চোখ ও একটি চশমা

প্রতিদিন পড়ন্ত বিকেলে খোলা আকাশের নিচে চিলতে উঠানের এক কোণে হাতল ভাঙা চেয়ারটাতে বসে টানা টানা শ্বাস নেন নীলু মাস্টার। আগের সেই মুক্ত বাতাসের আমেজ মাখানো মিষ্টি ছোঁয়াচটা এখন তাঁর বুকটাকে ঠান্ডা করে দেয় না। অসীম আকাশের দিকে তাকালে রঙিন কল্পনার ফানুস উড়তে এখন আর দেখা যায় না। এখন যে দিকেই চোখ যায় শুধু রাশি রাশি জিজ্ঞাসার চিহ্ন কিলবিল করছে। যেখানেই তিনি পা রাখেন, কেমন একটা বন্ধুর পৃথিবীর অস্তিত্ব স্পষ্ট টের পান তিনি পায়ের নিচে। অথচ হাতের আঙুলগুলো এখনো আগের মতো নাড়া চাড়া করতে পারছেন মুক্ত ভাবে। সাদা খড়িমাটির গভীর আঁকাবাঁকা চিহ্ন কালো বোর্ডের ওপর এখনো অনায়াসে বসাতে পারছেন। ছেলেমেয়েদের সামনে দাঁড়িয়ে বুক ফুলিয়ে হাত নেড়ে পড়াতে গিয়ে মাঝে মাঝে থমকে যান, এক কালের বিশিষ্ট শিক্ষক সবার পরিচিত ব্যস্ত চেহারার মানুষটি, নীলু মাস্টার।
বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত অথচ কী তাঁর চাহনির তেজ! অগণিত ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে অনুসন্ধিৎসু চাহনিতে এখনো খোঁজেন প্রকৃত মেধাবী ও অধ্যবসায়ী শিক্ষার্থীদের। অবিশ্বাস ও সন্দেহের মিহি দানাগুলো দিন দিন জমাট বেঁধে মস্ত এক পাথর হয়ে চেপে ধরেছে যেন এখনকার নীলু মাস্টারের বুকের হাড়গুলোকে! না কাউকেই বিশ্বাস করা যায় না। তাঁর স্কুলের এক কালের গৌরব সেই কৃতি সন্তান মানিক, সাগর আর মায়া জন্ম নেবে না এই জালিয়াতির যুগে। না কোথাও না। শিক্ষার প্রকৃত মান, প্রকৃত মর্যাদা-আজকের সমাজের পায়ের নিচে, আস্তাকুঁড়েই যেন নিক্ষিপ্ত!
অন্যেরা বলে, নীলু মাস্টার এখন আর স্পষ্ট দেখতে পান না। চিন্তাশক্তি তাঁর লোপ পাচ্ছে ক্রমাগত এবং খুব দ্রুত গতিতে। হয়তোবা নীলু মাস্টার অবসর নেবেন তাড়াতাড়ি এবং তাঁর স্থলে আর একজন যুবক, মাস্টার হয়ে ছাত্র ছাত্রীদের সামনে এসে দাঁড়াবে।
শুকনো দুটো হাঁটুতে ভর করে নিজের ঘরটার দিকে এগিয়ে যান একজন চিন্তামগ্ন মানুষ, অর্থাৎ একটা সাধারণ হাইস্কুলের পুরোনো মাস্টার। যেখানে বসে তিনি মানিক, সাগর, মায়াকে পড়িয়েছেন, শাসন করেছেন, শিক্ষা দিয়েছেন, সেই বেড়া চালে আবৃত; কোথাও অনাবৃত স্কুল ঘরটি এখন ইট-সুরকি সমৃদ্ধ দালানে পরিণত হয়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে ছেলে মেয়েদের সংখ্যাও। এই দীর্ঘ শিক্ষকতার জীবনে কত শিক্ষার্থী এল আর কত যে গেল! শিক্ষক শিক্ষিকা ও বদলি হয়েছে বিস্তর। পুরোনো চেয়ার টেবিল ব্ল্যাকবোর্ড বদলিয়ে নূতন করা হলো কত বার! কত খড়িমাটি এখানে নিজেদের আত্মাহুতি দিয়েছে—সেই সঙ্গে দিনের পর দিন একটি মানুষ পলে পলে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন নিরন্তর, কিন্তু অপসারিত বা অদৃশ্য হননি কখনো! বহাল তবিয়তে এখনো আঁকড়ে ধরে আছেন নিজের সোনালি অতীতকে!
নীলু মাস্টার এখন বইয়ের কারাগারে নিজের চশমাটা হাতড়ে মরছেন! পাশের ঘর থেকে রুগ্ন মহিলার কাশিরশব্দ সংমিশ্রিত মৃদু আর্তনাদ ভেসে আসছে। নীলু মাস্টার ধুতির খুঁটে তাঁর চশমার ঘোলা কাঁচ দুটি মুছে পা বাড়ান পাশের ঘরের দিকে।
ওষুধের চামচ এখন যার মুখে ঢেলে দিচ্ছেন নীলু মাস্টার, তিনি তাঁর স্ত্রী এবং পাঁচ সন্তানের জননী, মেরী। সংসারের অভাব অভিযোগ টলাতে পারে না নীলু মাস্টারকে। ঘুষ উৎকোচ কিংবা পরীক্ষায় নকল করা ... শব্দগুলো নীলু মাস্টারের অভিধানে নেই। আর নেই বলেই নীলু মাস্টারের সংসারে একটানা টানাপোড়েন; রোগব্যাধি।
চশমাটা তাঁর অনেক দিনের পুরোনো। গোল সাইজের কালো ফ্রেমের ওপর বসানো মোটা কাঁচ দুটো। দু’ কানে ধরাধরি করে নাকের ডগায় বসে থাকে পাকিস্তান আমলের সেই চশমাটা। অথচ ওটা বদলান হয়নি এ যাবৎ।
কোনো কিছু লক্ষ্য করার আগে কিন্তু চশমাটি তাঁর চাই। এটাই তাঁর দূরবীক্ষণ এবং অণুবীক্ষণ যন্ত্র! আবার এটাই রাতের ঘোর অন্ধকারে সুন্দর কাজ করে! পরীক্ষায় নকল ধরতেও বেগ পেতে হয় না; যদি চশমাটা চোখে সাঁটানো থাকে।
কিন্তু ইদানীং নীলু মাস্টার নকল ধরেন না! শুধু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখেন। আবার কখনো সহ্য করতে না পেরে হল ছেড়ে বেরিয়ে যান!
চিনচিনে একটা ব্যথা ওঠে মাঝে মাঝে। কখনো বুকে। আবার কখনো পিঠে। শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। চোখে চশমাটা সেটে নিজের চেহারা দেখেন- চোখ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। কোনো পরিবর্তন চোখে পড়ে না। অথচ আশে পাশে অকালে কী সব সাংঘাতিক পরিবর্তিত দৃশ্য চোখে পড়ে! অশিক্ষা কুশিক্ষার নৈরাজ্য! সমাজটার দেহের সর্বত্রই ব্যাকটেরিয়া ভাইরাসের তুমুল ছড়াছড়ি! রাহাজানি, লুট, ধর্ষণ মায় ব্যাপক অরাজকতা গোটা সভ্যতাকেই উল্টে দিচ্ছে যেন! শিক্ষার নামে কুশিক্ষা, নগ্নতা, বিচারের নামে ব্যভিচারের নিখুঁত চিত্র নীলু মাস্টারের চশমার কাচে ধরা পড়ে!
নেই! অথচ কেঊ নেই! এমন কেউ নেই, যে এসব যৌবনের শতদলকে প্রস্ফুটিত হওয়ার ডাক দেবে! কেউ নেই, যে সঠিক নেতৃত্বের মাধ্যমে শিক্ষার্থী নামধারী যুবক যুবতীদের একই পতাকা তলে জড়ো করে প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণে অনুপ্রাণিত করবে।
বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নীলু মাস্টারের পদধূলি এখন পড়ে না। হাঁপানি রোগের প্রকোপটা তাঁর বেঁড়ে যায়। হাত পাও অস্বাভাবিকভাবে ফুলতে থাকে!
ইতিমধ্যে সবদিকে রাষ্ট্র হয়ে গেল, নীলু মাস্টার অবসর নিয়েছেন। এবং অতি শিগগিরই আর একজন যুবক, মাস্টার হয়ে ছাত্র ছাত্রীদের সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে!
এদিকে পাঁচ সন্তানের টানাটানির সংসারে রুগ্ন স্ত্রীকে নিয়ে নীলু মাস্টার নিয়তির কক্ষপথে প্রবল ঘুরপাক খাচ্ছেন অবিরাম গতিতে।
অতি কষ্টে শেলফ থেকে রবীন্দ্রনাথ, বার্ট্রান্ড রাসেল, শেক্‌সপিয়ার টেনে নেন বুকের ওপর। এলোমেলো পৃষ্ঠা উল্টান দ্রুত। ডান হাতের জীর্ণ ক্লিষ্ট আঙুল নাড়াচাড়া করেন। তবে ব্ল্যাক বোর্ডে নয়! নিজেরই শুকনো বুকে কিংবা উত্তপ্ত চওড়া কপালের ওপর।
পুরো একটা বুকশেলফ ক’দিনের মধ্যেই খালি হয়ে গেছে! স্ত্রীর ও নিজের ওষুধ-পথ্য, পরিবারের সাতটি মুখের জন্য দু’বেলা দু’মুঠো করে কিছু দানা জোগাড় করার অন্য কোনো উপায় না দেখে নিতান্ত অসহায় অবস্থায় বড় ছেলেকে দিয়ে হাটে পাঠিয়ে দিয়েছেন এক কালে অসচ্ছলতার সঙ্গে সংগ্রাম করে করে উপার্জিত সম্পদ মূল্যবান বইগুলো, সের দরে বিক্রি করার জন্য! কত টাকাই বা মিলবে! নীলু মাস্টারের বড্ড দুঃখ, কেউই বুঝল না, এগুলো আসলে কী! ইচ্ছা ছিল তাঁর, বইগুলো এক সময় স্কুলের লাইব্রেরির জন্য সম্প্রদান করে যাবেন তিনি। কিন্তু তা আর হলো না! নিজের সদিচ্ছাকে দু’হাতে ঠেলেও দিলেন তিনি পরিবারের কথা ভেবে! এক সময় স্কুল কমিটির কাছে প্রস্তাব করেছিলেন, বইগুলো নামমাত্র মূল্যে কিনে স্কুল লাইব্রেরিতে উঠিয়ে আনার জন্য। কিন্তু তাতেও সাড়া মেলেনি! অবশেষে স্ত্রী ও বড় ছেলের পীড়াপিড়ি, সর্বোপরি পরিবারের কথা চিন্তা করে, নিজের কাছে নিজেই চরম পরাজয় বরণ করেন ইদানীং কালের নীলু মাস্টার। হাটে বই নেওয়ার দৃশ্যটি চশমা সাঁটা চোখে দেখতে চাননি তিনি কিছুতেই! বড্ড দুঃখবোধের ভারে জর্জরিত দারিদ্র্যের যূপকাষ্ঠে; নিজের অস্তিত্ব রক্ষার প্রাণান্তিক সংগ্রামে লিপ্ত নীলু মাস্টার নামক অসহায় মানুষটার রোমাঞ্চকর পরিণতির শেষ দৃশ্যটা দেখে যাওয়ার বড্ড সাধ জাগে তাঁর মনে। তাই আশে পাশে হাতড়ে চশমাটা চোখের সামনে তুলে দেখেন মর্মান্তিক দৃশ্য! কী এক নির্মম ও মর্মান্তিক ভঙ্গিতে বইগুলো বস্তায় ভরা হচ্ছে! যেন কত যুগের স্তূপীকৃত ময়লা-আবর্জনা! দু’চোখের কোণ বেয়ে নেমে আসা অশ্রুর ধারা চশমার কাচ ঝাপসা করে দেয়!
নীলু মাস্টার ও তাঁর পরিবারকে আর্থিক সাহায্য করার জন্য স্কুল কমিটির পক্ষ থেকে কিছু অর্থ তোলার জল্পনা কল্পনা চলতে লাগল। গ্রামবাসীদের কাছে প্রধান শিক্ষকের পক্ষ থেকেও সাহায্য চাওয়া হলো। স্কুলের ছেলে-মেয়েরাও স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে এগিয়ে আসছে।
তো সময়ের পেন্ডুলামে নেই কোনো স্থিরতা। ঢেউ ওঠে; ঢেউ ভাঙে জীবন সৈকতে প্রগাঢ় গতিতে। গভীর রাতে পাশাপাশি দুটো ঘরে নিস্তব্ধতা নেমে আসে নিপুণ ভঙ্গিতে। পাঁচটি সন্তান বিক্ষিপ্ত অবস্থায় গভীর ঘুমে অচেতন। নিজের বাড়ির সাবেক লাইব্রেরি রুমে নীলু মাস্টারের চশমা সাঁটা চোখ এবং তারই পাশের ঘরে পাঁচটি সন্তানের জননী নীলু মাস্টারের সহধর্মিণী মেরীর যন্ত্রণাকাতর ক্লান্ত চোখের চাহনি নিথর হয়ে আছে।
নীলু মাস্টার নিজের সঙ্গে কোনোদিন আপস করতে পারেননি। দুঃখ কষ্ট একান্তই আপনার। কারও প্রতি কোনো অভিযোগ তাঁর ছিল কিনা বলতে পারি না। তবে এ সমাজটাকে তিনি মানুষ মারার একটা অত্যাধুনিক যন্ত্র হিসেবে নিশ্চয় জেনেছেন। যে সমাজ কেবলমাত্র নমস্কার আর সালামের বিনিময়ে নীলু মাস্টারদের যাবতীয় সখ ও সুখের পথ রুদ্ধ করে রাখল, তাদের কাছে তিনি কী চেয়েছেন? তার কিইবা পেয়েছেন? তাঁর জীবনখাতায় দেনা-পাওনার হিসেব মিলাতে গিয়ে কি তিনি নিজের কাছে শোচনীয় পরাজয় বরণ করেছেন? তাঁর নিজের সেই একটি পুরোনো চশমা কী বিচিত্র অভিজ্ঞতা তাঁকে দিল? নিশ্চয় তিনি অনেক বেশি দেখেছেন। অনেক বেশি জেনেছেন আর অনেক অনেক বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে অবশেষে নিজের প্রতি সমাজের দেওয়া এই ভালোবাসার ঋণের ভার পরিশোধ করে গেছেন।
হয়তো তাই আবার তাঁর স্ত্রী মেরীকে বলেছিলেন, তোমাকে একদিন এমন কিছু জিনিস দেখাব আমি, যা দেখে তুমি শুধু আশ্চর্য ও অভিভূতই হবে না, একদম অন্যরকম মানুষ হয়ে যাবে! শুধু সময় আসতে দাও। তুমি আর আমি এক চশমায় আমাদের দু’জোড়া চোখ রেখে সেদিন বলে যাব,
এমনি করেই জীবনের বহু বছরকে পিছে ফেলে,
পৃথিবীর বোঝা ক্ষুধিত রানার পৌঁছে দিয়েছে মেলে।
ক্লান্ত শ্বাস ছুঁয়েছে আকাশ মাটি ভিজে গেছে ঘামে,
জীবনের সব রাত্রিকে ওরা কিনেছে অল্প দামে।