কালোদের সাহিত্য ও রাজনীতি

>ফেব্রুয়ারিকে আমেরিকায় ‘ব্ল্যাক হিস্ট্রি মান্থ’ হিসেবে স্মরণ করা হয়। এই মাসে শিল্প সাহিত্য সংগীতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কালোদের অবদান ও কৃতিত্বকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। ড. কার্টার জি উডম্যান নিগ্রো দাসের সন্তান। ছাত্রাবস্থায় লক্ষ্য করেন, স্কুল–কলেজের পাঠ্য বইয়ে কালোদের অবদানকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। তাই তিনি ১৯২৬ সালে ‘নিগ্রো হিস্ট্রি উইক’ নামের আড়ালে আন্দোলন শুরু করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল মানবজীবনের বিভিন্ন শাখায় কালোদের অবদানকে সবার সামনে তুলে ধরা।
‘নিগ্রো হিস্ট্রি উইক’ পালন করা হতো ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে। কারণ আব্রাহাম লিংকন ও ফ্রেড্রিক ডগলাসের (নিগ্রোদের অবস্থার ক্রমোন্নতির জন্য এঁদের উল্লেখযোগ্য অবদানকে সম্মান জানাতে) জন্মদিন এই সপ্তাহে। প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড ১৯৭৬ সালে নিগ্রো হিস্ট্রি উইককে ‘ব্ল্যাক হিস্ট্রি মান্থ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেন। বর্তমানে স্কুল কলেজ অফিস আদালতে অত্যন্ত মর্যাদার সঙ্গে ‘ব্ল্যাক হিস্ট্রি মান্থ’ রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হয়। কালোদের সাহিত্য ও রাজনীতির নমুনা হিসেবে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আজকের এই আয়োজন। মার্টিন লুথার কিংয়ের ঐতিহাসিক বক্তৃতা এবং দুই কৃষ্ণাঙ্গ কবির কবিতা অনুবাদ করেছেন শামস আল মমীন

আমি স্বপ্ন দেখি

মার্টিন লুথার কিং
জুনিয়র মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র ১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট ওয়াশিংটন ডিসিতে দুই লাখের বেশি নিগ্রো ও শ্বেতাঙ্গের উপস্থিতিতে আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম (I Have a Dream) শিরোনামে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। শোষিতের এই মহান নেতা ১৯২৯ সালের ১৫ জানুয়ারি আমেরিকার জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যে জন্মগ্রহণ করেন। মা ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা। বাবা অত্যন্ত মেধাবী ব্যাপটিস্ট মিনিস্টার মার্টিন লুথার ১৯৫৫ সলে সিস্টেমেটিক থিওলোজিতে (Systematic Theology) পিএইচডি করেন। তিনি ১৯৫৪-১৯৬০ পর্যন্ত্ম অ্যালবামার ব্যাপটিস্ট চার্চ প্যাসটর (Baptist Church Pastor) হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬৩ সালে টাইম সাময়িকী তাঁকে ম্যান অব দ্য ইয়ার বা বর্ষসেরা ব্যক্তিত্ব নির্বাচিত করে। পরের বছর তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার পান এবং এই ধারায় তিনি সর্বকনিষ্ঠ। ১৯৬৮ সালের ৪ এপ্রিল টেনেসির হোটেল লবিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান। ১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট ওয়াশিংটনে দেওয়া তাঁর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল।
স্বাধীনতার জন্য আজকের এই সমাবেশ জাতির ইতিহাসে অম্লান হয়ে থাকবে। আমি আপনাদের সঙ্গে থাকতে পেরে আনন্দিত।
এক শ বছর আগে এক মহান আমেরিকান স্বাধীনতার ঘোষণা সনদে স্বাক্ষর করেছিলেন যাঁর প্রতীকী ছায়ায় আমরা আজও দাঁড়িয়ে। এই অমূল্য সনদ অন্যায় নির্যাতনে পোড় খাওয়া লাখ লাখ নিগ্রো দাসের মনে আশা জ্বেলেছিল এবং বন্দিত্বের দীর্ঘ অন্ধকার শেষে আনন্দ দিনের স্বপ্ন এনেছিল।
কিন্তু আজ এক শ বছর পরও নিগ্রোরা মুক্ত নয়; এক শ বছর পর নিগ্রো জীবন বিভেদ–বৈষম্যের শেকল পায়ে শোকের ছায়ায় বন্দী; এক শ বছর পর সম্পদ সমুদ্রের মাঝেও নিগ্রোরা দারিদ্র্যের নিঃসঙ্গ দ্বীপে দাঁড়িয়ে; এক শ বছর পর নিগ্রোরা আজও সমাজে নির্জীব, নিজ দেশে পরবাসী।
আজ আমরা এখানে এসেছি এই ভয়াবহ অবস্থার কথা বলতে। বলা যায়, রাজধানী শহরে আমরা এসেছি আমাদের পাওনা বুঝে নিতে। যখন স্থপতিরা দেশের শাসনতন্ত্রে ও স্বাধীনতার ঘোষণা সনদের মন ভোলানো কথায় সায় দেন তখন তাঁরা প্রত্যেক নাগরিককে তার ন্যায্য পাওনা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। কথা ছিল, সব নাগরিক অর্থাৎ নিগ্রো ও শ্বেতাঙ্গরা স্বাধীনতা, সুখ ও জীবনের অবিচ্ছেদ্য অধিকারের নিশ্চয়তা পাবে।
দেশ তার পবিত্র অঙ্গীকার পালনে ব্যর্থ হয়েছে। আজ নিশ্চিত বলতে পারি, নিগ্রোরা তাদের পাওনা থেকে বঞ্চিত। জাতি তাদের শূন্য হাতে ফিরিয়ে দিয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি না, অফুরন্ত সম্ভাবনার এই দেশে সম্পদের কমতি আছে। আর তাই আমরা এসেছি পাওনা নিতে যা অন্য সবার মতো আমাদেরও দেবে মুক্তি ও ন্যায়ের নিশ্চয়তা।
আমরা জাতিকে বর্তমান অসন্তোষের তীব্রতাকে স্মরণ করিয়ে দিতে এই পবিত্র স্থানে এসেছি। ভালো মানুষ সেজে অলস বসে থাকার সময় আর নেই। গণতন্ত্রের অঙ্গীকারকে সত্যে পরিণত করার এখনই সময়; বিভেদের অন্ধকার ও হতাশার উপত্যকা পেরিয়ে সাম্প্রদায়িক প্রীতির উজ্জ্বল পথে যাওয়ার এখনই সময়; এই দেশকে বর্ণ বৈষম্যের চোরাবালি থেকে গাঢ় ভ্রাতৃবন্ধনে পৌঁছে দেওয়ার এখনই সময়; সব মানব সন্তানের জন্য সত্য প্রতিষ্ঠা করার এখনই সময়। এবং এই প্রয়োজনকে উপেক্ষা করা জাতির জন্য হবে ভয়ংকর। সাম্য ও মুক্তির হৈমন্তী হাওয়া আমাদের ছোঁবে না যত দিন না নিগ্রো অসন্তোষের খরতাপ প্রশমিত হয়।
১৯৬৩ সালেই শেষ নয়, বরং শুরু। যারা মনে করেন নিগ্রোদের আত্মপ্রত্যয়ে ফুঁসে ওঠা দরকার তারা জেনে খুশি হবেন, এই জাতি যদি বর্তমান মনোভাব না বদলায় তবে আমরা প্রচণ্ড বিক্ষোভে জেগে উঠব। নিগ্রোদের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত আমরা আর চুপ থাকব না। যত দিন ন্যায়ের সূচনা না হয়, তত দিন প্রতিবাদের ঘূর্ণিপাক জাতির মর্মমূলে নাড়া দিতেই থাকবে।
এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর উষ্ণ সিঁড়িতে যারা দাঁড়িয়ে তাদের জানা দরকার, আমাদের পাওনা আদায়ের পথে আমরা যেন ভুল কর্মে জড়িয়ে না পড়ি।
হানাহানি আর ঘৃণায় যেন আমাদের মুক্তি চেতনা লক্ষ্যভ্রষ্ট না হয়। শৃঙ্খলা আর মর্যাদাবোধ আমাদের সংগ্রামের মূলমন্ত্র। এই সৃজনশীল সংগ্রামকে আমরা যেন পেশির দাঙ্গায় পরিণত না করি। নিগ্রোদের এই ঈর্ষণীয় কৌশলে শ্বেতাঙ্গরা যেন আমাদের প্রতি আস্থা না হারায় সে জন্য বাহুবলকে আত্মার শুদ্ধিতে পরিণত করতে হবে। এই সমাবেশে শ্বেতাঙ্গদের উপস্থিতি প্রমাণ করে তাদের ভাগ্য আমাদের ভাগ্যের সঙ্গে বন্দী। তারা বুঝতে পেরেছে, তাদের মুক্তিও অবিচ্ছেদ্যভাবে আমাদের মুক্তির সঙ্গে নিয়ন্ত্রিত। আমরা সঙ্গীহীন চলতে পারব না। পেছনে ফেরার সময় আর নাই। আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক এগিয়ে চলার।
যাঁরা আমাদের প্রশ্ন করেন, ‘কবে তোমরা শান্ত হবে?’ যত দিন নিগ্রোরা অকথ্য বিভীষিকাময় পুলিশি নির্যাতনের শিকার হবে, তত দিন আমরা শান্ত হতে পারি না; ভ্রমণের ক্লান্তি নিয়ে আমরা যত দিন শহরের হোটেলে এবং মোটেলে জায়গা পেতে অক্ষম, তত দিন আমরা শান্ত হতে পারি না; যত দিন নিগ্রো জীবন ক্ষুদ্র বস্তি থেকে বৃহৎ বস্তিতে সীমাবদ্ধ, তত দিন আমরা শান্ত হতে পারি না; ‘শুধু সাদাদের জন্য’ এই কলঙ্কিত শব্দগুচ্ছ দিয়ে যত দিন আমাদের সন্তানদের আত্মমর্যাদা ক্ষুণ্ন এবং নিগৃহীত করা হবে তত দিন আমরা শান্ত হতে পারি না; যত দিন মিসিসিপির নিগ্রোরা ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত এবং নিউইয়র্কের নিগ্রোরা ভোট দিতে উদাসীন তত দিন আমরা শান্ত হতে পারি না। না! না, আমরা শান্ত নই, আমরা শান্ত থাকতে পারি না যত দিন না ‘সত্য পানির মতো বহতা আর ন্যায়নিষ্ঠা ঝরনার মতো গতিময়’।
আমি ভুলে যাইনি, আপনাদের কেউ কেউ উৎসুক চোখ আর যন্ত্রণার জিরাত বুকে এখানে এসেছেন। আপনাদের কেউ কেউ অন্ধকার জেল কোঠা থেকে সদ্য বেরিয়ে এসেছেন। আবার কেউ এমন এলাকা থেকে এসেছেন, যেখানে উপর্যুপরি অত্যাচার আর পুলিশি নির্যাতন আপনাদের মেরুদণ্ড কমজোর করে দিয়েছে এবং আপনারা পুড়ে পড়ে সোনা হয়ে উঠেছেন। বুকে বল নিয়ে কাজ করে যান, জয় আমাদের সুনিশ্চিত, ফিরে যান মিসিসিপিতে। ফিরে যান অ্যালাবামাতে। ফিরে যান সাউথ ক্যারোলিনাতে। ফিরে যান জর্জিয়াতে। ফিরে যান লুইজিয়ানাতে। ফিরে যান উত্তরাঞ্চল শহরের নোংরা বস্তি আর এলাকায়, মনে রাখবেন এই দুর্দশার অবসান হবে, নিশ্চয়ই হবে। হতাশার খাদে আমরা যেন বিচলিত না হই।
আজ আমি বলি বন্ধুগণ, আমাদের ভবিষ্যৎ যদিও হতাশায় নিমগ্ন, তবু আমি স্বপ্ন দেখি। এই স্বপ্ন আমাদের সত্তার উৎস থেকে উঠে আসা স্বপ্ন। আমার স্বপ্ন প্রকৃত সত্যের মূলে এই জাতি একদিন সোজা হয়ে দাঁড়াবে: ‘আমরা এই সত্যকে স্বতঃসিদ্ধ জানি, স্রষ্টার সৃষ্টি সবাই সমান।’ আমি স্বপ্ন দেখি, একদিন জর্জিয়ার লাল পাহাড়ি এলাকায় সাবেক ক্রীতদাসের সন্তান এবং সাবেক মনিবের সন্তান ভ্রাতৃসংঘে মিলিত হবে। আমি স্বপ্ন দেখি, অন্যায় আর নিপীড়নে জর্জরিত মিসিসিপি রাজ্য একদিন ন্যায় আর মানবিক উচ্চারণের তীর্থস্থান হবে। আমি স্বপ্ন দেখি, এমন দেশের যেখানে আমার চার সন্তান একদিন বড় হবে নিগৃহীত বর্ণের পরিচয়ে নয়, তাদের সত্তার বৈশিষ্ট্যে।
আজ আমি স্বপ্ন দেখি!
আমি স্বপ্ন দেখি, একদিন জাতি বৈষম্য কলুষিত অ্যালাবামা এবং এর গভর্নর কণ্ঠে মিলনের সুর তুলে আমাদের পাশে এসে দাঁড়াবে এবং সেখানে ছোট ছোট নিগ্রো বালক–বালিকা, ছোট ছোট শ্বেতাঙ্গ বালক–বালিকার হাতে হাত রেখে আত্মার বন্ধনে মিলিত হবে।
আজ আমি স্বপ্ন দেখি!
আমি স্বপ্ন দেখি, ‘একদিন প্রত্যেক পাহাড় পর্বত অবনত হয়ে উপত্যকায় মিশে যাবে। পিচ্ছিল আর উঁচু–নিচু পথগুলো সরল মসৃণ হবে এবং ঈশ্বরের মহত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। পুরো মানবজাতি তার সাক্ষী হয়ে থাকবে।’ এই আশা আর বিশ্বাস নিয়ে আমি ফিরে যেতে চাই দক্ষিণে। এই সত্যকে বুকে রেখে হতাশা গ্লানি নিয়ে আমরা প্রত্যাশার স্তম্ভ গড়ে তুলতে সক্ষম হব, আমরা ঝগড়ার ঝনঝনানিকে ভ্রাতৃত্বের সুললিত ঐকতানে পরিণত করতে সক্ষম হব। আমার বিশ্বাস, আমরা একসঙ্গে চলতে পারব, একসঙ্গে ইবাদত করতে পারব, একসঙ্গে সংগ্রাম করতে পারব, একসঙ্গে জেলে যেতে পারব, আমাদের মুক্তির জন্য একসঙ্গে রুখে দাঁড়াব এই আশায়, একদিন আমরা স্বাধীন হব। সেদিন আর দূরে নয়, যেদিন পুরো মানবসন্তান নতুন করে গাইবে: ‘মুক্ত তুমি স্বদেশ আমার প্রিয় জন্মভূমি, আমি তোমারই গান গাই। তোমার কোলে ঘুমে আছে আমার পিতা, তীর্থযাত্রীদের অহংকার তুমি, প্রত্যেক পর্বত থেকে আওয়াজ উঠুক, জয় হে স্বাধীনতা।’ আমেরিকা যদি মহান জাতির গৌরব চায়, তবে এই সত্য-সত্য হতেই হবে।
স্বাধীনতার জয়ধ্বনি হোক নিউ হ্যাম্পশায়ারের পাহাড় চূড়া থেকে; স্বাধীনতার জয়ধ্বনি হোক নিউইয়র্কের উদ্ধত পর্বত থেকে; স্বাধীনতার জয়ধ্বনি হোক পেনসিলভানিয়ার অ্যালেগেনি শিখর থেকে; স্বাধীনতার জয়ধ্বনি হোক কলোরাডোর তুষার ঢাকা শিলাস্তুপ থেকে; স্বাধীনতার জয়ধ্বনি হোক ক্যালিফোর্নিয়ার আঁকাবাঁকা ঢালু পথ থেকে; শুধু তাই নয়, স্বাধীনতার জয়ধ্বনি হোক জর্জিয়ার শিলা পাহাড়র থেকে; স্বাধীনতার জয়ধ্বনি হোক টেনেসির প্রহরী পর্বত থেকে; স্বাধীনতার জয়ধ্বনি হোক প্রত্যেক পাহাড়, টিলাখল এবং পাহাড়তলী থেকে।
যেদিন স্বাধীনতা আমাদের হবে, প্রত্যেক মহল্লা ও নিভৃত গ্রাম থেকে আমরা তার ঘোষণা শুনতে পাব। শুনতে পাব প্রত্যেক শহর ও রাজ্য থেকে। তখনই আমরা সেদিনকে কাছে পাব যখন পুরো মানবজাতির নিগ্রো ও শ্বেতাঙ্গ ইহুদি এবং প্যাগান, প্রোটেস্ট্যান্ট এবং ক্যাথলিক, নিগ্রো আত্মার সঙ্গে এক হয়ে ঘোষণা করবে, ‘মুক্ত অবশেষে, মুক্ত অবশেষে, হে সর্বশক্তিমান, আমরা মুক্ত অবশেষে।’

আমেরিকান কারাগারে পুনর্বাসন ও চিকিৎসা

এথরিজ নাইট

কবি অ্যাথরিজ নাইটের জন্ম: ১৯৩১, মৃত্যু: ১৯৯১ মিসিসিপির অজ গ্রামে। তিনি কোরীয় যুদ্ধে মেডিক্যাল টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করার সময় মারাত্মকভাবে আহত হন। পরে সশস্ত্র ডাকাতির দায়ে ছয় বছর কারাভোগ করেন। তিনি লেখেন, ‘আমি কোরিয়াতে বুলেটের জখমে মারা যাই এবং ড্রাগ আমাকে পুনর্জীবিত করে। আমি মারা যাই ১৯৬০ সালে, কারাদণ্ড ও কবিতা আমাকে নতুন জীবন দেয়। কবিতায় উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য তিনি ১৯৮৫ সালে শেলি মেমোরিয়াল পুরস্কার পান। আর ’৮৬ সালে ‘আমেরিকান বুক অ্যাওয়ার্ড অব দ্য বিফোর এশেনিশয়াল এথরিজ নাইট’ (American Book Award of the Before Essential Ethridge Knight) বইয়ের জন্য তিনি ১৯৮৭ সালে ‘আমেরিকান বুক অ্যাওয়ার্ড অব দ্য বিফোর কলম্বাস ফাউন্ডেশন (American Book Award of the Before Columbus Foundation)’ সম্মানে ভূষিত হন।

কয়েদি তার ব্যক্তিগত সমস্যার পরামর্শ ও সাহায্যের জন্য
ধীরে সুস্থে কারাগার প্রশাসন ভবনে যায়। প্রধান
দরোজার ভেতরে ছোট ছোট দরজায় পরিচিতি
ডাক্তার, উকিল, মাস্টার, থেরাপিস্ট, পরামর্শদাতা ইত্যাদি।
সে ঠিক দরোজা দিয়ে ঢোকে, এবং আরও দুটি
দরোজার মুখোমুখি হয় সেবা ও রক্ষণাবেক্ষণ। সে
বেছে নেয় সেবা, ভেতরে ঢোকে এবং আরও দুটি দরোজার
মুখোমুখি দাঁড়ায় নতুন ও পুরোনো কয়েদি
এবারও সে ঠিক দরোজা দিয়ে ঢোকে এবং আরও দুটি
দরোজার মুখোমুখি হয় কিশোর ও প্রাপ্তবয়স্ক।
সে প্রাপ্তবয়স্ক, তাই প্রাপ্তবয়স্ক দরোজা ঠেলে ভেতরে
ঢোকে এবং ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান দরোজায় গিয়ে ঠেকে।
সে ডেমোক্র্যাট, তাই ডেমোক্র্যাট দরোজা ঠেলে
ভেতরে ঢোকে এবং আরও দুটি দরোজায় সামনে দাঁড়ায়
সাদা ও কালো। সে কালো, তাই তড়িঘড়ি দৌড়ে
ওই দরোজার ভেতরে ঢোকে এবং নয়তলা থেকে ছিটকে
পড়ে রাস্তায়।

একদিন জেল কর্মকর্তা হাসতে হাসতে বললেন,
‘এই এথরিজ, সাদাদের মতো নিগ্রোরা পালায়
না কেন?’ চোয়াল
নিচু করে কিছুক্ষণ মাথা চুলকাই, তারপর
হাসতে হাসতে বলি, বলা মুশকিল
তবে মনে হয়
আমাদের পালিয়ে কোথাও যাওয়ার
নেই বলে।

সেই তরুণ শ্বেতাঙ্গের জন্য কবিতা, যে ভাবে-কী করে
আমি, বুদ্ধিমান, শিক্ষিত হয়েও জাতিবিদ্বেষে বিশ্বাস করি

লোরনা দে সেরভান্তস
জন্ম: ১৯৫৪ সালে সানফ্রান্সিস্কো শহরে। সমকালীন মার্কিন কবিতায় তাঁর স্থান অত্যন্ত উঁচুতে। কবিতার পাশাপাশি বহু সমাজ কল্যাণ সংগঠনের কাজে যুক্ত। কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন।

এই দেশে বিভেদের চিহ্ন নেই।
কাঁটাতারে ঘেরা নির্যাতনের কৌশলে
ফাটল ধরেছে বহু আগে। জয় কিংবা পরাজয়, যাই হোক,
এই উর্বর ভূমিতে গাড়ির চাকার সূক্ষ্ম রেখা ছাড়া
বিগত যুদ্ধের অন্য কোনো স্মৃতি নেই।

এই দেশে প্রেমের কবিতা লেখা হয়
এগুলো শিশুর প্রগল্ভ ছাড়া কিছু নয়।
সবাই রাশান গল্প পড়ে, আর কাঁদে
যার কোনো নিয়ন্ত্রিত সীমারেখা নেই। মানুষের
বানানো দুর্ভিক্ষ, ক্ষুধা কিংবা লোভ নেই।

আমাকে বিপ্লবী বলা ঠিক নয়। আমি
সামান্য রাজনীতির কবিতাও পছন্দ করি না।

আমি বর্ণবৈষম্যে বিশ্বাসী
তুমি কী এমন কিছু ভাবো? আমি এই অপবাদ
প্রত্যাখ্যান করি।
আমি ভুলে যেতে পারতাম যদি নিজ দেশে,
নিজ ঘরে অন্যদের মতো যা-খুশি গাইতে পারতাম। কিন্তু
আমার অবস্থা সেরকম নয়।

সব দেখেশুনে আমি নিজেও এখন
বিপ্লবে বিশ্বাস করি
কারণ ক্রোধের আগুন জ্বলছে সর্বত্র। অব্যর্থ
শিকারিরা চারিদিক থেকে ঘিরে আছে আমাদের।
এমনকি গোপনে বন্দুক তাক করা আছে স্কুলে স্কুলে।
(তুমি হয়তো এসব বিশ্বাস কর না
তুমি মনে কর এসব বানানো গল্প। কারণ ওই
বন্দুকে তোমার ভয়ের কারণ নেই।)
আমি পরিচিত আমার নিগৃহীত বর্ণে।
ওদের বন্দুক তাক করা আমার সন্তানদের দিকে
আস্তে আস্তে মৃত্যু খাদে ঠেলে দেওয়াই হত্যাকারীর ধর্ম।
এবং এটাই সত্য। এই দ্যাখো,
আমার দেহের ক্ষত, পোড়া মন আর

কথায় কথায় ‘এক্সকিউজ মি’ বলা জিহ্বা
ভর্ৎসনা এবং তাচ্ছিল্য মনে পুষে রেখে ভাবো
এরা কোনো কাজেরই যোগ্য না।

এই সবগুলোর ক্ষমতা যুক্তিতর্কের চেয়েও
অনেক অনেক ভয়ংকর। বর্ণবিদ্বেষ প্রকৃত
মেধার প্রতিফলন হতে পারে না। আমার ক্ষতগুলো শত
কারণ দিয়েও আমি মুছে দিতে
পারি না। আমার চারদিকে শত্রুরা ঘৃণায় থুতু-থুতু ফেলে।

আমি কবি
মানব বন্ধন আর সুরেলা ধ্বনির সমন্বয় চাই
দিকে দিকে। আমি হাল ধরে থাকি, নিজ
গ্রামে ফিরে যাই। সুবচন আর লোহার দারোজা
ভেঙে তেড়ে আসে চাবুকের শব্দ,
প্রিয়হারা আর্তনাদ। মুছে যাওয়া স্মৃতি
কষে চড় মারে আমার নরম গালে।

বারবার হুঁশিয়ার করে দেয়
এ দেশ তোমার নয়
অথচ এটাই আমার স্বদেশ। আমি
জাতিবিদ্বেষে বিশ্বাস করি না অথচ
এই দেশে তারই প্রতিযোগিতা চলছে।