অসম্মানকে নয় মৃত্যুকে বেছে নিলেন নুসরাত

নুসরাত জাহান রাফি যেন একটি স্ফুলিঙ্গের নাম। একটি প্রতিবাদী চেতনা। প্লেটোর সংলাপ বইয়ে পড়েছিলাম, সক্রেটিসকে তাঁর প্রিয় শিষ্যরা বাঁচানোর জন্য বহু চেষ্টা করেছিল। প্লেটো, ফ্রিডো, কিটো তাকে পালিয়ে যেতে কাকুতি–মিনতি করেছিলেন নানাভাবে। তখন সক্রেটিস বলেছিলেন, ‘মৃত্যুকে এড়ানো তত কঠিন নয়, যতটা কঠিন অসম্মানকে এড়ানো।’
ছোট্ট মেয়ে নুসরাত সম্ভবত প্লেটোর সংলাপ পড়েননি। তবুও তিনি সক্রেটিসের মতো নিজেকে অসম্মানিত হতে দেননি। যে মাদ্রাসা শিক্ষক তাঁকে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে তিনি পুলিশের কাছে রিপোর্ট করতে পিছপা হয়নি। আবার তাঁর বান্ধবীকে মাদ্রাসার ছাদে মারধর করা হচ্ছে শুনে ছুটে গেছেন বাঁচাতে। কারণ তিনি ছিলেন পরোপকারী। আর এটা যে ফাঁদ ছিল, সরল মেয়েটি সেটা বুঝতে পারেননি। তাঁর গায়ে আগুন ছুড়ে দিয়েছে নরপিশাচরা। আগুনের লেলিহান শিখায় যখন তিনি পুড়ছিলেন, তখন তাঁর কাছে কাউকে যেতে দেয়নি হত্যাকারীরা। চার দিন পরে তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। এভাবে মৃত্যুকে বেছে নিয়েছেন নুসরাত। তাঁর মৃত্যু হয়েছে একজন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে। 

এতটুকু মেয়ে! কিন্তু প্রচণ্ড সাহস তাঁর। যেন এই যুগের জোয়ান অব আর্ক। শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত তিনি যুদ্ধ করে গেছেন। পিছু হটেননি। আর আমরা সুবিধাবাদীরা সবকিছুতে ভালো সাজি। নিজের স্বার্থে আঘাত না হানলে কোনো কথা বলি না। সুযোগ বুঝে, পরিস্থিতি দেখেশুনে প্রতিবাদ করি। আমরা কালোরে কালো বলি না, সাদাকে সাদা বলি না। একবার পাওয়া জীবনে শুধু আপস করে যাই। আমরা যে দল যখন ক্ষমতায় থাকে, তার গুনগান করি। নিজে যে কত বড় দেশপ্রেমিক, সেটি প্রমাণের জন্য জানপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা চালাই। আমরা গিরগিটির মতো খোলস পাল্টাই। যে পাত্রে যেমন দরকার, সেই পাত্রে সেভাবে আকার ধারণ করি।
নুসরাত কিন্তু তেমন ছিলেন না। শরীরের প্রায় ৮০ শতাংশ পুড়ে যাওয়ার পরও তিনি সাহস হারাননি। ফেনীর সোনাগাজীতে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করায় আগুনে পুড়িয়ে মারা হয় তাঁকে। অধ্যক্ষের কুকীর্তির কথা দুই বান্ধবীকে লিখে জানিয়েছিলেন তিনি। সেই চিঠি পুলিশ জব্দ করেছে। তবু কি আশা করা যায়, ন্যায়বিচার পাবে নুসরাত? প্রায় ৮০ ভাগ পোড়া শরীর নিয়ে চার দিনের লড়াই শেষে ১০ এপ্রিল বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে নয়টায় পৃথিবী ছেড়ে চলে যান তিনি। ছোট্ট মেয়েটি জীবন্মৃত থেকেও বলেছেন, ‘যে যেখানে আছ, সবাই আজ এক হও, প্রতিবাদ করো।’ তিনি বলেছেন, ‘আমি এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করেই যাব, আমার জীবন থাকতে যে অন্যায় প্রিন্সিপাল আমার সঙ্গে করেছে, সে অন্যায়ের সঙ্গে আপস করব না।’ কতটা সাহসী হলে মৃত্যু অবধারিত জেনে, এতটা সাহস নিয়ে কথা বলতে পারে একজন মানুষ!
পৃথিবীতে পুড়ে মরার চেয়ে এত কষ্ট আর নেই। মা-বাবার পর যে শিক্ষকের স্থান, সেই শিক্ষক নিজের প্রতিহিংসা মেটাতে মেয়েটির শরীরে আগুন লাগিয়ে দিলেন! ছাত্রী তাঁর কাছে মাংসপিণ্ড ছাড়া আর কিছু নয়। এই শিক্ষক কি কোনো দিন ভেবেছেন, শিক্ষকতার মতো মহান পেশাকে তিনি কতখানি কলুষিত করলেন! কোথায় নিরাপদ এখন বাংলাদেশের মেয়েরা? রাস্তাঘাটে? স্কুলে? কলেজে? আমরা কি ধর্ষিত হওয়ার ভয়ে, খুন হয়ে যাওয়ার ভয়ে মেয়েদের ঘরে আটকে রাখব? বের হতে দেব না! এসব দাঁতাল শুয়োরের জন্য কত মেয়ের বলি হলে আমাদের চেতনা জাগবে?
আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগের কথা শুনতাম, নারীদের ওপর পুরুষদের বর্বর আচরণের কথা! সেই যুগে না জন্মে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করার কোনো কারণ আছে কি? নেই! এখন যে যায়, সে চিরতরে চলে যায়। যে থাকে সারা জীবন ধরে তাকে কুরে কুরে খায় অক্ষমতার গ্লানি। অবশ্য আপনি যদি বিবেকহীন হন, তাহলে অন্য কথা। কারণ একটা সময় বিশ্বাস করানো হতো, অন্যায় যে করে আর অন্যায় সে সহে—উভয়ই সমান অপরাধী। এখন দুই পক্ষের সব অপরাধ মাপ হয়ে গেছে। অপরাধী সেই, যে অন্যায়ের প্রতিবাদ করে। তাকেই শাস্তি পেতে হয়। যেমন নুসরাত পেয়েছেন। মৃত্যু দিয়ে তিনি শাস্তি পেয়ে গেছেন। কোনো বিচারও তিনি পাবেন না। বিচারহীনতার সংস্কৃতি বাংলাদেশের সমাজে এতটাই জেঁকে বসেছে যে, কোনো কিছু মাপ পাওয়া যায়।
নুসরাতের হত্যাকারী মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার ফাঁসির দাবি জানিয়েছে অনেকে। কেউ কেউ বলেছে, তাঁকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হোক। যাতে তিনি বুঝতে পারেন মৃত্যুর বীভৎসতা। কিন্তু আদতে তার কোনো শাস্তি হবে কিনা, এ নিয়ে অনেকের মতো আমিও সন্দিহান। সিরাজ এক সময় সোনাগাজী পৌরসভার জামায়াতের আমির ছিলেন। পরে তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। এটা খুব স্বাভাবিক, অন্যায়কারীরা সর্বদা সরকারি দলের ছত্রচ্ছায়ায় থাকতে পছন্দ করে। আর তাঁকে বাঁচাতে তাঁর গডফাদাররা এমন কিছু নেই যা করবে না, সেটা আগেই বলে দেওয়া যায়।
তবু বলব, নুসরাত তুমি জিতেছ! এই পচা-গলা সমাজ, যেখানে সবাই জীবন্মৃত হয়ে বেঁচে আছে, মানবিক মূল্যবোধের কোনো স্থান নেই, নেই কোনো অন্যায়ের বিচার, সেখানে তুমি প্রতিবাদ করেছ! তুমি অসম্মান নয়, মৃত্যুকে বেছে নিয়েছ।