শমশেরনগরে ইপিআরে বিদ্রোহ

শমশেরনগরের তৎকালিন বিমানবন্দর এখন বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর আঞ্চলিক ঘাটি
শমশেরনগরের তৎকালিন বিমানবন্দর এখন বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর আঞ্চলিক ঘাটি

সিপাই বাতেন খুবই যত্ন করে আমার বিছানাটা বানিয়ে দিয়েছিল। বুট আর বেল্টটা শুধু খুলে রেখে ইউনিফরম পরেই বিছানায় একটু গা এলিয়ে দিলাম। দূরে এখনো কুকুরগুলো সমানভাবে করুন সুরে কেঁদেই যাচ্ছে। আমার মা বলতেন, কুকুরের কান্না নাকি দেশে অমঙ্গল ডেকে আনে। অনেক আবোলতাবোল ভাবনা পেয়ে বসল। ঘুম আর আসল না। কেন জানি বারবার ভাবতে লাগলাম, আমি যদি আইএস ডিউটির ইন চার্জ হয়ে থাকি তাহলে উইং কমান্ডার কেন বারবার বলল, এখানে উইং টুআইসি ক্যাপ্টেন গোলাম রসুল আসবে আমার সঙ্গে দেখা করতে? জিনিসটা মনে আগের রাত থেকেই বারবার খোঁচা দিতে লাগল।
আসল ঘটনাটা কি? একটা সিগারেট ধরিয়ে আবার খালি পায়েই পায়চারি করতে লাগলাম। বেশ কেমন যেন এক ধরনের অস্বস্তি আমাকে অস্থির করে তুলল। সুবেদার মান্নান ও বি আর চৌধুরী দুজনেই কেমন যেন আতঙ্কিত। পাকিস্তানিরা যেকোনো সময় একটা অঘটন যে ঘটাবে, সেটা টের পেতে বেশি বেগ পেতে হল না। কিন্তু কী ধরনের অঘটন, সেটাই ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
চোখে কেমন জানি ঘুম ঘুম লাগল। পায়চারি বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম বুঝতেই পারিনি। সিপাই গোলাম রসুলের ডাকে সহসা ঘুম ভেঙে গেল। সকাল সাড়ে ৫টা ওয়্যারলেসে কোনো স্টেশনকে পাওয়া যাচ্ছে না। সব কল সাইন নিস্তব্ধ হঠাৎ করে। উঠে এসে অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও-ফুলতলা কোম্পানি, লাতু কোম্পানি, তামাবিল কোম্পানি এমনকি তেলিয়াপাড়া কোম্পানিকেও পাওয়া গেল না। পূর্ব পাকিস্তানের আমলে ইপিআরই একমাত্র বাহিনী ছিল যাদের ওয়্যারলেস সেট দিয়ে সব সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের দূরবর্তী বিওপি সাজেক থেকে সেই সুদূরে অবস্থিত রাজশাহীর প্রেমতলি বা গোদাগাড়ী বিওপিতে যোগাযোগ করা যেত। কোনো ধরনের ঘোষণা না দিয়ে এভাবে সিগনাল সেট বন্ধ হয়ে যাওয়াটা খুব সহজে মেনে নিতে পারছিলাম না।
গোলাম রসুলকে সেটের পাশেই বসে থাকতে বললাম। বলেই স্যুটকেস থেকে আমার সেই এনইসি চার ব্যাটারি পাঁচ ব্যান্ডের রেডিওটা বের করলাম। ভাবলাম, সকাল সাতটায় বিবিসি ইন্ডিয়া অথবা শিলং কি বিদেশ বিভাগ রেডিওর খবর শোনা দরকার। ইতিমধ্যে সবাই সজাগ এবং পিটির জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করছিল। দেখলাম জমাদার সাফিন গুল, হাভিলদার তাজ মোহাম্মাদ, সিপাই সরফরাজ আতা খান ও অন্যান্য বাঙালি এবং পাঞ্জাবি, পাঠান ও বালুচরাও পিটির জন্য তৈরি। জমাদার সাফিনকে সালাম দিয়ে কাছে নিয়ে এসে বললাম, আজ পিটি–প্যারেডের দরকার নাই। শমশেরনগরের ওই মনু ভ্যালিতে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি পাওয়া বেশ কষ্টকর। অনেক কষ্টে বিবিসি রেডিওতে টিউন করতে পারলাম। মার্ক টালি বিবিসির খবর পরিবেশন করলেন। তারপর শুনলাম আকাশবাণীর দেব দুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিউজ।
দুই সংবাদেই আভাস পেলাম, ঢাকায় কিছু একটা হয়েছে। মার্ক টালি বললেন, ঢাকা শহরে অনেক গোলাগুলির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। অনেক এলাকায় আগুনের শিখাও দেখা গেছে। দিল্লিতে বসে রাস্তায় ট্যাংক ও ভারী অস্ত্রসজ্জিত সৈন্য ভর্তি লরি চলাচলেরও সংবাদ নাকি ওরা পেয়েছে। কেন জানি মনটা বারবার বলল, ক্যাপ্টেন গোলাম রসুল হয়তো আসবে আমার কোম্পানিকে নিরস্ত্র করতে। নিরস্ত্র করে আমাদের সবাইকে গ্রেপ্তার করে তার সঙ্গে করে সিলেটে নিয়ে যাবে। না হলে কেন সে শুধু আমার কোম্পানিকেই দেখতে আসবে? কারণ আমার কোম্পানিই একমাত্র এক জায়গায়। বাকি বাঙালি কোম্পানি কমান্ডার দেড় কোম্পানিতো ছড়ানো ছিটানো ১০-১২টা বিওপিতে মিলে। যা ভাবা তাই কাজ। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, ওই বেটা শয়তান ক্যাপ্টেনকে বিমানবন্দরের ভেতর ঢুকতেই দেব না। শমশেরনগর বাজারেই ওর গাড়ির বহরে অতর্কিত হামলা করব। বিছানা থেকে উঠে ওয়্যারলেস সেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলাম বেশ কিছুক্ষণ। তারপর সুইচ অন করে আমার কল সাইন দিয়ে ডাকলাম। যদি কেউ উত্তর দেয়–এই ভেবে। ঢাকা কিংবা সিলেট কিংবা চিটাগং কেউই কোনো উত্তর দিল না। রাত ততক্ষণে সাড়ে তিনটা। মনটা খুব ছটফট করতে লাগল। বাম চোখের পাতাটা আচমকা বেশ লাফাতে লাগল। একটু জানি কেমন ভয় ভয় লাগতে লাগল। নিজের অজান্তেই একটু শিউরে উঠলাম।
মনে পড়ল সেই কলকাতার দিনগুলো। আমাদের পরিচিত পূর্ববঙ্গের মুসলমান পরিবারগুলো সব ত্যাগ করে হলেও পাকিস্তান বানানোর প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেছিলাম। কিন্তু আমার বাবা সব সময় বলতেন, প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের সময় তিনি ওই সব পাঞ্জাবির ব্যবহার দেখেছেন। মেসোপটেমিয়া যাওয়ার আগে জাহাজ করাচি বন্দরে ছিল কয়েক দিন। ওখান থেকে এক দল পাঞ্জাবি সৈন্য উঠেছিল জাহাজে এবং তখন থেকেই বাবা ওদেরকে খুব একটা পছন্দ করতেন না। অবিভক্ত কংগ্রেসের নেতা ছিলেন আমাদের গ্রামের মধু চৌধুরী। তাঁর সাহচর্যে এসে বাবাও সব সময় দেশ বিভাগে পাঞ্জাবিদের সঙ্গে যাওয়ার ঘোর বিরোধী ছিলেন।
এসব আবোলতাবোল ভাবতে ভাবতে চোখ কখন যে একটু বুজে এল, তা উপলব্ধি করতে পারলাম না। বাতেনের মৃদু ডাকে ঘুম ভাঙল।। বলল, স্যার মেজরজি (হাভিলদার মেজর) দেখা করবে অর্ডার নেওয়ার জন্য। বললাম, আসতে বল। হাবিলদার ফরহাদ আমার অত্যন্ত বিশ্বস্ত লোক। কানে কানে বলল, স্যার সর্বনাশ (ছাতিয়ানাস) হয়ে গেছে। উত্তরে বললাম, কি হয়েছে খুলে বলো। বলল, স্যার পাঞ্জাবিরা পশ্চিম পাকিস্তানের রেডিওতে শুনছে যে, বাঙালি বিদ্রোহ বন্ধ করার জন্য টিক্কা খানের নির্দেশে সারা দেশে মার্শাল ল’ জারি করেছে এবং পুরা দেশে কারফিউ জারি করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। ঢাকায় কারফিউ জারি ও রাস্তায় রাস্তায় ট্যাংক মোতায়েন করা হয়েছে। বাঙালিদের এবার চিরতরে ঠান্ডা করেই ছাড়বে পশ্চিমারা। বললাম, কোনো কথা নাই। আর এখনই সব পশ্চিম পাকিস্তানিকে ক্লোজ অ্যারেস্ট করতে। আর সবার কাছে থেকে ওদের ট্রাঙ্ক এবং সব জিনিস বাজেয়াপ্ত কর। এখন থেকে ওরা বন্দী, বেল্ট খুলে নাও। আমি আসছি দুই মিনিটের মধ্যে।
তাড়াতাড়ি পোশাক পরে, বেল্ট লাগিয়ে বুটের ফিতা লাগিয়ে নিচে নেমে এসে দেখি, আমার সব সৈনিক ওদের ১৩ জনকে রাইফেল তাক করে ঘিরে রেখেছে। ফরহাদ ওদের বেল্ট খুলে বিছানা বাঁধার দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলছে। শাফিন গুল জমাদার শাফিন গুল আমাকে দেখে চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘সাব ইয়ে কেয়া হো রাহা হ্যাঁ হামক সাথ। হামলগ তো আপনা আদমি হ্যাঁই না জি’। উত্তরে বললাম গুল সাব, ‘আপ লোগনে বাঙালি কো বহুত বেশতি কড়া হুয়া, আভি ইয়েহ বাঙালকে বাঙালিও মউকা আয়া ও বেস্তি কা জবাব দেনে ক্যা।’
দাঁড়িয়ে থেকে আদেশ দিলাম, এদের জন্য মেকশিফট কোয়ার্টার গার্ড বানানোর জন্য। বলেই বাকিদের ফল ইন হতে বললাম বারান্দায় জলদি জলদি। সবাই সঙ্গে সঙ্গে ফল ইন হয়ে গেল। ইতিমধ্যে গোলাম রসুল এসে বলল, পিলখানা এবং রাজারবাগে ব্যাপক হত্যা করা হয়েছে। বিবিসি রেডিওর খবরে এই মাত্র জানানো হয়েছে। বললাম, সেটে যদি পারে তো কাউকে মেলানোর জন্য। সবাই ফল ইনে দাঁড়ানো। সামনে এসে প্যারেড নিয়েই বললাম, ‘পরিস্থিতি খুবই খারাপ মনে হচ্ছে। ঢাকা ওদের কবজায়। অনেক অনেক খুন হত্যা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। আমরা এভাবে নীরব থাকতে পারি না। পাঞ্জাবি আর পাঠানদের ক্লোজ অ্যারেস্ট করা মানে হলো আমরা পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ফেলেছি। কে কে আছ আমার সঙ্গে? যদি কেউ না থাকতে চাও, তাহলে এক কদম আগে বাড়ো। আজ থেকে আমরা ভাগোওয়াট সৈন্য হয়ে গেলাম।’
সবাই এক সঙ্গে বলল, ‘স্যার আমরা সবাই আছি আপনার সঙ্গে-আদেশ করেন কি করতে হবে।’
(মেজর ফজলুল হক চৌধুরীর একাত্তরের ডায়েরি অবলম্বনে)