খাসোগি হত্যায় হোয়াটস অ্যাপ বার্তা নতুন ক্লু!
সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগির হোয়াটস অ্যাপের বার্তা তাঁর হত্যাকাণ্ডে নতুন মোড় এনে দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, হোয়াটস অ্যাপে তাঁর কথোপকথন সৌদি কর্তৃপক্ষ হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে জেনে যাওয়ায় তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করে।
সৌদি আরব ও যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সমালোচনা করে প্রকাশ্যে লিখেছেন সাংবাদিক জামাল খাসোগি। ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’-এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সেসব লেখা। ব্যক্তিগত বার্তা বিনিময়েও সেই অবস্থা থেকে সরেননি তিনি। তাঁর মতো সৌদি আরব থেকে নির্বাসিত এক অধিকারকর্মীর কাছে পাঠানো চার শতাধিক হোয়াটস অ্যাপ বার্তায় উঠে এসেছে বিষয়টি।
গত ২ অক্টোবর তুরস্কের সৌদি কনস্যুলেট ভবনে হত্যা করা হয় জামাল খাসোগিকে।
সিএনএনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার আগে এক বছর ধরে কানাডার মন্ট্রিয়ল-ভিত্তিক অধিকারকর্মী ওমর আবদুলাজিজকে পাঠানো সেই সব বার্তায় যুবরাজ মোহাম্মদকে ‘পশু’, ‘প্যাক-ম্যান’ (ভিডিও গেমের চরিত্র, যে তার পথের সবকিছুকে খেয়ে ফেলে, এমনকি সমর্থকদেরও) বলে মন্তব্য করেন খাসোগি। আবদুলাজিজের কাছে সেসব বার্তা, ভয়েস রেকর্ডিং, ভিডিও ও ছবি থেকে খাসোগির বেদনাদায়ক পরিস্থিতির এক চিত্র পাওয়া যায়।
মে মাসে পাঠানো এক বার্তায় খাসোগি লেখেন, ‘যত ভিকটিমকে তিনি (যুবরাজ মোহাম্মদ) খান, ততই তিনি চান।’ সৌদি আরবে এক দল অধিকারকর্মীকে আটক করার ঘটনায় তিনি এটা লিখেছিলেন। তিনি আরও লেখেন, ‘আমি অবাক হব না, যাঁরা তাঁকে নিয়ে মাতামাতি করেছেন, তাঁরাও যদি নির্যাতনের শিকার হন।’
প্রতিক্রিয়ায় ওমর আবদুলাজিজ বলেন, ‘এটা কি সম্ভব যে বাদশাহ হলে তিনি তাঁদের ক্ষমা করে দেবেন?’
জবাবে খাসোগি বলেন, ‘যুক্তি তা-ই বলে, কিন্তু এই মানুষটির (যুবরাজ মোহাম্মদ) মনে কী আছে, সে ব্যাপারে আমি আর আস্থা রাখতে পারি না।’
তাঁদের দুজনের মধ্যে এই বার্তা বিনিময় কোনো একটি পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্তের দিকে যেতে থাকে। তাঁরা সৌদি আরবকে জবাবদিহির মুখে দাঁড় করাতে অনলাইনে তরুণদের নিয়ে আন্দোলন করার পরিকল্পনা করেন।
আবদুলাজিজ সিএনএনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, জামাল খাসোগি যুবরাজ মোহাম্মদকে একটি ইস্যু, একটি সমস্যা বলে মনে করতেন এবং তিনি বলতেন এই ‘শিশুটিকে (যুবরাজ মোহাম্মদ)’ থামানো উচিত।
তবে আগস্ট মাসে তাঁরা বুঝতে পারলেন তাঁদের কথাবার্তা সৌদি কর্তৃপক্ষ জেনে গেছে। নিজের সঙ্গে অমঙ্গলজনক কিছু ঘটার আশঙ্কা করছিলেন খাসোগি। তিনি লিখেছিলেন, ‘আল্লাহ আমাদের সাহায্য করুন।’
এর দুই মাস পরই তিনি হত্যার শিকার হন।
গতকাল রোববার আবদুলাজিজ ইসরায়েলি এক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। তিনি মনে করেন, ওই প্রতিষ্ঠানের সফটওয়্যার তাঁর ফোন হ্যাক করতে ব্যবহার করা হচ্ছে। তিনি বলেন, তাঁর বলতে দুঃখ হচ্ছে যে জামাল খাসোগি হত্যায় তাঁর ফোন হ্যাক করার বিষয়টি বড় ভূমিকা রাখতে পারে। এর জন্য তাঁর অনুতাপ হচ্ছে। এই অনুভূতি তাঁকে খুন করে ফেলছে।
২০১৭ সালের অক্টোবর থেকে এ বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত খাসোগি ও আবদুলাজিজের মধ্যে বার্তা বিনিময় হয়। তাঁরা একটি অনলাইন বাহিনী ‘ইলেকট্রনিক বাহিনী’ বানাতে চেয়েছিলেন। খাসোগির প্রতিষ্ঠিত ভাবমূর্তি ও ২৭ বছর বয়সী আবদুলাজিজের ৩ লাখ ৪০ হাজার শক্তিশালী টু্ইটার অনুসারীদের তাঁরা ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সৌদি সরকারের অপপ্রচার সম্পর্কে জানাতে চেয়েছিলেন। দেশে নির্যাতন-শোষণের বিরুদ্ধে স্বল্প দৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্র তৈরি করে তা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন।
আবদুল আজিজ বলেন, ‘আমাদের কোনো পার্লামেন্ট নেই, আমাদের টুইটার আছে।’ তবে তিনি এ কথাও বলেন, টুইটার সৌদি সরকারেরও শক্তিশালী হাতিয়ার। তিনি বলেন,‘সৌদি সরকার গুজব ছড়াতে ও লড়াই করার একমাত্র মাধ্যম হিসেবে টুইটার ব্যবহার করে। আমরা হামলার শিকার হই, অপমানিত হই, আমাদের হুমকি দেওয়া হয়েছে অনেকবার। আমরা কিছু একটা করতে চাইছিলাম’।
আবদুলাজিজ কানাডায় কলেজে পড়ার সময় সৌদি শাসনের বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করেন। এর ফলে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি বাতিল হয়ে যায়। ২০১৪ সালে কানাডা তাঁর আশ্রয় প্রার্থনা মঞ্জুর করে এবং এর তিন বছর পর তাঁকে কানাডায় স্থায়ী বসবাসের অনুমতি দেওয়া হয়।
খাসোগি ও আবদুলাজিজের উদ্যোগের দুটি প্রধান ইস্যুকে সৌদি আরব চরমপন্থী কর্মকাণ্ড হিসেবে দেখে থাকতে পারে। এক. দেশে সৌদি শাসকদের বিরোধী ব্যক্তিদের কাছে বিদেশি সিম কার্ড পাঠানো যাতে টুইট করলেও তাদের শনাক্ত করা না যায়। দুই. অর্থ। আবদুলাজিজের দেওয়া তথ্য অনুসারে, খাসোগি প্রাথমিকভাবে ৩০ হাজার ডলার জোগাড় করে দেওয়ার আশ্বাস দেন।
মে মাসের এক বার্তায় হোয়াটস অ্যাপে আবদুলাজিজ খাসোগিকে লেখেন, ‘ ই-মেইলে আমি আপনাকে ইলেকট্রনিক আর্মির ব্যাপারে কিছু ধারণা পাঠাচ্ছি।’
জবাবে খাসোগি লেখেন, ‘দারুণ রিপোর্ট। অর্থ জোগাড়ের চেষ্টা করব। আমাদের কিছু একটা করতে হবে।’
এর এক মাস পর, আবদুল আজিজ এক বার্তায় জানান, পাঁচ হাজার ডলারের প্রথম চালানটি তিনি পেয়েছেন। জবাবে খাসোগি প্রশংসাসূচক থাম্ব আপ চিহ্ন পাঠান।
আগস্টের শুরুতে আবদুলাজিজ জানান, তাঁদের অনলাইন পদক্ষেপের ব্যাপারে সৌদি কর্তৃপক্ষ জেনে গেছে।
খাসোগি জানতে চান, ‘কীভাবে তারা (সৌদি কর্তৃপক্ষ) জেনেছে?’
জবাবে আবদুলাজিজ লেখেন, ‘কোথাও কোনো ফাঁক আছে।’
তিন মিনিট বিরতির পর প্রতিক্রিয়ায় খাসোগি বলেন, ‘আল্লাহ আমাদের সাহায্য করুন।’
আবদুলাজিজ খাসোগির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ থাকার বিষয়টি প্রথমবার প্রকাশ্যে বলেন গত মাসে। ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর সিটিজেন ল্যাবের গবেষকেরা জানান, তাঁর ফোন সামরিক গ্রেডের স্পাইওয়্যারে হ্যাক করা হয়েছিল। এরপরই তিনি প্রকাশ্যে এ নিয়ে কথা বলেন।
সিটিজেন ল্যাবের গবেষক ফেলো বিল মার্কজাকের তথ্য অনুসারে, ইসরায়েলের এনএসও গ্রুপ এই সফটওয়্যারটি সৌদি সরকারের নির্দেশে তৈরি করেছে। মার্কজাকের মতে, সৌদির আরও দুজনের ফোন হ্যাক করা হয়েছে। এর মধ্যে একজন হচ্ছেন অধিকারকর্মী ইয়াহিয়া আসিরি এবং সৌদি আরবে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এক স্টাফ সদস্য।
আবদুলাজিজের আইনজীবী তেলআবিবে এনএসওর বিরুদ্ধে সফটওয়্যার বিক্রিতে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গের অভিযোগে মামলা করেছেন।
আবদুলাজিজের ফোন হ্যাক করার অর্থ তাঁর সঙ্গে বিনিময় হওয়া চার শতাধিক বার্তার সবই পড়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। যুবরাজ মোহাম্মদ বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর জন্য খাসোগি কতটা ভীতিকর হয়ে উঠেছিলেন।
আবদুলাজিজ বলেন, মে মাসে সৌদি সরকারের দুজন লোক মনট্রিয়লে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন এবং জানান, যুবরাজ মোহাম্মদ তাঁর টুইট দেখেন এবং যুবরাজ তাঁকে চাকরি দিতে চান। পুরো বিষয়টি তিনি গোপনে ভিডিও করেন। সেগুলো তিনি সিএনএনকে দিয়েছেন।
তাঁরা সৌদি দূতাবাসে গিয়ে আবদুলাজিজকে কিছু কাগজপত্র নেওয়ার অনুরোধ করেন।
কিন্তু ভাগ্যের কী নিষ্ঠুর পরিহাস, আবদুলাজিজকে দূতাবাসে যেতে বাধা দেন খাসোগি। আবদুলাজিজ বলেন, উন্মুক্ত জায়গা ছাড়া ওই লোকদের সঙ্গে দেখা করতে খাসোগি তাঁকে নিষেধ করেন। খাসোগির পরামর্শ শোনার জন্য তিনি বেঁচে গেছেন। অথচ সেই ভুল খাসোগি নিজেই করলেন। তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেট ভবনে গিয়ে প্রাণ হারালেন।