প্রবাসী প্রজন্মের বিয়ে ভাবনা

প্রবাসী তরুণ প্রজন্মের বিয়ে-বিমূখতা অভিভাবকদের জন্য ভাবনার কারণ হয়ে উঠেছে। এ নিয়ে ব্যক্তিগত চাহিদা আর সাংস্কৃতিক সংঘাত এখন চরমে। অভিভাবক চাচ্ছেন এক, সন্তানদের পছন্দ আরেক। অনেক প্রবাসী সন্তানেরা না পারছে অভিভাবক আর নিজেদের প্রথা ও সংস্কৃতি পরিহার করতে। অনেক অভিভাবকেরাও আছেন টানাপোড়েনে। এ নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা থেকেও দেখছি, বিয়ে নিয়ে বিশেষ উৎসাহিত নয় প্রবাসী নবীন প্রজন্ম। যে সব কারণে ‘বিবাহ’ নামক প্রতিষ্ঠানটিতে আবদ্ধ হতে তাদের এই অনাগ্রহ—
১) স্বাধীনতাহীনতা ২) মানিয়ে নেওয়ার ঝক্কি ৩) সবার ওপরে ক্যারিয়ার ৪) দেখব এবার জগৎটাকে ৫) একটাই জীবন ৬) সম্পর্কে ক্লান্তি ৭) কোথায় পাব মনের মানুষ ৮) উপযুক্ত পাত্র চাই, পাত্রী চাই দাবি ৯) বিবাহিত যুগল মানেই ‘বিরক্তিকর’, ১০) বিবাহিত জীবন মানেই স্বপ্নপূরণে বাঁধা ১১) হারানো সুর, মনের মতো সঙ্গীর অভাব ১২) বিয়ে মানেই খবরদারি আর অশান্তি।

প্রবাসী বাঙালিরা নতুন প্রজন্মের বিয়েতে অনাগ্রহের কারণে একধরনের সংকটের মুখোমুখি হচ্ছেন। অনেকে সন্তানের বিয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্র-পাত্রীও খুঁজে পাচ্ছেন না। প্রবাসে বড় হওয়া সন্তানেরা দেশের ছেলে-মেয়েকে বিয়ে করতেও তেমন উৎসাহী নয়। তাদের ধারণা, দেশের লোকজন এখানে এসে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না। দুটি ভিন্ন পরিবেশে বড় হওয়ায় তাদের মন–মানসিকতারও তেমন মিল হয় না।
আমেরিকায় বড় হওয়া প্রজন্মের ‘হু কেয়ার্স’, ‘সো হোয়াট’ বা ‘আই ডোন্ট কেয়ার’–এর প্রবণতাও বেশ সমস্যা তৈরি করে পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে। অভিভাবকের সঙ্গে তারা অনেক সময়ই একমত হতে চায় না। অভিভাবকেরাও তাদের ইচ্ছে চাপিয়ে দিতে চান ছেলে-মেয়েদের ওপর। ফলে সমস্যা ক্রমেই জটিল ও দীর্ঘায়িত হয়। ছেলে-মেয়েরা স্কুল, কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় জীবনসঙ্গী খুঁজতে গিয়েও সমস্যায় পড়ে। ধর্মীয় বা পারিবারিক বিধিনিষেধের কারণে অনেক সম্পর্কই শেষপর্যন্ত বিয়ে অবধি গড়ায় না। বড় হওয়ার পর লেখাপড়ার চাপ, ক্যারিয়ার ভাবনার কারণে রোমান্টিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার তেমন আর সুযোগও থাকে না।
ভোগান্তি যেমন বাবা-মায়ের, তেমনি ছেলে-মেয়েরও। কাঙ্ক্ষিত জীবনসঙ্গী খোঁজার চ্যালেঞ্জের পেছনে রয়েছে ধর্ম, বর্ণ, জাতি, পারিবারিক ঐতিহ্যসহ নানা কারণ। দেশে আত্মীয়, বন্ধু, পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে পাত্র-পাত্রীর সন্ধান পাওয়া যায়। সেখানে সবারই সংস্কৃতি, ধর্ম ও বর্ণ এক। প্রবাসের চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত; পারিবারিক বা ব্যক্তিগত বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যা কম হওয়ায় পাত্র-পাত্রী সন্ধানের জগৎটাও এখানে খুবই সীমিত।
রক্ষণশীলরা বিদেশে পাত্র-পাত্রীর সংকট দেখে দেশে যান পাত্র-পাত্রী খুঁজতে। অনেকে দেশ থেকে বিয়ের মাধ্যমে আত্মীয় বা বন্ধুর ছেলেমেয়েকে বিদেশে নিয়ে আসতে চান। পাত্র-পাত্রী উভয়ে বাংলাদেশি একই ধর্মের হলেও সমস্যা দেখা দেয় ভিন্ন মনমানসিকতা ও পরিবেশ নিয়ে। বিদেশে বড় হওয়া ছেলে-মেয়ের তুলনায় দেশে বেড়ে উঠা ছেলে-মেয়ের চিন্তাভাবনা, আচার-ব্যবহার এবং জীবনযাত্রার প্রণালি অন্যরকম। সে ক্ষেত্রে খাপ খাওয়ানো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ফলে বিয়ের পর দেখা দেয় সমস্যা। একজন আরেকজনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে না। ভাষাগত সমস্যাও দেখা দেয়। বাংলাদেশি সংস্কৃতি থেকে আসা ছেলেমেয়েরা যখন দেখে তার নববিবাহিত স্ত্রী বা স্বামীর সঙ্গে অন্য ছেলে বা মেয়ের বন্ধুত্ব রয়েছে, তখন তা মনোমালিন্য তৈরি করে। এ দেশে বড় হওয়ার কারণে এখানকার অনেক কিছুই এই তরুণ প্রজন্মের জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলেছে যা তারা উপেক্ষাও করতে পারে না।
অনলাইন ম্যাচ–মেকিংয়ে অনেকেরই আস্থা নেই। সেখানে অনেক ক্ষেত্রে সত্য গোপন করা হয়। প্রায় সবাই চান পাত্র-পাত্রীকে হতে হবে চিকিৎসক, প্রকৌশলী বা আইনজীবী; যার আয় হবে আকাশচুম্বী। এ ব্যাপারে কোনো পক্ষই ছাড় দিতে চান না। একার আয়ে সংসারের বোঝা মাথায় নিতে তরুণেরা এখন আর আগ্রহী নয় বলে পাত্রপক্ষও মেয়ের রূপের পাশাপাশি শিক্ষা ও চাকরিকে প্রাধান্য দিতে শুরু করেছেন। নানা কারণে বিয়ের বয়স পার হয়ে গেলে বেশি সমস্যায় পড়েন মেয়েরা। তখন পাত্র খুঁজে পাওয়াটা আরও কঠিন হয়ে উঠে।
সম্প্রতি কিছু মুসলিমের মধ্যে ইসলামি ধ্যানধারণাও বেশি জেঁকে বসেছে। তাদের ধারণা, দেশের পাত্র-পাত্রী আনলে ধর্ম, সংস্কৃতি, সামাজিকতাও বজায় থাকবে। নতুন প্রজন্মের ধারণা, তাদের অভিভাবকদের মেলামেশা দেশি কমিউনিটির মধ্যে সীমাবদ্ধ বলেই আগের প্রজন্ম আমেরিকায় এতটা পিছিয়ে আছে। তরুণদের আমেরিকার বহুজাতিক স্রোতের সঙ্গে মিশতে হয়। তারা যদি চারপাশে নিজস্ব ধর্ম ও সংস্কৃতির বলয় গড়ে তোলে, তবে তাদেরও এই সমাজে পিছিয়ে পড়তে হবে। তাই ছেলেমেয়েরা ক্যারিয়ার থেকে বিয়ে সব ব্যাপারেই অভিভাবকদের চেয়ে নিজের পছন্দকেই গুরুত্ব দেওয়ার পক্ষপাতী।
দেশ থেকে কাউকে আনতে হলে কাগজপত্র প্রক্রিয়ায় অনেক সময় লেগে যায়। এই প্রক্রিয়া এখন আরও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। সময়ের দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির কারণে অনেক ক্ষেত্রে বিয়েবিচ্ছেদ ও পরকীয়ার সূত্রপাতও হয়। এখানকার অনেকের ধারণা, বিয়ের মাধ্যমে যারা বিদেশে আসতে চায় তারা নাগরিকত্বের লোভেই বিয়েতে আগ্রহী হয়। অন্যদিকে প্রবাসী ছেলের অভিভাবকেরা মনে করেন, প্রবাসে বেড়ে ওঠা মেয়েরা ভালো সংসারী হয় না; তুলনামূলকভাবে দেশের মেয়েরা ঘরোয়া ও ভালো। তাই তাদের আগ্রহ থাকে পুত্রবধূ হিসেবে দেশি মেয়ে আনা। দেশ থেকে সদ্য আসা ছেলেমেয়ের শিক্ষাগত যোগ্যতা যাই হোক, তাকে এখানে ন্যূনতম পারিশ্রমিকে চাকরি শুরু করতে হয়। এরপর কোর্স আপডেট করতেও কিছুটা সময় লেগে যায়। এসব নানা কারণে তারা একধরনের হীনমন্যতায় ভুগতে থাকে। তখন আমেরিকান স্বামী বা স্ত্রীর আচরণে যদি তুচ্ছতাচ্ছিল্য প্রকাশ পায়; সমস্যা তৈরি হতে সময় লাগে না। কখনো তা ভাঙনের দিকেও মোড় নেয়। বাস্তববাদীরা তাই দেশ থেকে পাত্র-পাত্রী আনার ব্যাপারে একটু দ্বিধাগ্রস্ত।
বিয়ের প্রস্তাব এলে মেয়েরা জানতে চায় ছেলের যোগ্যতা, চাকরি, বয়স, দেখতে কেমন, বাড়ি, গাড়ি এবং আলাদা থাকার নিশ্চয়তা আছে কিনা! অন্যদিকে ছেলেরাও কর্মজীবী, স্বাবলম্বী মেয়েকেই বেশি পছন্দ করে। কারণ কোনো কারণে বিয়ে ভেঙে গেলে আমেরিকার আইন অনুসারে স্বামীকে সম্পত্তি, টাকা–পয়সার সমান ভাগসহ স্ত্রী ও সন্তানের জন্য মাসিকভাতা হিসেবে বড় অঙ্কের টাকা গুনতে হয়; তাই সংসারের শুরু থেকেই ছেলেরা এখন ৫০/৫০ শেয়ারে পক্ষপাতী। এ কারণে অনেকে এখন ‘লিভিং টুগেদার’–এর দিকেও ঝুঁকছে। বিয়ে করলেও দেরিতে করছে। এরা শিক্ষা-দীক্ষায়, মন-মানসিকতায় অনেক অগ্রসর সম্প্রদায়। ‘জাতি-ধর্ম-রং’ নিয়ে তেমন মাথাব্যথা নেই বলে তারা নিজ কমিউনিটিতে পছন্দমতো কাউকে খুঁজে না পেলে বিকল্প জীবনসঙ্গী খুঁজে নিচ্ছে। অমিলগুলোও অনেক অভিভাবক বাধ্য হয়েই মেনে নিচ্ছেন। স্কুল, কলেজ বা ইউনিভার্সিটির পরিচয়ের সূত্রে ভালো লাগা, ভালোবাসা এবং পরবর্তীতে বিয়ে হলে বাবা-মায়ের দায়িত্বের বোঝা কমে যায়। তবে এ ক্ষেত্রে অভিভাবকেরা আশা করেন, ছেলেমেয়েরা যেন উপযুক্ত পাত্র-পাত্রী বেছে নেয়। ছেলেমেয়ের জন্ম যদি এখানে হয়, তাদের জন্য এখানে বড় হওয়া পাত্র-পাত্রী দেখাই ভালো। বেশির ভাগ ছেলেমেয়েও তাই চায়।