নিউইয়র্কে 'প্রথম আলো'

২০১৬ সালের শেষ দিক ইব্রাহীম চৌধুরী খোকন ভাই হঠাৎ করেই জানালেন, যে প্রথম আলো নিউইয়র্ক থেকে বের হবে। যেন লেখা দিই। হিল সাইড অ্যাভিনিউতে অফিস একদিন ডেকে পাঠালেন। আমার বাসা থেকে কাছেই অফিস। হেঁটে যেতে সাত আট মিনিট লাগে। ভাবছিলাম, একটা পত্রিকা মানে একটা পৃথিবী। একটা মহাদেশ। ছোট ছোট শব্দে গড়ে ওঠে এ মহাদেশ, সাগর অতল। যেখানে পাওয়া যায় পুরো পৃথিবী থেকে শুরু করে সব গ্রহ নক্ষত্রে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা। হৃদয়ের রসদ, গল্প কবিতা সব কলরব। ‘প্রথম আলো’ তেমন একটা পৃথিবী আমার কাছে, অনেকের কাছে। প্রবাসে এসে প্রিয়জনদের সঙ্গে এসব দেশীয় ঐতিহ্য পড়ুয়া ব্যক্তি মাত্রই মিস করেন। এখান থেকে সে পত্রিকা বের হবে, এটা একটা আনন্দের খবর। সেই সঙ্গে লেখা চাওয়াটা যেন বোনাস কিছু।

প্রথম আলোর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় রোকেয়া হলের পেপার রুমের ডেস্কে। পত্রিকার উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি পাঠকের স্বাদ বদলে দিল। সেই থেকে কীভাবে জানি সবার মতো আমার ভালো লাগা বদলে গেল। প্রথম আলোই প্রথম হলো। বাংলাদেশে করপোরেট অফিসে সহকর্মীদের সঙ্গে সবার আগে পত্রিকা পড়া নিয়ে একটা শীতল যুদ্ধ হয়ে যেত। সকালের কফির মগ এক হাতে, অন্য হাতে পত্রিকা। না পেলে যেন মেজাজ খারাপ হতো। পত্রিকা পড়া শিখেছিলাম পঞ্চম শ্রেণিতে আব্বার কাছে, তখন ইত্তেফাক রাখা হতো। সে থেকেই প্রতিদিন খবরের কাগজ হাতে নিয়ে পড়া একটা অভ্যাসের মতো হয়ে গেছে। তবে তখন আমি ছবি দেখতাম। যার বেশি ভাগ ছিল ক্রিকেটারদের। রবি শাস্ত্রীকে হিরো মনে হতো।

এক বুধবার গেলাম। আমারও সে দিন অফিস নেই। দরজায় বেল দিতেই মেন গেট খুলে গেল। প্রথম দিন তাই একটু সংকোচের সঙ্গে গিয়ে সিঁড়িতে উঠলাম। খোকন ভাই দরজা খুলে নিয়ে গেলেন। ভেতরে ঢুকেই একটা অভ্যর্থনা ডেস্ক। কিন্তু ডেস্কে বসার মতো কেউ তখনো আসেনি। ডান দিকে প্রথম একটা রুম, পরের রুমটা কনফারেন্স রুম। বেশ বড়, অনেকগুলো চেয়ার, বড় টেবিল, এক পাশে বিশাল মনিটরের টেলিভিশন সাজানো, মিটিং-এর জন্য চমৎকার। দেয়ালে কাপড়ের ব্যানারে প্রথম আলো আপন মহিমায় আলোকিত।

সবার সঙ্গে পরিচয় হলো, লেখার নির্দেশনা এবং একটা অফিশিয়াল অনুষ্ঠানের আয়োজনের ব্যাপারে জানিয়ে দিলেন। এটা ঠিক যেন অফিস নয় আবার অফিস, সেটাকে একটা রূপ দিতে ঢাকা নিউইয়র্কের কর্তাব্যক্তিরা সদাই ব্যস্ত। ফ্লোরা ভাবি বাড়ি থেকে মুরগির ইয়াখনী বানিয়ে দিয়েছেন। সেটা সেদিন দুপুরে আমরা সবাই ভাগ করে খেলাম। এভাবে জমে উঠল আস্তে আস্তে প্রথম আলোর প্রথম অফিসটা।

১ ডিসেম্বরে ‘ওয়ার্ল্ড’স ফেয়ার মেরিনায় আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হবে প্রথম আলোর অভিযাত্রার। সে দিন সন্ধ্যাটা ছিল চমৎকার। মেরিনার বল রুমে ঢুকে মনে হয়েছিল চাঁদ স্বয়ং নেমে এসেছে ‘প্রথম আলো’কে আলো দিতে। সেই সঙ্গে বাঙালি নারীদের শাড়ি জুয়েলারির চমক, দেশি বিদেশি অনেক অতিথির আগমনে গমগমে পুরো রুম। নিম্মির উপস্থাপনার পর পরই প্রজেকশন স্ক্রিনে ভেসে উঠল ব্যুরো প্রধান ইব্রাহীম চৌধুরী খোকন ভাইয়ের হাস্যোজ্জ্বল মুখ। উনি বক্তৃতা দিলেন, তারপর আরও কিছু গুণীজনের মূল্যবান কথাবার্তা। তারপর নৃত্যগীতে যেন বাংলাদেশের কোনো অডিটোরিয়াম।

রুমের অন্য পাশে শুরু থেকেই চা কফি পর্বে মজাদার বাঙালি আয়োজন পিঠাপুলি, ফুচকা চটপটি থেকে শুরু করে আমেরিকান নাশতার বহর। ফুচকা দেখেই ঝলসে উঠতে দেখলাম আমার সঙ্গে থাকা প্রিন্সেসের মুখ। ঈশায়া আমার মেয়ে চটপটি ফুচকা খেয়েছে এত যে অনেক সাধাসাধির পরও রাতের ডিনার নেয়নি। বাফেট ডিনারও ছিল তেমন বাহারী। দীর্ঘ লাইন ধরে খাবার নিয়ে এসে সবাই যার যার টেবিলে এসে বসলেন। এ রকম এক মনোহর সন্ধ্যায় জ্বলে উঠেছিল প্রথম আলো।

তারপর, ৯ ফেব্রুয়ারি প্রথম অনলাইন সংখ্যা বের হলো। আমার লেখা এল, ‘স্বপ্নের নয় কর্মের দেশ আমেরিকা’। প্রতি শুক্রবার বের হতো। তারপর ২৬ মার্চে প্রথম প্রিন্ট সংস্করণ বের হবে। সে আয়োজন নিয়ে শুরু হলো আবার তোড়জোড়। বাংলাদেশ থেকে লেখক আনিসুল হক আসবেন সবার সঙ্গে মিটিং করতে। সেটা আমার জন্য অবশ্যই একটা এক্সাইটেড ব্যাপার বলা যায়। কিন্তু কাজ থাকার জন্য ঘুম থেকে উঠে খুব এলেবেলে ভাবে আমি সে মিটিং এ যোগ দিই। নিজে তৈরি হতে না পারলেও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নিজের মতামত জানানো এবং ছবি তোলা কোনো কিছুই বাদ ছিল না। অনুষ্ঠানের দিন আসন্ন অফিসে এলেন শিল্পী সেলিম চৌধুরী, রিজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, আরও অনেক গুণী জন, ঢাকা অফিসের লোক জন।

২৬ মার্চ ইয়র্ক কলেজের অডিটোরিয়ামে হলো প্রিন্ট সংস্করণের বেশ জমকালো অনুষ্ঠান। আমরা স্বাদ পেলাম প্রথম আলো আবার ছুঁয়ে দেখার। তবে দেশি সে স্বাদ হয়তো ছিল না তেমন তবুও আমরা আনন্দিত ছিলাম পাঠক হিসেব তো বটে, নিজের নাম কালো অক্ষরে দেখার মাঝেও আনন্দ ছিল। এভাবেই ছোট ছোট পায়ে প্রথম আলোর যাত্রা আলো ঝলমলে এ শহরে। এক সময় অফিসটা সরিয়ে নেওয়া হলো জ্যাকসন হাইটসে, কারণ সেটা একটা কেন্দ্রীয় পয়েন্ট বলা যায়। সবার জন্য যোগাযোগ সুবিধা বেশি। সাপ্তাহিক কর্মদিবসের মাঝে অফিসের আলো পুরোপুরি জ্বলে ওঠে বৃহস্পতিবারের বলা যায়। এখানে নিজের দেশ থেকে তো বটে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে পরিচিত বাঙালিরা এসে আরেক দফা সবার সঙ্গে পরিচিত হয়ে যান, দিয়ে যান দেশের মানুষকে দেশের খবরে উষ্ণ সম্ভাষণ। এ যেন হিনি সুতোয় গাঁথা মালা।

খুব নিরপেক্ষভাবে হিসেব করে দেখেছি, একটা প্রতিষ্ঠান হিসেবে লাভের অঙ্কের কোনো হিসেব প্রথম আলোর নেই। যা আছে তা মানুষকে ছুঁয়ে থাকার অদম্য ইচ্ছে। মানুষের কাছে থাকার সাধনা। অফিসের প্রয়োজনে ঢাকা থেকে জসিম ভাই সঙ্গে আরও সহকর্মীরা আসছেন, কর্তা ব্যক্তিরা আসছেন। যা খুব ব্যয় সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে একদিন হয়তো এ ভালোবাসা পাহাড় হয়ে ফিরে আসবে। এখানেও শুধু পাঠক প্রিয়তমা নয়, বাণিজ্যও করবে প্রথম আলো। ছোট এক রুমে বসে আমরা মিটিং করব না। গড়ে উঠবে কোনো করপোরেট বিল্ডিং, নিউইয়র্কের সব নিয়ন লাইটের বিলবোর্ড এর মতো এক আলো জ্বলবে নাম প্রথম আলো। আমি না লিখলেও প্রথম আলোকে ভালোবাসতাম। এখন শুধু ভালোবাসার সঙ্গে যোগ হয়েছে কিছু কৃতজ্ঞতা। নিউইয়র্কে প্রথম আলো নিয়ে এসেছে অন্য আলো।