জয় হোক সংস্কৃতির

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট উত্তর আমেরিকার ২০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠিত হচ্ছে জেনে আমি আনন্দিত। বিদেশ-বিভুঁইয়ে থেকেও যে তারা নিজের অস্তিত্ব ও শেকড়কে ভুলে যাননি এ আয়োজন সে দেশপ্রেমেরই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। নানা কারণে আমাদের দেশের অনেকেই বিদেশে স্বল্প মেয়াদে বা স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন এবং এটি পৃথিবীর অন্য সব দেশের নাগরিকদের ক্ষেত্রেও ঘটছে। কিন্তু আমরাই সম্ভবত একমাত্র জাতি যাদের ভাষা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে আলাদা রাষ্ট্র আছে আর সে কারণেই আমরা বলি বাঙালির জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ। বাঙালির শুধু ভাষার ক্ষেত্রে ঐক্য নয়—খাদ্যাভ্যাস, পোশাকপরিচ্ছদ, দেহের গড়ন ও রং, পেশা, নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ সকল ক্ষেত্রেই আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই বৈশিষ্ট্যই বাঙালিকে একটি স্বতন্ত্র জাতিসত্তায় পরিণত করেছে। এই জাতি গঠনে আমাদের কবি-লেখক, শিল্পী, জ্ঞানী-গুণী, সাধক ও খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষও অসামান্য অবদান রেখেছে। কৃষিপ্রধান এ গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের তের শ নদীর কুলকুল ধ্বনি আর জলপ্রবাহে বাঙালির জাতিসত্তা বিনির্মাণের উপাদান, ইতিহাস আর আনন্দ-বেদনার কাহিনি বিধৃত রয়েছে। এ কথা আমাদের ভুললে চলবে না যে, প্রধানত কৃষিকে ভিত্তি করেই নানা উৎসবের আয়োজনে মেতে ওঠে গ্রাম বাংলার প্রতিটি লোকালয়। শত শত বছর ধরে এ ধারাই অব্যাহত রয়েছে। নবান্ন উৎসব, পৌষ মেলা, পিঠা উৎসব, কত ধরনের আয়োজন চলে বাংলার প্রতিটি প্রান্তরে।
আমাদের এ অঞ্চলের আরেকটি স্বাতন্ত্র্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো ষড়্ঋতু। আবহাওয়া এবং জলবায়ুর তারতম্যের ভিত্তিতে আমাদের এই অঞ্চলকে ছয়টি ঋতুতে ভাগ করা হয়েছে- গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত। প্রতিটি ঋতুই আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমাদের পেশা ও জীবন প্রবাহকে চিত্রিত করে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে এই ঋতু বৈচিত্র্যের রূপ-রস-গন্ধ আমাদের সংস্কৃতির ভান্ডারে যুক্ত করেছেন। এই ছয় ঋতুকে নিয়ে দেশব্যাপী আয়োজিত হয় বাংলা নববর্ষ, চৈত্র সংক্রান্তি, বসন্ত উৎসব, শরৎ উৎসব—আরও কত কী। এ সব উৎসব বাঙালির অসাম্প্রদায়িক বোধ এবং সম্প্রীতির সমাজ নির্মাণের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ উপাদান। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব বাঙালির আত্মপরিচয়ের ঠিকানা এ উৎসবগুলো। সংস্কৃতির এই শক্তিই বাঙালিকে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন বীরের জাতিতে পরিণত করেছে। আর সে কারণেই শত শত বছর ধরে বাঙালি তার স্বাধীনসত্তা বজায় রাখতে পেরেছিল এবং প্রয়োজনে বীরের মতো লড়াই করেছে কিন্তু বশ্যতা স্বীকার করেনি।
আমরা সকলে জানি যে, ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। কিন্তু শুরু থেকেই পশ্চিমা অবাঙালি পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী বাঙালিকে অবদমিত করার নানা চক্রান্ত শুরু করে। পাকিস্তানের অধিকাংশ নাগরিকের মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দু এবং ইংরেজিকে রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু বাঙালি তাদের এ অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি। ১৯৪৮ এ ১৯৫২ সালের দুই পর্বের ভাষা আন্দোলনে অনেক শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা মাতৃভাষার অধিকার অর্জন করি। আমাদের আত্মদানের সেই রক্তাক্ত দিন একুশে ফেব্রুয়ারি আজ জাতিসংঘের ইউনেসকোর স্বীকৃতি লাভ করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে।
দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে ত্রিশ লাখ মানুষের আত্মদান ও কয়েক লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা বিজয় অর্জন করি। এ কথা আমাদের সকলের জানা যে, সে সময়ে জামায়াতে ইসলামি, নিজামে ইসলামি, মুসলিম লীগ, পিডিপিসহ আমাদের দেশের কয়েকটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল স্বাধীনতার বিরোধিতা করে দখলদার বাহিনীকে সমর্থন জানায়। তারা সশস্ত্র রাজাকার, আলবদর, আল শামস বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর সঙ্গে গণহত্যা, নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটে অংশ নেয়। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পূর্বক্ষণে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের বাসা থেকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। স্বাধীন বাংলাদেশ যাতে মেধাশূন্য হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে সে লক্ষ্যেই এ হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছিল।
আমাদের জাতির অতি দুর্ভাগ্য যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এই স্বাধীনতা বিরোধী গোষ্ঠীর চক্রান্তে ক্ষমতালোভী সেনাবাহিনীর একটি গ্রুপ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করে। এ সময়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ স্বাধীনতা সংগ্রামী চার জাতীয় নেতা, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামানকে নির্মমভাবে হত্যা করে। দেশব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি বিশেষত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের হত্যা, কারাগারে নিক্ষেপ ও নির্যাতন চালিয়ে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়। ক্ষমতা দখলকারী জেনারেল জিয়া দালাল আইন বাতিল করে সব রাজাকার, আলবদরকে কারাগার থেকে মুক্ত করে দেন। যারা বিদেশে পালিয়ে গিয়েছিল তারাও পুনরায় দেশে ফিরে আসতে শুরু করে। জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা বিরোধী শাহ আজিজুর রহমানকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন এবং আরও অনেককে এ সময় মন্ত্রী বানানো হয়। স্বাধীনতার বিরোধিতা এবং গণহত্যার অভিযোগে যেসব ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এ সময় সেই সব দলকে রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধ করার জন্য কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ জারি করা হয়। সংবিধানের চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে পরিবর্তন করে পাকিস্তানি ভাবাদর্শে বাংলাদেশকে পরিচালিত করার চেষ্টা চালানো হয়। এ সময় পরিকল্পিতভাবে মুক্তিযুদ্ধের ভুল, মিথ্যা ইতিহাস তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার অপচেষ্টা চালানো হয়। স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির ক্রীড়নক সরকার দীর্ঘ একুশ বছর ক্ষমতা দখল করে মানুষকে বিভ্রান্ত করে এবং মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে রাজনৈতিক, সামাজিক ও আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। কিন্তু বাংলাদেশ আবার বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ একটি অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিবাদী, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলায় জাতি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রেখে প্রায় সম্পন্ন করা হয়েছে। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে ইতিমধ্যে ব্যাপক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। শিক্ষা, প্রযুক্তি, নারীর ক্ষমতায়ন, কর্মসংস্থান, চিকিৎসা, পরিবেশ, দারিদ্র্য বিমোচন, বিদ্যুৎ-জ্বালানি, যোগাযোগ, কৃষি, শিল্প, সামাজিক নিরাপত্তা, ক্রীড়া ও অর্থনীতির সর্বক্ষেত্রে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধন করেছে। শেখ হাসিনা সরকারের বিচক্ষণতায় বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের এক বিশাল অঞ্চল আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে মিয়ানমার ও ভারত থেকে নিজ সার্বভৌমত্বে অন্তর্ভুক্ত করেছে। ভারতের সঙ্গে দীর্ঘ ৪৫ বছরের অমীমাংসিত সীমান্ত চুক্তি ও ছিটমহল বিনিময় সম্মানজনকভাবে সম্পন্ন করেছে। প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে মানবিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা যখন বলেন ‘প্রয়োজনে আমরা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ভাত ভাগ করে খাব’ তখন এর চেয়ে মহৎ উক্তি বোধহয় আর কিছু হতে পারে না।
প্রবাসী বন্ধুদের কাছে আমার নিবেদন, আপনারা বীরের জাতির অংশ। আমাদের আছে হাজার বছরের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির ঐতিহ্য। আমরা লড়াই করে ভাষার অধিকার পেয়েছি, ত্রিশ লাখ জীবনের বিনিময়ে স্বাধীনতা এনেছি। আমরা অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, প্রগতিবাদী, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলায় অনেক অগ্রগতি সাধন করেছি। অর্থনীতির সব সূচকেই বাংলাদেশ আজ উন্নত দেশগুলোর প্রায় সমকক্ষ। আমাদের গড় আয়ের সঙ্গে গড় আয়ুও বৃদ্ধি পেয়ে ৭৩ বছরে দাঁড়িয়েছে। আপনার সন্তানদের আপনার ইতিহাসের কথা বলুন, ঐতিহ্য-সংগ্রাম, আত্মদান ও বীরত্বের কথা বলুন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং মানবিকতার কথা বলুন। দেশের প্রকৃত সত্য, অগ্রগতি, মর্যাদা ও সমৃদ্ধির কথা তাদের জানান। এর ফলে তাদের মধ্যে দেশপ্রেম বৃদ্ধি পাবে নিঃসন্দেহে।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট উত্তর আমেরিকা গত বিশ বছর ধরে বাঙালি সংস্কৃতি লালন এবং একখণ্ড বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রতিনিয়ত যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তার জন্য আমি মিথুন আহমেদসহ সংগঠনের সব কর্মকর্তা, সদস্য ও প্রবাসী বাঙালিদের রক্তিম অভিনন্দন জানাই।
জয় হোক সংস্কৃতির।
জয় হোক মানুষের।
জয় বাংলা।

লেখক: সভাপতি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, ঢাকা, বাংলাদেশ।