যুক্তরাষ্ট্রে শাটডাউন: প্রশ্ন সোজা, উত্তর কঠিন

শাট ডাউনের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রায় আট লাখ কর্মচারী বেতন পাচ্ছেন না।
শাট ডাউনের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রায় আট লাখ কর্মচারী বেতন পাচ্ছেন না।

আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের ‘শাট ডাউন’ চলছে। একটি দেশের সরকারের বড় অংশ বন্ধ করে দিয়ে দেশ চলতে পারে, এমন নজির আমেরিকা ছাড়া অন্য কোথাও আছে কি না, কেউ জানে না। আমেরিকায় সরকার হরতাল-অবরোধে বন্ধ হয়নি। সরকার যাঁরা চালান, তাঁরাই বন্ধ করে দিয়েছেন। সব সম্ভবের দেশ আমেরিকায় কেন্দ্রীয় সরকার বন্ধ হয়ে যায়; অঙ্গরাজ্য সরকার নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে।

অনেকেরই মনে পড়তে পারে, ২০১৩ সালে আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ নগর ডেট্রয়েট নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করেছিল। অর্থনৈতিক কারণে দেউলিয়া হওয়া ডেট্রয়েট নগরীর গল্প ভিন্ন। আমেরিকার কেন্দ্রীয় সরকার বন্ধ হওয়ার বাস্তবতাও ভিন্ন।

রাষ্ট্রীয় অর্থ বিল নিয়ে আইনপ্রণেতাদের সঙ্গে প্রশাসনের সংঘাত দীর্ঘদিনের। সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময়েও ফেডারেল সরকার বন্ধ ছিল কিছুদিন। ‘শাট ডাউন’ নামে পরিচিত কেন্দ্রীয় সরকার বন্ধ হওয়ার ফলে ওয়াশিংটনে অচলাবস্থা চলছে। কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর নির্ভরশীল কর্মসূচিগুলো মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। যাঁরা খাদ্য ভর্তুকি পেয়ে থাকেন, তাঁরা পাচ্ছেন না। ইমিগ্রেশন থেকে কর বিভাগে পর্যন্ত অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এয়ারপোর্টে চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রায় আট লাখ কর্মচারী বেতন পাচ্ছেন না।

রাজনৈতিক উত্তাপের মধ্যে দাঁড়িয়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলছেন, শাট ডাউন চলবে। ২২ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া ‘শাট ডাউন’ কত দিন চলবে, কেউ বলতে পারছেন না। যেসব কারণে এ অচলাবস্থার নিরসন হতে পারে তার কোনোটাই হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে মনে করছেন মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।

এর মধ্যে ১৬ জানুয়ারি বুধবার ডেমোক্র্যাট দলের নেতা স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেন তাঁর ‘স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন’ বক্তৃতা পিছিয়ে দেন। ২৯ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এ বক্তৃতা দেওয়ার কথা। ডেমোক্র্যাট নেতা ন্যান্সি পেলোসি বলেছেন, নিদেনপক্ষে প্রেসিডেন্ট যেন শাট ডাউনের এই সময়ে সরাসরি বক্তৃতার বদলে লিখিত বক্তৃতা দেন।

আমেরিকার রাজনীতি কোন পর্যায়ে গেলে এমন হয়, তা অনেকেই ভেবে পাচ্ছেন না। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্টকে সরাসরি বক্তৃতা দেওয়ার বদলে লিখিত বক্তৃতা দেওয়ার অনুরোধ করা হচ্ছে, এ নিয়ে মার্কিন বিশ্লেষকেরা নানা কথা বলছেন। প্রথা অনুযায়ী বছরের শুরুতে কংগ্রেসের যৌথসভায় প্রেসিডেন্ট সরাসরি বক্তৃতা দেবেন, এমন বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চাচ্ছেন ডেমোক্র্যাট কংগ্রেস সদস্যরা। যেন প্রেসিডেন্টের মুখ দেখতেও তাঁরা নারাজ! অনেকেই বলছেন, অন্য যেকোনো সময় হলে অন্তত প্রেসিডেন্টের ‘স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন’ বক্তৃতার উপলক্ষ ধরে হলেও শাট ডাউনের অবসান ঘটতে পারত। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আমেরিকা এমন সম্ভাবনা থেকেও বেশ দূরে চলে গেছে!

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতেই বলেছিলেন, আমেরিকার দক্ষিণ সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ করবেন। বলেছিলেন, এ অর্থ মেক্সিকোর কাছ থেকে আদায় করবেন। এ দেয়াল নির্মাণের ফলে আমেরিকায় অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধ হবে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। যা নিয়ে বিতর্ক নেই তা হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সমর্থকদের মধ্যে এ দয়াল নির্মাণ একটি রাজনৈতিক অবস্থান। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একপর্যায়ে কিছুটা নমনীয় হয়ে সমঝোতার চেষ্টা করেছিলেন, সে সময় রাশ লিম্বোর মতো রক্ষণশীলেরা সরাসরি ট্রাম্পের সমালোচনায় নেমে পড়েন। কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও সমঝোতা করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর রাজনৈতিক সমর্থনের ভিত্তিকে এখন আর হতাশ করতে চান না।

উল্টো দিকে কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ এখন ডেমোক্র্যাটদের হাতে। ডেমোক্র্যাট দলের নেতা স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চাহিদামতো অর্থ বরাদ্দ অনুমোদন করতে পারেন অচলাবস্থা নিরসনের জন্য। আংশিক অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করলেও সমঝোতা হতে পারত। উদারনৈতিক ডেমোক্র্যাটরা এ নিয়ে এককাট্টা। ন্যান্সি পেলোসিও ডেমোক্র্যাটদের দেখাতে চান, নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে তাঁরাও শক্ত অবস্থানে দাঁড়াতে পারেন।

সিনেটে রিপাবলিকানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। সিনেটের নেতারা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আপসের পথ দেখতে পারেন। তাঁদের হাতে থাকা একটি আপসের অর্থবিল নিজেরা গ্রহণ করে প্রেসিডেন্টকে অনুমোদনের জন্য অনুরোধ করতে পারেন। তা হবে না। কারণ, সিনেটে রিপাবলিকান নেতা মিচ মেককলেন এরই মধ্যে বলেছেন, প্রেসিডেন্ট স্বাক্ষর দিতে সম্মত নন এমন প্রস্তাব তাঁরা অনুমোদন করবেন না। স্পষ্টত সিনেটের রিপাবলিকান নেতারা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অ্যাজেন্ডার বাইরে অবস্থান নেবেন না বলেই এদিক থেকেও সমস্যা সমাধানের কোনো আলো দেখতে পারছেন না কেউ।

অন্য সমাধান হলো, আমেরিকার ভেঙে পড়া অভিবাসনব্যবস্থা নিয়ে চলে আসা দীর্ঘ সমস্যার সমাধানে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের একমত হতে না পারা। অভিবাসন নিয়ে উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার মাধ্যমে সমন্বিত অভিবাসন সংস্কার আইন পাস করে একটা সমঝোতা হতে পারে। দেয়াল নিয়ে চলা অচলাবস্থার এ সময়ে এমনটি হবে, এমন কেউ আশা করছেন না।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, তিনি দেশে জরুরি অবস্থা জারি করতে পারেন। এ ব্যাপারে প্রেসিডেন্টের সাংবিধানিক ক্ষমতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। জরুরি অবস্থার মধ্য দিয়েও শাট ডাউন সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে করা হচ্ছে না। দেশের বাস্তবতা জরুরি অবস্থা পর্যন্ত গড়ালে বিষয়টি আদালতে যাবে। ফলে জরুরি অবস্থাও শাট ডাউন সমস্যার সমাধান নয়।

তাহলে দীর্ঘস্থায়ী অচলাবস্থার নিগড় থেকে আমেরিকার কেন্দ্রীয় সরকার কবে বেরোবে? ওয়াশিংটনের রাজনীতি কী উত্তপ্তই থেকে যাবে? ফেডারেল সরকারে কাজ করা প্রায় আট লাখ লোক কবে বেতন-মজুরি পাবেন? ফেডারেল অনুদানে, সমর্থনে চলা জরুরি কর্মসূচি কত দিন থুবড়ে থাকবে? জানা গেছে, আমেরিকার ফেডারেল আদালতগুলোর হাতে চালু থাকার মতো মাত্র ৯ দিনের অর্থ রয়েছে! কী হবে এরপর? আদালতের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে? জিজ্ঞাসা জনে জনে, তবে উত্তর কারও নেই জানা!