অভিবাসন মামলার শুনানি, আটকে যাচ্ছে সংকটে অভিবাসীরা

কেন্দ্রীয় সরকারের ‘শাট ডাউন’–এর অবসান চেয়ে নিউইয়র্ক সিটিতে ফেডারেল ভবনের সামনে প্ল্যাকার্ড হাতে বিক্ষোভকারীরা। ১৫ জানুয়ারি, ম্যানহাটন বরো, নিউইয়র্ক সিটি। ছবি: রয়টার্স
কেন্দ্রীয় সরকারের ‘শাট ডাউন’–এর অবসান চেয়ে নিউইয়র্ক সিটিতে ফেডারেল ভবনের সামনে প্ল্যাকার্ড হাতে বিক্ষোভকারীরা। ১৫ জানুয়ারি, ম্যানহাটন বরো, নিউইয়র্ক সিটি। ছবি: রয়টার্স

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কেন্দ্রীয় সরকারে শাট-ডাউন বা অচলাবস্থার কারণে হাজার হাজার অভিবাসন মামলার ভাগ্য ঝুলে পড়েছে। আগে গড়ে প্রতিদিন ৫০০ অভিবাসন ও রাজনৈতিক আশ্রয়ের মামলা নিষ্পত্তি হতো। কিন্তু অচলাবস্থার কারণে প্রায় এক মাস ধরে সেই প্রক্রিয়া বন্ধ রয়েছে। ২০ বছর ধরে আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থী ও অভিবাসন প্রত্যাশীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। বর্তমান অচলাবস্থা শুরুর আগেই অভিবাসন মামলার সংখ্যা আট লাখ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এক মাস ধরে শুনানি কার্যক্রম বন্ধ থাকায় এই সংখ্যা কেবল বেড়েই চলছে। 

অবৈধ অভিবাসন, আদম পাচার, মাদক পাচার, সন্ত্রাস, পতিতাবৃত্তি এবং অবৈধ অভিবাসনের সঙ্গে জড়িত নানা অপরাধ প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে আমেরিকা-মেক্সিকো সীমান্তে সীমানা প্রাচীর নির্মাণের জন্য নির্বাচনী প্রচারণায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি সীমানা প্রাচীর নির্মাণের ব্যয় হিসেবে ৫৭০ কোটি মার্কিন ডলার অনুমোদন দিতে কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু ডেমোক্রেটিক পার্টি নিয়ন্ত্রিত প্রতিনিধি পরিষদে এই দাবি প্রত্যাখ্যাত হয়, যার জের ধরে গত বছরের ২১ ডিসেম্বর মধ্যরাত থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের কার্যক্রম আংশিক বন্ধ রাখা হয়েছে। ট্রাম্প দাবি করেছিলেন, সরকারি কার্যক্রম পরিচালনার বিলের অংশ হিসেবে ওই অর্থ ছাড় দেওয়া হোক যা বিরোধী ডেমোক্র্যাটরা নাকচ করে দিয়েছে। ফলে প্রতিনিধি পরিষদে বিলটি আটকে গেছে।
ডেমোক্র্যাটরা অবশ্য দীর্ঘদিন যাবৎ এই দেয়াল তৈরির বিরোধিতা করে আসছে। তাদের মতে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রস্তাবিত দেয়াল অবৈধ অভিবাসন সমস্যার কার্যকরী সমাধান নয়। বরং এটি সরকারের আর্থিক অপচয়ের একটি চলমান ক্ষেত্র তৈরি করবে। অন্যদিকে, অনেকের মতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণের পাশাপাশি পুনর্নির্বাচনের পথ সুগম করতে দেয়াল নির্মাণ করতে চান।
উল্লেখ্য, ট্রাম্পের প্রস্তাবিত দেয়ালটি মেক্সিকোর সঙ্গে আমেরিকার যে ১ হাজার ৯০০ মাইলের বেশি ভূমি সীমান্ত আছে, তার পুরোটা নয়, বরং আংশিক এলাকা জুড়ে হওয়ার কথা।
অচলাবস্থার ফলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে। প্রবৃদ্ধির ওপর বিরূপ প্রভাব এখন আগের সব ধারণাকে ছাড়িয়ে গেছে। সপ্তাহব্যাপী ক্ষতির অনুমিত মাত্রা এখন দ্বিগুণ করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অর্থনৈতিক উপদেষ্টারা। সরকারে অচলাবস্থার নেতিবাচক প্রভাব কমাতে ট্রাম্প প্রশাসন ১৫ জানুয়ারি হাজার হাজার কর্মীকে বেতন ছাড়াই কাজে যোগদান করতে আহ্বান জানিয়েছে—যেসব কাজের মধ্যে আছে আয়কর দাখিল প্রক্রিয়াকরণ, ফ্লাইট নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং খাদ্য ও ওষুধ পরীক্ষা ইত্যাদি।
বন্ধ বা ব্যাহত সরকারি পরিষেবাগুলোর মধ্যে একটি বিশেষ পরিষেবা অভিবাসন আদালত। এখন এর কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ায় একটি চলমান সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। অচলাবস্থার প্রবল ঝাপটা এসে লেগেছে অভিবাসনপ্রত্যাশী সাধারণ মানুষের ওপর। কেননা সরকারি আদালতের অভিবাসন সংক্রান্ত কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। এর ফলে হাজার হাজার অভিবাসন মামলার ভাগ্য আশঙ্কা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেছে।
এক হিসেবে দেখা গেছে, গত চার সপ্তাহেরও কম সময়ে আদালত ৪৩ হাজার মামলার শুনানি বাতিল করেছে। অভিবাসন আদালতের কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার ফলে এক গভীর সংকটের দিকে ধাবিত হচ্ছে আমেরিকার বহুল আলোচিত অভিবাসন প্রক্রিয়া। এর ফলে একদিকে যেমন ন্যায্য প্রার্থীরা রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবেন, অন্যদিকে আইনগত প্রক্রিয়া মেনে অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোও কয়েক বছর পিছিয়ে যাবে।
অচলাবস্থার ফলে কর্মহীন প্রায় ৩ লাখ ৮০ হাজার সরকারি কর্মীর মধ্যে আছেন ৪০০ কেন্দ্রীয় অভিবাসন মামলার বিচারকও। আটক কেন্দ্রগুলোতে অবৈধ অভিবাসীদের মামলার শুনানি কার্যক্রম পরিচালনা করতে তারা বিশেষভাবে অনুমতিপ্রাপ্ত। অথচ এখন তারা বেতন পাচ্ছেন না, ভবিষ্যতেও পাবেন কি-না বা কখন পাবেন, তা অনিশ্চিত—যা নানাভাবে তাদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সংকট তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে প্রতিদিন বেড়ে চলা অনিষ্পন্ন অভিবাসন মামলার কাজে যোগ দিলেও তাদের ওপর প্রচণ্ড শারীরিক-মানসিক চাপ সৃষ্টি করবে।
একেকজন ফেডারেল বিচারকের হাতে গড়ে প্রায় চার হাজারের বেশি বিচারাধীন মামলা থাকে। অভিবাসন মামলার শুনানির দিন ধার্য হয় কয়েক বছর আগে থেকে। তারা গত চার সপ্তাহে যে মামলাগুলোর শুনানি বাতিল করেছেন, তার কোনো কোনোটি বিচারাধীন ছিল দুই থেকে চার বছর। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, গত চার সপ্তাহ ধরে যেসব মামলার শুনানি বাতিল হয়েছে, আগামী কয়েক বছরেও হয়তো সেসব মামলার আবার শুনানির তারিখ না-ও পেতে পারে। বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতি জানুয়ারির শেষ পর্যন্ত এভাবে চলতে থাকলে ১ লাখ অভিবাসন মামলার ভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। সংকটে পড়বে এর সঙ্গে জড়িত অসংখ্য মানুষের জীবন।