নতুন সময়, নতুন গণমাধ্যম

আমি একজন সংবাদপাগল মানুষ। ছোটবেলায় আমাদের বাসায় রাখা হতো দৈনিক ইত্তেফাক। কিন্তু একটা পত্রিকা পড়ে আমার মন ভরত না। পুরান ঢাকায় আমাদের বাসার কাছেই ছিল নানা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। সেখানে গিয়ে খুঁজে খুঁজে দৈনিক বাংলা আর সংবাদ পড়তাম।

পত্রিকার প্রতি এই আগ্রহের কারণেই আমার প্রথম পেশা হয়ে ওঠে সাংবাদিকতা। ১৯৮৯ সালে আমি ছিলাম ওয়েজ বোর্ডে বেতন পাওয়া একজন সাংবাদিক। আমেরিকার সাপ্তাহিক পত্রিকা ঠিকানার কথা ভালো করে শুনি এ সময়েই। জনপ্রিয়তা আর প্রভাবের কারণে ঠিকানাকে বলা হতো উত্তর আমেরিকার ইত্তেফাক। ১৯৯৬ সালে প্রথমবার আমেরিকা গিয়ে দেখি নিউজার্সির মর্গানভিলের ইঞ্জিনিয়ার থেকে জ্যাকসন হাইটসের তরকারির দোকান—সবখানে এই পত্রিকার জয়জয়কার।
ঠিকানার তখন দাম ছিল সম্ভবত এক ডলার। এক ডলার টাকা খরচ করে যে পরিমাণ মানুষ তখন এটি কিনত, তা ছিল বিস্ময়কর। এ সময় অন্য যে পত্রিকাগুলো বের হতো সেগুলোও কিনে পড়তে হতো, বেশ কয়েকটি পত্রিকা ছিল আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী।
১৯৯৮ সালে আমার পিএইচডি শেষ হলে লন্ডন থেকে আমেরিকায় গিয়ে থেকেছিলাম টানা ছয় মাস। লন্ডনে আমার স্কলারশিপের টাকা শেষ হয়ে গেলে চাকরি নিয়েছিলাম সাপ্তাহিক জনমত পত্রিকায়। সেখানেই আমি বাংলা টাইপ করা শিখি, বিদেশে বাংলা পত্রিকার সাংবাদিকতা কী, তা প্রত্যক্ষভাবে বুঝতে পারি।
আমেরিকায় গিয়ে একঘেয়েমি কাটাতে কাজ শুরু করি এখন সময় নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায়। সপ্তাহে দুই দিন সেখানে যেতাম, আমি আর পত্রিকার সম্পাদক কাজী শামসুল হক মিলে ঠিক করতাম পত্রিকার কনটেন্ট, লিখতাম দু–একটা নিবন্ধ, ভালো করে লক্ষ করতাম অন্য পত্রিকাগুলোও। পরে আমি যতবার বিদেশে গেছি, পত্রপত্রিকার খবর নেওয়ার চেষ্টা করেছি। গত বছর মাত্র চার দিনের জন্য লন্ডনে গিয়ে হেঁটে হেঁটে জনমত পত্রিকার বন্ধ অফিসের সামনে থেকে ঘুরে এসেছি, প্রবল ব্যস্ততার মধ্যেও আমেরিকায় প্রথম আলো অফিসে কাটিয়েছি অনেকটুকু সময়। বিদেশে (বিশেষ করে ব্রিটেন আর আমেরিকায়) বাংলা পত্রিকাগুলো নিয়ে কিছু বলার অধিকার তাই আমার সম্ভবত কিছুটা রয়েছে।

২.
লন্ডন ও নিউইয়র্ক—দুই জায়গায়ই বাংলা পত্রিকাগুলো ছিল অনেকাংশে বাংলাদেশের পত্রিকানির্ভর। আগে যখন বাংলাদেশের দৈনিকগুলোর ওয়েব এডিশন ছিল না, তখন বিমানে করে আসা কয়েক দিনের পুরোনো পত্রিকার জন্য বসে থাকত তারা। সেখান থেকে বহু সংবাদ ও নিবন্ধ হুবহু ছেপে দেওয়া হতো বিদেশে বাংলা পত্রিকাগুলোতে। পরে বাংলাদেশের দৈনিকগুলোর ওয়েব এডিশন বের হওয়ার পর এবং যোগযোগপ্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়নের পর এ কাজটি করা আরও অনেক সহজ হয়। এ সময় পত্রিকাগুলোর চরিত্র হয়ে দাঁড়ায় মোটামুটি এ রকম:
প্রথম পাতা ও শেষ পাতা: ৪০ শতাংশ স্থানীয় সংবাদ, ৬০ শতাংশ বাংলাদেশের পত্রিকা থেকে টুকে দেওয়া সংবাদ।
ভেতরে একটি বা দুটি পাতা: স্থানীয় সংবাদ, যেখানে বিভিন্ন সংগঠনের সম্মেলন, দিবস পালন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সংবাদ।
ভেতরে অধিকাংশ পাতা: বাংলাদেশের পত্রিকা থেকে ছাপিয়ে দেওয়া সংবাদ ও কলাম।
প্রায় প্রতিটি পাতায় অসংখ্য বিজ্ঞাপন।
কিন্তু এই বাংলাদেশনির্ভরতা পত্রিকার জন্য আর্থিকভাবে সংকটজনক হয়ে দাঁড়ায়। আগে যখন বাংলাদেশের পত্রিকা বিমানে করে আসত, তখন লন্ডন বা নিউইয়র্কে বসে এটি কেনার ক্ষমতা বা সুযোগ খুব অল্প মানুষের ছিল। ফলে বাংলাদেশের পত্রিকা থেকে সংবাদ আর কলাম সাপ্তাহিক ঠিকানা বা জনমত–এর মতো শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা ছাপালেও তা সেখানকার পাঠকের কাছে ছিল নতুন ও অত্যন্ত আকর্ষণীয়।
কিন্তু পরে সব পত্রিকার ওয়েব এডিশন বিনা মূল্যে, বিনা আয়েসে সহজলভ্য হয়ে যাওয়ার কারণে পরিস্থিতি বদলে যায়। বাংলাদেশের পত্রিকা থেকে টুকে দেওয়া সংবাদ আর কলাম সাজিয়ে বিদেশে পত্রিকা বিক্রি করার সুযোগ তখন অনেক কমে যায়।
বিদেশে বাংলা পত্রিকাগুলো সাপ্তাহিক। দৈনিক পত্রিকার তুলনায় সাপ্তাহিক পত্রিকার কনটেন্ট সাজানোর সময় থাকে অনেক বেশি। তবু বিদেশের বাংলা পত্রিকাগুলো এই নতুন সময়ের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেনি। বাংলাদেশনির্ভরতা কমিয়ে স্বকীয় সাংবাদিকতা শুরু করে তারা পাঠকের কাছে চাহিদা ধরে রাখার চেষ্টা করেনি। তারা বরং টিকে থাকার জন্য পত্রিকা বিনা মূল্যে এবং কেউ কেউ সেধে সেধে দেওয়া শুরু করে।
এর মধ্যেও কিছু পত্রিকা চেষ্টা করেছে স্বকীয় ধারার সাংবাদিকতার। কেউ কেউ এমনকি বাংলাদেশে স্থানীয় প্রতিনিধি রেখে তাঁর মাধ্যমে নিজস্ব রিপোর্ট তৈরির চেষ্টা করেছে, দেশে ও প্রবাসের স্বনামধন্য মানুষজনকে দিয়ে কলাম লিখিয়েছে। কিন্তু এটি খুব দীর্ঘমেয়াদি চিন্তাভাবনা ও যথেষ্ট পুঁজি বিনিয়োগ করে করা হয়নি। ফলে খুব একটা স্বকীয় ধারা তৈরি করা যায়নি এবং তাঁরাও খুব একটা আবশ্যকীয় হয়ে উঠতে পারেননি।

৩.
মুদ্রিত সংবাদপত্রের জন্য এমনিতেই খুব সংকট যাচ্ছে এখন। সংবাদভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেলের হুমকি মোকাবিলা করার জন্য তাকে ওয়েব এডিশন বের করতে হয়েছিল। ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পরে এমন বিস্তৃত হয়েছে যে বিনা মূল্যের ওয়েব এডিশনে কেউ ক্লিক করলেও এটা এখন একটা সাফল্য হিসেবে দেখে সংবাদপত্র।
মুদ্রিত সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে আছে পরিবেশবাদীরাও। কার্বন নিঃসরণ আর জীববৈচিত্র্য বিনষ্টের একটা বড় কারণ বন ও বৃক্ষনিধন। সংবাদপত্রে কাগজের ব্যবহার এ জন্য পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষে অনেক পরিবেশবাদী।
বিদেশে বাংলা পত্রিকাগুলোকে এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। যোগাযোগপ্রযুক্তির প্রবল গতির উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সংবাদ পরিবেশনার মাধ্যমকে সাজাতে হবে। কত দ্রুত, কত সহজে এবং বিনা মূল্যে সংবাদ পৌঁছে দেওয়া যায়—এই প্রতিযোগিতা বাড়তেই থাকবে। তবে এর মধ্যেও টিকে থাকবে স্বকীয় স্বাধীন ও উন্নত সাংবাদিকতা। টিকে থাকবে প্রাসঙ্গিক সাংবাদিকতা। আমার মনে হয় না, বিদেশে বাংলা পত্রিকাগুলো এসব বিষয়ে খুব একটা সচেতন রয়েছে।
বিদেশে যে প্রবাসীরা থাকেন, তাঁদের একটা বড় অংশ উন্নত মানের চাকরি করেন। তাঁদের কাছে এবং নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশি তরুণদের কাছে আওয়ামী লীগ বা বিএনপির আমেরিকা শাখার নেতারা কী বলছেন, বা দেশে কী রাজনৈতিক হানহানি চলছে, তা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। তাঁদের কাছে কোন সমিতির নতুন কমিটিতে কারা এলেন, কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কী সংগীত পরিবেশিত হলো, কে কাকে শুভেচ্ছা জানালো—এসব সময় নষ্ট করে পড়ার বিষয় নয়।
আমার ধারণা অন্য আরও বিষয় আছে, যা তাঁদের অনেক বেশি আকর্ষণ করতে পারে সংবাদপত্রের দিকে। মার্কিন সরকারের নীতি ও কর্মসূচিগুলো যেগুলো বাংলাদেশের মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে, তা নিয়ে বিশদ আলোচনা হতে পারে। বাংলাদেশের মানুষের যেসব কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা আছে, সেসব বিষয়ে বিশদ রিপোর্টিং হতে পারে। যেমন ম্যানহাটনের হুমায়ুন কবীরের মতো অনেক খ্যাতিমান বাংলাদেশি পুলিশ অফিসার আছেন। তাঁদের থেকে জেনে নিয়ে এ বিষয়ে প্রতিবেদন করা যেতে পারে। আমি একজনের কাছে শুনেছি সেখানে নার্সিং পেশাও খুব সম্ভাবনাময় হতে পারে বাংলাদেশের মেয়েদের জন্য। এমন অনুসন্ধান আছে কি পত্রিকাগুলোর?
বিদেশে বাংলাদেশি সমাজে কিছু বিতর্ক বহু পুরোনো। যেমন পোশাক, সংস্কৃতি, ধর্মপালন, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি বিষয়ে পুরোনো প্রজন্মের সঙ্গে নতুন প্রজন্মের মতভিন্নতা, দেশে ফিরে যাওয়া না–যাওয়া নিয়ে দ্বিধা ইত্যাদি। বিদেশে বহু অনালোচিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। যেমন বৃদ্ধ মা–বাবার জীবন, বৈবাহিক সম্পর্কে জটিলতা, সন্তানের সঙ্গে দূরত্ব, নিঃসঙ্গতা ইত্যাদি। এসব বিদেশের বাংলা পত্রিকায় নেই কেন সেভাবে? বিদেশে বহু বাংলাদেশি তরুণ কর্মজীবনে বিশাল সাফল্য অর্জন করেছেন। নাসা বা গুগলে কোন বাংলাদেশি তরুণ বড় চাকরি পেয়েছেন, তা আমরা আমেরিকার বাংলা পত্রিকা থেকে পাই না কেন?
আমি যদি বলি এসব বিষয় বিদেশের বাংলা পত্রিকায় একেবারে আসে না, তাহলে ভুল বলা হবে। আমি বরং বলব এসব আরও অনেক বিষয়, আরও বিস্তৃত ও গভীরভাবে বিদেশে বাংলা পত্রিকায় আনার সুযোগ রয়েছে। আরও অনেক বিষয়বৈচিত্র্য আনা সম্ভব পত্রিকায়। বিদেশে বাংলা পত্রিকায় থাকতে পারে ফেসবুক কর্নার, ভ্রমণ আলোচনা, বাংলাদেশে প্রবাসীরা যেসব সমস্যায় পড়েন, তা নিয়ে আরও গভীর অনুসন্ধান, থাকতে পারে আমেরিকার রাজনীতিক, প্রশাসক এমনকি মন্ত্রীর সাক্ষাৎকার।
বাংলাদেশে সবচেয়ে সফল ও প্রভাবশালী পত্রিকা প্রথম আলো দুই বছর ধরে আমেরিকা সংস্করণ বের করছে। প্রথম আলোর পরে আরও দু–একটি দৈনিকও একই চেষ্টা করছে। বিদেশে বাংলা সাংবাদিকতা (প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক) এদের হাত ধরে আরও অনেকটুকু এগিয়ে যাবে, এই প্রত্যাশা করছি।

আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।