হিমশিম খেতে হয়েছে। কাজের ব্যস্ততার কারণে শেষ মুহূর্তে পছন্দের প্রার্থীকে গিয়ে ভোট দিতে পেরেছি।’

জ্যামাইকায় এক পাবলিক স্কুলে নিজের ভোট দিয়েছেন আবেদা খানম। সঙ্গে ছিলেন স্বামী আবু তাহের চৌধুরী। প্রার্থীর নাম আবেদা খানমের কাছে বিবেচ্য বিষয় ছিল না। ডেমোক্র্যাট পার্টি থেকে যিনিই দাঁড়িয়েছেন, তাঁকেই ভোট দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি ভোটটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য ভোট দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বলে মনে করি। আমেরিকান সরকার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার জন্য বিশেষভাবে এটা দরকার। এবার মধ্যবর্তী নির্বাচনে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ আমাকে মুগ্ধ করেছে। বাঙালি ভোটাররা তো মনে হয় কেউ ঘরে বসে থাকেনি।’ আবেদা খানম দীর্ঘ ২১ বছর ধরে নিউইয়র্ক ডিপার্টমেন্ট অব এডুকেশনের অধীনে বিভিন্ন স্কুলে চাকরি করছেন। এবার নিউইয়র্ক সিটি থেকে কংগ্রেসের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন আলেকসান্দ্রিয়া ওকাশিও অরটেজ। আবেদা খানম বললেন, ‘মেয়েটা তো আমার ছাত্রীর বয়সী। আমার বিশ্বাস ভবিষ্যতে আমার ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে অনেকেই নামকরা রাজনীতিবিদ হবে। এ কথা ভেবে আমি সত্যিই শিহরিত বোধ করছি।’

লেখক পলি শাহীনা কাজ শেষে রাত আটটায় ব্রঙ্কসে ভোট কেন্দ্রে যান। সঙ্গে ছিলেন স্বামী তিতুমীর। ভাবেননি এত রাতে লোকজনের এমন ভিড় থাকবে। এত ভিড় এই প্রথম দেখলেন তিনি। একই অভিজ্ঞতা ব্রঙ্কসের পার্কচেস্টারশায়ারের আরেক বাসিন্দা শাকিলা শারমিন রিতার। স্বামী মাহিরউদ্দিন চুন্নুকে নিয়ে ভোট দিতে গিয়েছিলেন তিনি। রিতা বলেন, ‘পার্কচেস্টারশায়ারে অনেক বাঙালি এমনিতেই থাকে। চেনাজানা অনেকের সঙ্গে দেখা হওয়ায় বেশ একটা উৎসবের আমেজ অনুভব করছিলাম। বৃষ্টির মধ্যেও বেশ ভিড় ছিল।’ নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টে কর্মরত হুমায়ুন কবিরের দায়িত্ব ছিল ভোট কেন্দ্র দেখাশোনার। এর মধ্যে রিচমন্ড হিলে নিজের বাড়ির কাছে গিয়ে ভোট দিয়েছেন। ডেমোক্র্যাট পার্টির পুরো প্যানেল ধরে ভোট দেন তিনি।

নিউইয়র্কে বাঙালিদের ভোট দেওয়ার উৎসাহ পছন্দ করেন প্রার্থীরা। তাইতো তাঁরা বাঙালিদের যেকোনো অনুষ্ঠানে ডাকলে হাজির হন পরম আনন্দে। আলেকসান্দ্রিয়া ওকাশিও, ক্যাথরিনা ক্রুজ, জেসিকা রামোস প্রত্যেকেই একাধিকবার এসেছেন বাঙালিদের অনুষ্ঠানে। ৩ নভেম্বর জ্যাকসন হাইটসের পালকিতে আয়োজিত এমন একটি অনুষ্ঠানে এসেছিলেন জেসিকা রামোস, যিনি ওই এলাকার ভাড়া বাসায় থাকেন, নিয়মিত সাবওয়েতে চলাফেরা করেন। ডেমোক্র্যাট পার্টির কর্মী থেকে নেতা হয়েছেন। জেসিকার সঙ্গে ‘মিট অ্যান্ড গ্রিট’ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মোরশেদ আলম, আনিতা আশরাফ, জয় চৌধুরী, সোমা সাঈদ, দিলীপ দেবনাথ, মাম্পি ঘোষ, আলী রশিদ, আবু জাফর, সবিতা দাশ, পিয়াশ প্যাটেল, রুবাইয়া রহমান, পালি কমিউনিটির নেতা বাস্তোলা, আবদুর রহিম হাওলাদার, পর্ণা ইয়াসমিন, মোল্লা সানি, আহসান হাবিব, আবু তাহের, মেরি জোবায়দা, মনিকা রায়, আবেদা খানম, দিমা নেফারতিতি, আকবর হায়দার, লুবনা কাইজারসহ অনেকে। সেখানে বক্তারা আশা প্রকাশ করেন, জেসিকা বাঙালিদের প্রত্যাশার কথা আলবেনীতে পৌঁছে দেবেন। এবার তাঁদের সেই আশা পুরণ হবে বলে প্রবাসীরা মনে করছেন।