প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপ ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা

সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য চাই গতিশীল ও দক্ষ প্রশাসন। উন্নত প্রশিক্ষণ ছাড়া দক্ষ প্রশাসন অসম্ভব। জনপ্রশাসনে দক্ষতা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পের আওতায় সরকার চলতি বছর থেকে উচ্চতর শিক্ষায় ‘প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপ’ চালু করেছেন, যা নিঃসন্দেহ প্রশংসার দাবিদার। প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপে মাস্টার্সের জন্য ৬০ লাখ ও পিএইচডির জন্য ২ কোটি টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই ফেলোশিপ কাদের, কীভাবে ও কোথায় অধ্যয়নের জন্য দেওয়া হবে, সে বিষয় কিছু জিজ্ঞাসা থেকে যায়। কারণ জনগণের অর্থের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করা সরকারের দায়িত্ব। তা ছাড়া, বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা সরকারের অঙ্গীকার। কিন্তু, এ ফেলোশিপের পরতে পরতে রয়েছে বৈষম্য, অথচ বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধু আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন।
চলুন, দেখা যাক বৈষম্য কোথায়? কাদের জন্য এই ফেলোশিপ? বিসিএস কর্মকর্তাদের জন্য ৭০ ভাগ, অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তার জন্য ২০ ভাগ ও সর্বসাধারণের জন্য ১০ ভাগ। ফেলোশিপ কেবল যদি প্রশাসনে গতিশীলতা আনার জন্য হয়, তবে অন্যদের ১০ ভাগ রহিত করা উচিত। ৭০ শতাংশ বিসিএস কর্মকর্তার বদলে ১০০ শতাংশ সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে মেধানুসারে বণ্টন করা হোক। যদি তা সবার জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়, তবে কোটা বাতিল করা উচিত। কোনো বিশেষ শ্রেণির জন্য কোটা সৃষ্টি করা অনাবশ্যক। তা ছাড়া আমাদের সংবিধানে কেবল অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য কোটার কথা বলা হয়েছে। বিসিএস কর্মকর্তারা নিশ্চয় অনগ্রসর জনগোষ্ঠী নন। তা ছাড়া, সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে বিভাজন জনপ্রশাসনে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।
আবার বলা হয়েছে, পিএইচডির জন্য সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৪৫ বছর। উন্নত দেশের ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে ন্যূনতম সময় লাগে ৪-৫ বছর। পিএইচডি শেষ করতে বয়স হবে ৫০ বছর। সরকারি চাকরিতে অবসরের বয়স ৫৭ বছর। মাত্র ৭ বছর সেবা নেওয়ার জন্য কারও পেছনে ২ কোটি টাকা ব্যয় অনেকাংশে অপচয়ের শামিল। উপরন্তু দেশে ফিরলে কেবল দুবছর চাকরি করার বাধ্যবাধকতা আছে। সে ক্ষেত্রে দুবছর সেবা পেতে ২ কোটি টাকা! তা ছাড়া, বিশ্বের বেশির ভাগ পিএইচডি স্কলারশিপের ক্ষেত্রে বয়সসীমা ৩৫ বছর নির্ধারিত থাকে। অধিক বয়সে পিএইচডি করা দুরূহ ব্যাপার। তাই প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপে পিএইচডির বয়সসীমা ৩৫ বছর করাই যুক্তিযুক্ত।
মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাদের রক্তে ভেজা মাটি থেকে এ দেশে চারা গজায়। অথচ তাদের সন্তান-সন্ততিদের জন্য সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ কোটা যে বৈষম্যের দোহাই দিয়ে বাতিল করা হল, সে বৈষম্য চালু হল নতুন সংস্করণে। এবার কোটা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নয়, বিসিএস কর্মকর্তাদের জন্য। যারা বিসিএস কর্মকর্তা হওয়ার তরে মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা বাতিলের জন্য নিজেকে রাজাকার পরিচয় দিতে কুণ্ঠাবোধ করেনি, তাদের জন্য ‘প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপ’ নামে চালু করা হচ্ছে অভিজাত কোটা। তবে কি তারা এই কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন করবেন? নাকি মনের আনন্দে এই কোটার সুফল ভোগ করবেন? নিশ্চয় তারা অবিবেচক হবেন না। যাই হোক, সে ফয়সালা তাদের ওপর।
সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় দুই হাজার সরকারি কর্মকর্তার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে সে দেশের সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এটি একটি ভালো উদ্যোগ। প্রশাসনে গতিশীলতা আনতে কেবল ভারত নয়, বিশ্বের উন্নত দেশে সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো উচিত। এখনো মাঝে মধ্যে পাঠানো হয়। অবাক করা বিষয় হল, এবার প্রশিক্ষণ নয়, সরকার উচ্চশিক্ষার্থে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ‘প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপ’ চালু করেছেন।
প্রশ্ন হল সরকারি কর্মকর্তাদের কি পিএইচডি করা খুবই দরকার? বিশ্বের কোন কোন দেশের সরকারি কর্মকর্তারা সরকারের খরচে পিএইচডি করেন? পিএইচডি একটি বিশেষায়িত ডিগ্রি। এটি যারা ভবিষ্যতে শিক্ষক ও গবেষক হতে চায়, তাদের জন্য প্রযোজ্য। অন্যরা করতে পারেন। কিন্তু আবশ্যক নয়। আমাদের জাতীয় শিক্ষা নীতি কি বলে? ‘চার বছরের স্নাতক সম্মানকে সমাপনী ডিগ্রি হিসাবে ও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষকতা ও গবেষণা ব্যতীত সব কর্মক্ষেত্রে যোগদানের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা হিসাবে বিবেচনা করা হবে।’ তাহলে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য প্রশিক্ষণ কি যথেষ্ট নয়? বিতর্কে না গিয়ে ধরে নিলাম, তাদের পিএইচডি ডিগ্রি দরকার ও তারা তা অর্জন করুক। এখনো অনেকে নিজ চেষ্টায় ও সরকারি উদ্যোগে তা করছে বটে।
একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। ধরুন, একজন রসায়নে মাস্টার্স করে বিসিএস দিয়ে প্রশাসনে চাকরি নিলেন। এবার তিনি সরকারি বৃত্তি নিয়ে হার্ভার্ড থেকে রসায়নে পিএইচডি করলেন। সিন্থেসিসের ওপর যথেষ্ট ভালো কাজ করে দেশে ফিরে গেলেন। বলুন, প্রশাসনের কোনো জায়গায় উনি সিন্থেসিস করবেন? ভবিষ্যতে বাংলাদেশে তিনি কি গবেষণা করবেন? তবে হ্যাঁ কিছু বিষয়, যেমন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, জনপ্রশাসন, ব্যবস্থাপনা, ক্রিমিনোলজি (পুলিশদের জন্য), অর্থনীতি—এ ধরনের মুষ্টিমেয় দু-একটি বিষয়ে পিএইচডি করলে বাংলাদেশের প্রশাসন লাভবান হতে পারে। তাও অপরিহার্য নয়। যেকোনো বিষয়ে গণহারে এ বৃত্তি জনগণের করের টাকার অপচয় ছাড়া কিছু নয়।
বছরে কেবল যদি ১০ জনকে মাস্টার্স ও ১০ জনকে পিএইচডির জন্য নির্বাচন করা হয়, তাতে সরকারের খরচ হবে ২৬ কোটি টাকা। অথচ ২৬ কোটি টাকায় বাংলাদেশে উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য একটা প্রতিষ্ঠান করা যাবে। এভাবে বৃত্তির নামে জনগণের ঘামের টাকা বিদেশে পাচারের কোনো মানে হয় না। বাংলাদেশের অনেক উচ্চশিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত যুবক যারা নিজে বৃত্তি জোগাড় করে বিদেশে পড়াশোনা করে দেশে ফিরতে চায়। সরকার একটি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট করে বিষয়ভিত্তিক উচ্চশিক্ষিত, প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞদের নিয়োগ দিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের পিএইচডি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন। নতুবা দেশের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে পেশাদার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারেন ও এসডিজি অর্জনে বাংলাদেশের সক্ষমতা অর্জনে যে সব বিষয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে সেসব বিষয়ে পিএইচডি ও মাস্টার্স প্রোগ্রাম চালু করে সরকারি কর্মকর্তাদের প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপ দিয়ে এসব প্রোগ্রামে ভর্তি করানো যেতে পারে। তাতে জনগণের করের টাকা জনগণের কাছে ফিরে যাবে। বাংলাদেশে উন্নত প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। ‘প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপ’ পাওয়া প্রশিক্ষণার্থীদের টাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন হবে, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চালু থাকবে।
প্রয়োজন হলে বিদেশ থেকে দক্ষ ও অভিজ্ঞ প্রশিক্ষক ও শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। প্রয়োজনে সরকার দক্ষ ও বিজ্ঞ সাবেক আমলাদের (ড. আকবর আলী খান, ড. সাদাত হোসেন, এ টি এম শামসুল হুদা, আলী ইমাম মজুমদার, ড. ফরাস উদ্দিন) প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে নিয়োগ দিতে পারে। আমাদের দেশের প্রশাসনের সমস্যা কোথায় তাঁদের চেয়ে ভালো কেউ বুঝবে না। তা না হলে আমাদের প্রশাসনের অবস্থা হবে মগবাজারের উড়াল সেতু অর্থাৎ ডানহাতি গাড়ি চালকের দেশে বাম হাতি গাড়ি চালকের সেতুর মতো।
বিচারকদের জন্য সরকার বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট করেছে। বিসিএস কর্মকর্তাদের জন্য তেমন ইনস্টিটিউট করতে পারে অথবা সাভারে যে বিপিএটিসি আছে তাকে আধুনিকায়ন করে গবেষণার উপযুক্ত দেশের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করে সেখান থেকে সরকারি কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়া যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপের টাকা বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে খরচ করা হলে দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের কোনো অর্জন হবে না। আর যদি বিষয়টা এমন হয়, কেবল বিদেশে যাওয়াটাই উদ্দেশ্য, তাহলে যত বাধ্যবাধকতাই দেওয়া হোক, তাদের অনেকে দেশে ফিরবেন না। অনেকে সরকারি টাকা বিদেশে খরচ করে পরিবারকে বিদেশে অভিবাসী করবেন যাতে অবসরোত্তর সময়টা বিদেশে কাটাতে পারেন।
নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা কম্পিউটার সায়েন্স, বিবিএ, এমবিএ ও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য ভারতে পাড়ি দিত। এক দশকে বাংলাদেশ কোটি কোটি টাকা হারিয়েছে। কিন্তু এখন আর কেউ এসব বিষয় পড়ার জন্য ভারতে যায় না। কারণ আমাদের বেসরকারি বিশ্ববদ্যালয়গুলো এসব বিষয়ে ভালো শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। বস্তুত, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত ছিল যুগান্তকারী।
আমাদের প্রবাসীরা দিনরাত পরিশ্রম করে দেশে অর্থ পাঠায় আর সে অর্থ যদি সরকারি কর্মকর্তারা উচ্চশিক্ষার নামে বিদেশে খরচ করেন, তা হবে নিতান্তই দুঃখজনক। আশা করি সরকার আরেকটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে জনগণের অর্থের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করবেন।