জরুরি অবস্থা ঘোষণার প্রস্তুতি ট্রাম্পের

ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি
ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি

প্রায় হাওয়া থেকে এক সংকট আবিষ্কার করার চেষ্টায় রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। হোয়াইট হাউস থেকে যুক্তি দেখানো হচ্ছে, দেশের দক্ষিণ সীমান্ত দিয়ে বিপুল পরিমাণে অবৈধ অভিবাসী আসছে, তাদের সঙ্গে আসছে হাজার হাজার ভয়ংকর সন্ত্রাসী। তারা আমেরিকার নিরাপত্তার জন্য হুমকি। এই হুমকি মোকাবিলায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই।

ট্রাম্প জানিয়েছেন, আজ মঙ্গলবার এক টেলিভিশন ভাষণে দেশের সামনে যে ভয়াবহ সংকট দেখা দিয়েছে, তার সবিস্তার ব্যাখ্যা দেবেন। আগামী বৃহস্পতিবার তিনি টেক্সাসে একটি সীমান্ত অঞ্চল সফর করবেন। ধারণা করা হচ্ছে, টেলিভিশন ভাষণের মাধ্যমে ট্রাম্প হয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করবেন অথবা জরুরি অবস্থা ঘোষণা কেন প্রয়োজন, তার যুক্তি তুলে ধরবেন। একই ভাষণে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের চলতি সংকট মোকাবিলায় দেশের দক্ষিণ সীমান্তে স্থায়ী দেয়াল নির্মাণ কেন জরুরি, সে কথাও বুঝিয়ে বলবেন।

এদিকে দেয়াল প্রশ্নে হোয়াইট হাউস এবং বিরোধী ডেমোক্র্যাটদের মতান্তরের কারণে মার্কিন সরকারের একাংশের কাজকর্ম ১৯ দিন ধরে বন্ধ হয়ে আছে। সরকার শুরুর প্রশ্নে দুই পক্ষের মধ্যে কথাবার্তা চলছে বটে, কিন্তু কোনো পক্ষই তাদের অবস্থান পরিবর্তনে সম্মত হয়নি। ট্রাম্প জানিয়েছেন, তিনি দেয়াল ও সীমান্ত নিরাপত্তা বাবদ ৫ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার চান। অন্যদিকে, ডেমোক্র্যাটরা বলছেন, সীমান্ত নিরাপত্তা প্রশ্নে তাঁরা ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার দিতে প্রস্তুত। কিন্তু দেয়াল বাবদ এক পয়সাও নয়। তাঁরা এ কথাও বলছেন, এই মুহূর্তে দেয়াল প্রশ্নে তর্ক না বাড়িয়ে অবিলম্বে সরকারের কার্যক্রম চালু করা হোক।

গতকাল সোমবার ডেমোক্রেটিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শেষে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স সাংবাদিকদের জানান, জরুরি অবস্থা বিষয়ে ট্রাম্প এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। তবে হোয়াইট হাউসের আইনজীবীরা বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখছেন।

অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ মনে করেন, জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়লে জরুরি অবস্থা জারির আইনগত অধিকার প্রেসিডেন্টের আছে। কিন্তু বিষয়টি প্রায় তাৎক্ষণিকভাবেই আইনি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। দেশে এই মুহূর্তে কোনো দৃষ্টিগ্রাহ্য জরুরি অবস্থা নেই, তা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট দেয়ালের দাবি তুলে কেন জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন, আদালতের সামনে তা ব্যাখ্যা করা খুব সহজ হবে না।

জানা গেছে, জরুরি অবস্থার সুযোগ নিয়ে ট্রাম্প প্রতিরক্ষা খাতে এর আগে বরাদ্দকৃত অর্থ থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলার তাঁর প্রস্তাবিত দেয়াল নির্মাণের জন্য স্থানান্তর করতে পারেন। বিরোধী ডেমোক্র্যাটরা অবশ্য ট্রাম্পকে এমন কোনো চেষ্টা না করার বিরুদ্ধে সাবধান করে দিয়েছেন। প্রতিনিধি পরিষদের বিচার বিভাগীয় কমিটির চেয়ারম্যান কংগ্রেসম্যান জেরি ন্যাডলার বলেছেন, এমন কোনো চেষ্টা শাসনতন্ত্রবিরোধী হবে। কোন খাতে কী অর্থ ব্যয় হবে, তা বরাদ্দের দায়িত্ব কংগ্রেসের। তিনি জোর দিয়ে বলেন, প্রেসিডেন্ট দেশের রাজা সাজার চেষ্টা করলে ডেমোক্র্যাটরা তার বিরোধিতা করবে।

ট্রাম্পের আজকের ভাষণের ব্যাপারে ন্যাডলার বলেন, ‘আমি জানি, ভাষণে ট্রাম্প মিথ্যা কথা বলবেন। আমি এ কথা বলছি, কারণ ট্রাম্প আগাগোড়াই মার্কিন জনগণের সঙ্গে মিথ্যাচার করে আসছেন।’

উল্লেখ্য, গতকাল ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার সময় ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স ও হোমল্যান্ড সিকিউরিটির মন্ত্রী কিরস্টেন নিয়েলসন দাবি করেন, হাজার হাজার সন্ত্রাসী সীমান্ত পার হয়ে আসার চেষ্টা করার সময় ধরা পড়েছে। কিন্তু হোমল্যান্ড সিকিউরিটি দপ্তরের তথ্য অনুসারে, ধরা পড়েছে—এমন সন্ত্রাসীর সংখ্যা মাত্র ছয়।

অনেকে আশঙ্কা করছেন, দেয়াল নিয়ে ট্রাম্প ও ডেমোক্র্যাটরা যে টানাহ্যাঁচড়া করে চলেছেন, তার জেরে দেশে সত্যি সত্যি একটি মানবিক বিপর্যয় ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। বেতন না হওয়ায় সবচেয়ে বিপদে পড়েছে স্বল্প আয়ের মানুষ। ট্রাম্প দুই দিন আগে দাবি করেছিলেন, বেতন না পেলেও আমেরিকার মানুষ তাঁর সঙ্গে আছেন। কারণ, তাঁরা বোঝেন, জাতীয় নিরাপত্তা প্রশ্নটি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পত্রপত্রিকায় অভাবী মানুষের দুঃখ-কষ্টের গল্প প্রকাশ হওয়া শুরু করেছে। সাহায্য ভাতার ওপর নির্ভরশীল অনেক মানুষ এখন কী করবেন, তা ভেবে পাচ্ছেন না। তাঁদের একজন মন্তব্য করেছেন, দেয়াল দিয়ে না হয় অবৈধ অভিবাসী ঠেকানো যাবে। কিন্তু তাতে তো টেবিলে খাবার জুটবে না। বেতন না হওয়ায় বিমানবন্দরগুলোয় নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত কর্মীদের অনেকে কাজে আসছেন না। কোথাও কোথাও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এই অবস্থায় দেয়ালের দাবি তুলে সরকারি কাজকর্ম বন্ধ রাখার গোঁ ধরায় অনেকে ট্রাম্পকে দোষারোপ করা শুরু করেছেন। এমনকি রিপাবলিকান পার্টির ভেতরেও কেউ কেউ ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে অবিলম্বে সরকারি অফিস খুলে দেওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন।

রিপাবলিকানদের সরকার খোলার ব্যাপারে রাজি করাতে ডেমোক্র্যাটরা বুধবার অভ্যন্তরীণ রাজস্ব ও অন্য চারটি বিভাগের বাজেট বরাদ্দ মঞ্জুর করে ভিন্ন ভিন্ন প্রস্তাব গ্রহণের পরিকল্পনা করছেন। তাঁরা আশা করছেন, ২৫ বা তার চেয়ে বেশিসংখ্যক রিপাবলিকান সদস্য এই প্রস্তাব সমর্থন জানাতে পারেন। সিনেটের তিনজন সদস্যও জানিয়েছেন, তাঁরা ডেমোক্র্যাটদের প্রস্তাব সমর্থন করবেন। নিজ দলের ঐক্যে ফাটল ধরছে—এমন বিপর্যয়ের আঁচ পেয়ে ট্রাম্প মাইক পেন্স ও অন্য জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের রিপাবলিকান সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে নির্দেশ দিয়েছেন। তা সত্ত্বেও ‘ভালোসংখ্যক’ রিপাবলিকান সদস্য প্রতিনিধি পরিষদে ডেমোক্রেটিক প্রস্তাবে সমর্থন জানাতে পারেন বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন প্রভাবশালী রিপাবলিকান নেতা স্টিভ স্কালিস ও কেভিন ম্যাকার্থি।

প্রতিনিধি পরিষদে সরকার খুলে দেওয়ার প্রস্তাব গৃহীত হলেও সিনেটে সে প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার সম্ভাবনা কম। শুধু কংগ্রেসের উভয় কক্ষে সে প্রস্তাব গৃহীত হলেই তা ট্রাম্পের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে। কিন্তু সিনেটে রিপাবলিকান নেতা মিচ ম্যাককনেল জানিয়েছেন, ট্রাম্প পূর্বসম্মতি না জানানো পর্যন্ত তিনি সিনেটে বাজেট প্রস্তাব নিয়ে কোনো আলোচনা অনুমোদন করবেন না। ম্যাককনেলের এই একরোখা অবস্থানের জবাবে সিনেটে ডেমোক্রেটিক নেতা চাক শুমার জানিয়েছেন, সরকার না খোলা পর্যন্ত তাঁরা সিনেটে অন্য কোনো বিষয়ে সব প্রস্তাব উত্থাপনের বিরোধিতা করবেন। তাঁদের সেই আইনগত ক্ষমতা রয়েছে। সত্যি সত্যি এমন ঘটলে শুধু ফেডারেল সরকার নয়, মার্কিন কংগ্রেসের কাজকর্মও কার্যত বন্ধ হয়ে আসবে।