কিশোরী পালিয়ে এল যেভাবে

তিন মাস বন্দী থাকার পর পালাতে পারে কিশোরী জেমি। ছবি: ইনস্টাগ্রাম
তিন মাস বন্দী থাকার পর পালাতে পারে কিশোরী জেমি। ছবি: ইনস্টাগ্রাম

ঘরে মা–বাবার লাশ পড়ে আছে, তাঁদের কিশোরী মেয়ে নিখোঁজ। তিন মাস ধরে কিশোরীকে হন্যে হয়ে খুঁজছিল গোয়েন্দা সংস্থা ও স্থানীয় পুলিশ। কিন্তু মেয়েটি যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। তিন মাস পর শীর্ণ চেহারায় রাস্তায় সাহায্য চাইতে দেখা গেল সেই কিশোরীকে। এর পেছনে রয়েছে ভয়াবহ এক কাহিনি।

পুলিশের মতে, এক তরুণ ওই কিশোরীর মা–বাবাকে হত্যা করে তাঁকে অপহরণ করে নিয়ে আটকে রাখে। তিন মাস পর ওই তরুণের বন্দিদশা থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয় ১৩ বছরের ওই কিশোরী।

যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ হত্যা ও অপহরণের অভিযোগে ওই তরুণকে গ্রেপ্তার করেছে। সবে শৈশব পেরোনো ওই কিশোরীর সাহসিকতা ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হচ্ছে গণমাধ্যমে।

যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যের ডগলাস কাউন্টির ছোট শহর গর্ডন থেকে জেমি ক্লস নামের ওই কিশোরীকে গত বৃহস্পতিবার উদ্ধার করা হয়েছে। কিশোরীর বাড়ি গর্ডন থেকে ১১০ কিলোমিটার দূরে, একই অঙ্গরাজ্যের ব্যারন কাউন্টির ব্যারন শহরে। ওই বাড়িতে বাবা জেমস ক্লস ও মা ডেনাইজ ক্লসের সঙ্গে থাকত জেমি।

গত বছরের ১৫ অক্টোবর জেমির মা–বাবাকে গুলি করে মেরে তাকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২১ বছরের তরুণ জ্যাক টমাস প্যাটারসনকে।

গতকাল শুক্রবার পুলিশ ঘটনাটি সম্পর্কে গণমাধ্যমকে জানায়। সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ কিশোরীর সাহসিকতার প্রশংসা করে।

যেখানে জেমিকে আটকে রাখা হয়েছিল, সে এলাকাটি বেশ দূরে। ইউ ক্লেয়ার নদী ঘিরে সেখানে ৩০টির মতো বাড়ি রয়েছে।
জেমির সন্ধানে দেশজুড়ে এফবিআই, টহল পুলিশ ও স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করছিল।

পুলিশ জানিয়েছে, জেমিই ছিল প্যাটারসনের একমাত্র নিশানা। জেমিকে অপহরণের জন্যই তার বাবা-মাকে হত্যা করেন প্যাটারসন। তবে কেন জেমিকে অপহরণ করেছেন, প্যাটারসন তা এখনো স্পষ্ট নয় পুলিশের কাছে। তাঁর বিরুদ্ধে অতীতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কোনো রেকর্ড নেই পুলিশের কাছে। উদ্ধার জেমিকে তার খালার কাছে দেওয়া হয়েছে।

জেমির খালা সু অ্যালার্ড বলেন, ‘তিন মাস ধরে এ খবরটি পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে ছিলাম। ওকে জড়িয়ে ধরার জন্য আমি আর অপেক্ষা করতে পারছিলাম না।’
জেমির চাচা জেফ ক্লস বলেন, জেমিকে না পেয়ে তাঁরা আশঙ্কা করেছিলেন, ঘটনা কোনো খারাপ দিকে মোড় নিয়েছে।

১৫ অক্টোবর যা ঘটেছিল
১৫ অক্টোবর বাসা থেকে নিখোঁজ হয় জেমি ক্লস। ব্যারন শহরে জেমিদের বাসা থেকে জরুরি সেবা ৯১১ এ ফোন পায় পুলিশ। ফোনে আশপাশ থেকে গোলমালের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল পুলিশ, তবে পুলিশের সঙ্গে সরাসরি কেউ কথা বলেনি। সন্দেহজনক ঘটনার আঁচ পেয়ে ফোনটি পাওয়ার চার মিনিট পর ওই বাসায় পৌঁছায় পুলিশ। সেখানে গিয়ে তাঁরা জেমির বাবা-মার গুলিবিদ্ধ লাশ পড়ে থাকতে দেখে। বাসার কোথাও জেমির কোনো চিহ্ন ছিল না। সেখানে সন্দেহভাজন তরুণ ছিল না বা কোনো অস্ত্রও ছিল না।

ব্যারন কাউন্টির শেরিফ ক্রিস ফিটজগেরাল্ড বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্যাটারসনের সঙ্গে কোনো পরিচয় ছিল না কিশোরী জেমির। প্যাটারসনের তাঁর পরিবারের কারও সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। এটা খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার যে ১৩ বছরের একটি মেয়ে পালিয়ে আসতে পেরেছে। এ ঘটনায় জেমি হিরো, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

পুলিশ জানিয়েছে, জেমিকে এখন কিছুটি স্থির হওয়ার সময় দেওয়া হচ্ছে। তার মানসিক ও শারীরিক চিকিৎসার পর তাঁকে তদন্তকারী কর্মকর্তারা জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। প্রাথমিক অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এখন সে সুস্থ।

যেভাবে জেমি পালায়
গত বৃহস্পতিবার জেমি প্রত্যন্ত এলাকার ওই বাসা থেকে পালায়। সে যখন পালায়, তখন প্যাটারসন বাসায় ছিলেন না।

জেমির মা–বাবাকে হত্যা করে তাকে অপহরণের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে প্যাটারসনকে। ছবি: এএফপি
জেমির মা–বাবাকে হত্যা করে তাকে অপহরণের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে প্যাটারসনকে। ছবি: এএফপি

শেরিফ ফিটজগেরাল্ড জানান, তদন্ত কর্মকর্তারা এখনো জানেন না, জেমি কীভাবে ওই বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে। ওই বাড়িতে তাকে পাটারসন কীভাবে রেখেছিল, সে সম্পর্কেও এখনো জানা যায়নি। জেমি যখন পালায়, তখন প্যাটারসন বাড়িতে ছিলেন না। তিনি বাড়ি ফিরে এসে জেমিকে দেখতে না পেয়ে গাড়ি নিয়ে খুঁজতে বের হন। ওই সময়ে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। স্থানীয় স্কুলের শিক্ষক জেনি নাটার তাঁর কুকুরকে নিয়ে হাঁটতে বের হয়েছিলেন। ওই সময় তিনি জেমিকে দেখতে পান। তাঁকে দেখতে পেয়ে জেমি চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘আমাকে সাহায্য করুণ। আমি কোথায় আছি জানি না। আমি হারিয়ে গেছি।’

জেনি নাটার বলেন, তিনি জেমিকে জীর্ণ শীর্ণ, অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় দেখতে পান। তার পায়ের তুলনায় বড় এক জোড়া জুতা ছিল পায়ে। জায়গাটি তাঁর বাসা থেকে বেশ দূরে ছিল। তিনি জেমিকে সঙ্গে নিয়ে পাশে ক্রিস্টিন ও পিটার কাসিনসকাস নামের এক দম্পতির বাসায় যান।

পিটার কাসিনসকাস জানান, তিনি জেমির দশা থেকে চমকে উঠেছিলেন। তিনি বলেন, ‘মনে হচ্ছিল আমি ভূত দেখছি। আমার চোয়াল ঝুলে পড়েছিল।’ ওই বাড়িতে জেমি ২০ মিনিটের মতো ছিল। তাকে খাবার ও পানি সাধলে সে খেতে অস্বীকৃতি জানায়।

পিটার কাসিনসকাসের বাড়ি থেকে কয়েকটি বাড়ি পরেই প্যাটারসনের বাড়ি। পিটার কাসিনসকাসের স্ত্রী ক্রিস্টিন প্যাটারসনের স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তিনি প্যাটারসনকে চিনতে পারেন। তিনি জানান, প্যাটারসন স্কুলে শান্ত প্রকৃতির ছেলে ছিল। স্কুল থেকে বেরোনোর পর রাস্তায় বা শহরের কোথাও তিনি প্যাটারসনকে আর দেখেননি।

পুলিশের কাছে এখনো অজানা কেন জেমির প্রতি এতটা ঝুঁকেছিলেন প্যাটারসন। বেকার প্যাটারসনের জেমিদের ব্যারন শহরে খুব ভালো যাতায়াত ছিল।

প্যাটারসনকে গ্রেপ্তারের জন্য রাস্তা অবরোধ করে রাখে পুলিশ। ছবি: এএফপি
প্যাটারসনকে গ্রেপ্তারের জন্য রাস্তা অবরোধ করে রাখে পুলিশ। ছবি: এএফপি

পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনার পর পুলিশের কাছ থেকে নিজেকে লুকাতে নানান ব্যবস্থা নেন প্যাটারসন। চেহারায় পরিবর্তন আনতে মাথা ন্যাড়া করেন। ঘটনাস্থলে তিনি কিছু ফেলেও যাননি। জেমিকে অপহরণের জন্য তিনি পাকাপোক্ত ব্যবস্থা নিয়ে এসেছিলেন।
পুলিশ প্যাটারসনের শটগানসহ বেশ কয়েকটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে। জেমির বাবা-মাকে হত্যায় ব্যবহৃত শটগানের সঙ্গে প্যাটারসনের শটগানের সাদৃশ্য পাওয়া গেছে।

ডগলাস কাউন্টির পুলিশ কর্মকর্তারা প্যাটারসনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। পরে তাঁকে ব্যারন কাউন্টি কারাগারে পাঠানো হয়।

ব্যারন কাউন্টি ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি ব্রায়ান রাইট জানিয়েছেন, সোমবার প্যাটারসনকে আদালতে হাজির করা হবে।

জেমিকে উদ্ধারের পর তার ছবি প্রকাশ করে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন অপহরণ থেকে উদ্ধার হওয়া আরেক নারী এলিজাবেথ স্মার্ট। ইনস্টাগ্রামে জেমির ছবি প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘এই মেয়েটির গল্প যা–ই থাকুক, মেয়েটি উদ্ধার হয়েছে, আসুন, এটিই আমরা মনে রাখি।’
এলিজাবেথ স্মার্ট অপহরণের ঘটনাটি যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম আলোচিত অপহরণের ঘটনা ছিল। ২০০২ সালে ১৪ বছর বয়সে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চলের ইউটাহ অঙ্গরাজ্য থেকে অপহরণের শিকার হন। ৯ মাস তিনি বন্দী ছিলেন।