মাকে মনে পড়ে

যখন সুখের দিন: স্বামী গৌরাঙ্গনাথ ভৌমিক ও ছেলে শুভদেব ভৌমিকের সঙ্গে ঝর্ণা রানী ভৌমিক। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে
যখন সুখের দিন: স্বামী গৌরাঙ্গনাথ ভৌমিক ও ছেলে শুভদেব ভৌমিকের সঙ্গে ঝর্ণা রানী ভৌমিক। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে

৭ জুলাই ঈদের দিন সকালে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় পুলিশ ও জঙ্গিদের মধ্যে গুলিবিনিময়ের সময় প্রাণ হারান ঝর্ণা রানী ভৌমিক। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন ছেলে বাসুদেব ভৌমিক

আমি ছোটবেলা থেকে মায়ের স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা পেয়ে বড় হয়েছি। আমার সব বায়না ও আবদার মা পূরণ করতেন। মা সবকিছু সামলাতেন। ঈদের দিনেও (গত ৭ জুলাই) মা আমার জন্য পছন্দের সেমাই ও লুচি রান্না করছিলেন। স্নানের সময় আমার লুঙ্গিটা মা নিজহাতে এগিয়ে দিয়েছিলেন। আমার মায়ের স্নেহ ও মমতা আমাকে এখন শুধু কাঁদায়। মা নিজের সবকিছু উৎসর্গ করেন আমার শুভ কামনায়। মায়ের বড় ইচ্ছে আমি লেখাপড়া করে বড় হব। দোয়া করতেন ছেলের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের। আমাদের নিয়ে মায়ের অনেক স্বপ্ন ছিল। অনেক আশা ছিল কিন্তু তাঁর কোনো স্বপ্ন বা আশা পূরণ করে যেতে পারেননি। অপূর্ণতা নিয়েই তাঁকে চলে যেতে হয়েছিল না-ফেরার দেশে।
আমি ঢাকায় চলে আসার পর মা সব সময় আমার খোঁজখবর নিতেন। হঠাৎ যদি ফোন বন্ধ থাকত, মা অস্থির হয়ে যেতেন আমার খোঁজ নেওয়ার জন্য। এখন কেউ আমাকে ‘বাবু’ বলে ডাকে না। খোঁজখবর নেয় না। বলে না, বাবু তুমি খেয়েছ? কোথায়? কী খেয়েছ? সাবধানে থেকো...
মা ছিলেন আমাদের পরিবারের প্রেরণা। তিনি একাই সংসারের সবকিছু সামলাতেন। আমাদের পরিবার স্বল্প আয়ের, কিন্তু তা সত্ত্বেও মা কখনো অভাব-অনটন বুঝতে দেননি। পরিবারটিকে মায়া ও মমতার বন্ধনে আগলে রাখতেন। মায়ের বড় ইচ্ছে ছিল আমরা দুই ভাই লেখাপড়া করে বড় হব। ভালো চাকরি করব। মায়ের এই ইচ্ছাটুকু পূরণ হলে তাঁর আত্মা শান্তি পাবে।
নিভেছে প্রদীপ এ জীবনে জ্বলিবে না আর
কেটে গেছে সুর-বাঁধা তার;
সে আঁধারে পড়ে আছি—এক মহা ব্যর্থ হাহাকার!
আমার বাবা (গৌরাঙ্গনাথ ভৌমিক) আজ নিঃসঙ্গ। মা ছিলেন বাবার চলার শক্তি। মনোবল ও সাহস জুগিয়েছেন পাশে থেকে।

ঝর্ণা রানী ভৌমিক
ঝর্ণা রানী ভৌমিক

৭ জুলাই, বৃহস্পতিবার ২০১৬। সেদিন ছিল ঈদুল ফিতর। —কী আজ সকালে হাঁটতে যাবে না?
বাবাকে প্রশ্ন করেছিলেন মা। আমি শুয়ে শুয়ে শুনছিলাম। বাবা অসম্মতি জানিয়ে মঙ্গল আরতির ফুল নেওয়ার জন্য বেরিয়ে গেলেন। মা উদাসীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
বাবার ফুল নিয়ে আসতে আসতে মায়ের ঘরকন্নার কাজ প্রায় শেষ। আমি তখন ঘুম থেকে উঠলাম। স্নান শেষে বাবার আনা ফুল দিয়ে গৃহ দেবতার পুজোসম্পন্ন করে রন্ধনশালায় গেলেন মা। উদ্দেশ্য মিষ্টান্ন রান্নার আয়োজন। মা বললেন, তোমরা বসো, আমি গরম-গরম লুচি আর সেমাই নিয়ে আসছি। এটি ছিল আমার খুব পছন্দের। এই ফাঁকে আমি গেলাম স্নান করতে। মা আমার লুঙ্গিটা এনে রেলিংয়ের ওপর রাখলেন। স্নান সেরে আসতেই হঠাৎ চারদিকে গুলির আওয়াজ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটি গুলি, একটি বিকট আর্তনাদ। মাটিতে শায়িত প্রাণহীন একটি দেহ আর নিস্তব্ধ চারপাশ। মা আমার গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। বাবা, আমি আর ভাই নিথর দেহের পাশে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি মায়ের দিকে।
সময়মতো রান্না করে খাওয়ানো, সময়মতো ওষুধ আরও কত-কী...কিছু আর হবে না ঠিকমতো। মা চলে যাওয়ার পর বাবা কি সকালে হঁাটতে পারেন? সময়মতো খাওয়া হয় না। খাওয়ার পর পানের থালা নিয়ে কি আর কেউ তাঁর পাশে বসবে? আজ সবকিছু এলোমেলো। কোনো কিছু রুটিনমাফিক হয় না। অথচ আমাদের বাড়ি সবকিছু হতো রুটিনমাফিক। সবাই একসঙ্গে খেতে বসতাম সকাল, দুপুর আর রাতে।
আমাদের অবস্থা এখন অবর্ণনীয়। বাবাও বিভিন্ন রোগ-শোকে আক্রান্ত। বয়সের ভার আর শূন্যতা তাঁকে নাজেহাল করে ফেলেছে। কয়েক মাস আগে বাবার স্ট্রোক হয়েছিল। তাঁর দেহে অস্ত্রোপচার হয়। মায়ের সেবা-শুশ্রূষায় বাবা সুস্থ হয়ে ওঠেন। মাকে হারিয়ে বাবা আগের মতো চলতে পারছেন না। এই অবস্থায় আমাদের পরিবারটি প্রায় নিঃশেষ হতে চলেছে। বাবা প্রাণখোলা সহজ-সরল মানুষ। অভাবের সংসার মা আগলে রাখতেন মমতা দিয়ে। বাবা বন্ধুবৎসল ও পরোপকারী। কারও প্রতি তাঁর হিংসা বিদ্বেষ ছিল না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বাবা বিশ্বাস করতেন। তাঁর মধ্যে একটা নীরব আত্মসম্মানবোধ সর্বদা জাগ্রত থাকে।
বাবা যখন মায়ের কথা বলেন, তখন আমি আর ভাষা খুঁজে পাই না। আমার ছোট ভাই শুভদেব আজ স্তব্ধ। সে কেবল মায়ের ছবি দেখে আর কাঁদে। কিছু বলে না। মা ছিল তার একমাত্র সঙ্গী ও তার গৃহশিক্ষিকা। সে মায়ের আঁচল ধরে সব সময় থাকত। ঘুমাত মায়ের সঙ্গে। তারও আবদার-ইচ্ছা সবকিছু ছিল মাকে ঘিরে। আজ মা নেই চরম সত্য; কিন্তু সে সেটা কিছুতেই মানতে পারছে না। হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে মা মা বলে কাঁদে।
এখন আমার ছোট ভাই ১২ বছরের শুভদেবের সময় কাটে মায়ের অপেক্ষায় মা তার কখন আসবে, কবে আসবে, একটু আদর করে কপালে চুমু খাবে—সেই সব অবাস্তব কল্পনায়। ভাইয়ের স্কুলের বাড়ির কাজের খাতাগুলো এখন অসমাপ্ত। কেনই-বা হবে না? মা যে তার গৃহশিক্ষিকা ছিলেন। বিষাদগ্রস্ত মানসিক যন্ত্রণায় অস্থির, চোখের সামনে ঘটে যাওয়া হৃদয়বিদারক দৃশ্য এখনো তাকে ভয় পাইয়ে দেয়। আজ আমরা মাতৃহীন। মা-হারা অনাথ কেউ যখন বলে আমাদের মা মরে গেছেন বা মা নেই বা অনাথ, তখন বুকের ভেতরটা চমকে ওঠে মা নেই!
মায়ের স্বপ্ন পূরণে ঢাকা আসি। স্বল্প আয়ের চাকরিতে আমার মেসের জীবন যখন কোণঠাসা, তখন কীভাবে বাবা আর ভাইকে নিয়ে ঢাকায় থাকি? তারা না পাচ্ছে মায়ের ভালোবাসা ও সেবা, না আমার কাঙ্ক্ষিত আশ্রয়। আমি নির্বাক, অশ্রুসিক্ত ও নিরুপায়।