'আমরা বাংলাদেশের জয় দেখতে চাই'

প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা সংস্করণের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত বন্ধু সমাবেশের মঞ্চে প্রথম আলোর সম্পাদকের সঙ্গে আমন্ত্রিত অতিথিরা। ছবি: সাকিফ চৌধুরী
প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা সংস্করণের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত বন্ধু সমাবেশের মঞ্চে প্রথম আলোর সম্পাদকের সঙ্গে আমন্ত্রিত অতিথিরা। ছবি: সাকিফ চৌধুরী

প্রথম আলো একমাত্র পত্রিকা, যার নামে বাংলাদেশে একটি চরের নাম আছে। আছে একটি সড়কের নাম। প্রথম আলো শুধু মানুষকে বস্তুনিষ্ঠ ও সত্য সংবাদই উপহার দেয় না, একটা জাতি কীভাবে সৎ ও মেধাবী হিসেবে গড়ে উঠবে, তারও সন্ধান দেয়।

প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা সংস্করণের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত বন্ধু সমাবেশে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান এসব কথা বলেন। ১৯ মে প্রবাসী বহুল নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের বেলাজিনো কনভেনশন সেন্টারে এই বন্ধু সমাবেশের আয়োজন করা হয়। এতে আমন্ত্রিত অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন।

প্রথম আলো সম্পাদক বলেন, ‘আমার স্বপ্ন একটাই, আমি বাংলাদেশের জয় দেখতে চাই। আমরা শুধু মানুষকে স্বপ্নের কথা বলি না। সেটা বাস্তবে করে দেখাই।’

প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার আয়োজিত এই সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন নিউইয়র্কের রাজনীতিক, সাংস্কৃতিক কর্মী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী ও মূলধারার রাজনীতিকেরা।

অনুষ্ঠানের শুরুতে অভিনেতা টনি ডায়েস সবাইকে প্রথম আলো বন্ধু সমাবেশে আমন্ত্রণ জানান। তিনি বলেন, ‘বন্ধু হলো সকালবেলার প্রথম আলোর মতো। যেটা সূর্য উদয়ের আগে শেষ রাতে দেখতে পাওয়া যায়। বন্ধুও জীবনের সবকিছুতে সবার আগে এগিয়ে আসে।’

বন্ধু সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান। ছবি: সাকিফ চৌধুরী
বন্ধু সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান। ছবি: সাকিফ চৌধুরী

টনি ডায়েস এরপরে মঞ্চে ডাকেন প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার আবাসিক সম্পাদক ইব্রাহীম চৌধুরীকে। ইব্রাহীম বলেন, ‘আমেরিকা আমাদের বাঙালিদের এখানে কাজের অনেক সুযোগ করে দিয়েছে। এখানে আমরা প্রথম আলোর উত্তর আমেরিকা সংস্করণ বের করতে পারছি সবার সমর্থনের কারণে। দুই বছর বেশি সময় নয়। আমাদের অনেক ব্যর্থতা আছে। আছে আবার সাফল্য। এখানে আমরা অনেকের আনুকূল্য পেয়েছি। সবার সহযোগিতায় এগিয়ে চলেছি সামনের দিকে।’

সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, ‘আমরা যখন বাংলাদেশে প্রথম আলো শুরু করেছিলাম, তখন ভাবিনি বিদেশেও নিয়ে যাব। নিউইয়র্কের আগে কাতারে প্রথম আলোর বিদেশ সংস্করণের যাত্রা শুরু হয়েছিল আজ থেকে চার বছর আগে। নিউইয়র্কে ‍শুরু হলো দুই বছর আগে। বিদেশে প্রথম আলোর সংস্করণ বের করা প্রথমে যতখানি সহজ ভেবেছিলাম, বাস্তবে তত সহজ ছিল না। ইব্রাহীম চৌধুরী আমার পুরোনো সহকর্মী। তিনি বহু বছর আমার সঙ্গে আছেন। একদল সংবাদকর্মী নিয়ে এখানেও কাজ করছেন। এই কর্মী দল লিখে, রিপোর্ট করে ও বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদের সাহায্য করছে। সবাইকে আমার ধন্যবাদ।’

সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ইনমার সম্মেলনে যোগ দিতে নিউইয়র্কে এসেছেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। এরপর তিনি সম্মেলনে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘ছাপা সংবাদপত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি সেখানে। অনেকে প্রশ্ন করেছেন, আসলেই কত দিন টিকে থাকবে ছাপা অক্ষরের সংবাদপত্র। ১৫ বছর? ২০ বছর? কারণ, এখন অনেকেই ছাপা অক্ষরে পত্রিকা পড়ে না। তার বাইরে অনলাইনে, মোবাইলে, টিভিতে, রেডিওতে খবর পড়ে ও দেখে। আমরা ভাগ্যবান যে প্রথম আলো শুধু বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিক্রীত পত্রিকাই নয়, প্রথম আলোর ওয়েব পোর্টালও বাংলা ভাষার সবচেয়ে পঠিত অনলাইন। বাংলাদেশের মোট ৬৬ লাখ মানুষ প্রথম আলো পড়ে। আর অনলাইনে পড়ে দুই শতাধিক দেশের ১০ লাখ মানুষ। এর বাইরে প্রথম আলোর আছে দুটি মাসিক ম্যাগাজিন। একটি প্রকাশনা সংস্থা। একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা আছে।’

বন্ধু সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছেন প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার আবাসিক সম্পাদক ইব্রাহীম চৌধুরী। ছবি: সাকিফ চৌধুরী
বন্ধু সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছেন প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার আবাসিক সম্পাদক ইব্রাহীম চৌধুরী। ছবি: সাকিফ চৌধুরী

কেন মানুষ প্রথম আলো পত্রিকা হাতে নেয়—এ বিষয়ে মতিউর রহমান বলেন, ‘আমরা বাঙালির এগিয়ে যাওয়ার কথা লিখি। মানুষের স্বপ্ন ও অগ্রযাত্রাকে সংবাদপত্রের মাধ্যমে তুলে আনি। ২০ বছর আগে যখন শুরু করেছিলাম, তখন প্রথম আলোর স্লোগান ছিল!“যা কিছু ভালো, তার সঙ্গে প্রথম আলো”। এখন আমাদের নতুন স্লোগান—“ভালোর সাথে আলোর পথে”।’
এরপর এই থিমের ওপর একটি তথ্যচিত্র দেখানো হয়।

মতিউর রহমান এরপর বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে প্রথম আলোর ভূমিকার কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘হাজারো ছেলেমেয়ে গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নিচ্ছে। আমরা সেরা কৃষক, সেরা বই, সেরা লেখক, সেরা খেলোয়াড়, সেরা অভিনেতা—সবাইকে পুরস্কৃত করছি। আমরা তরুণ প্রজন্মের উন্নয়নের জন্য অনেক উদ্যোগ নিয়েছি। আসল কথা হলো, আমরা বাংলাদেশের জয় দেখতে চাই।’ এরপর তিনি আরেকটি তথ্যচিত্র দেখান।

প্রথম আলো তার জন্মের সাড়ে তিন বছরের মধ্যে বাংলাদেশের এক নম্বর দৈনিক হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে দৈনিক প্রথম আলো যে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক উদ্যোগ নিয়েছে, নিউইয়র্কেও তা নেওয়ার কথা উল্লেখ মতিউর রহমান। তিনি বলেন, ‘নানা ধরনের সমস্যা, চাপ ও মামলা–মোকদ্দমা সত্ত্বেও আমাদের সামাজিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত আছে। অ্যাসিডদগ্ধদের সাহায্যের জন্য একবার প্রথম আলোর সবাই তাঁদের এক দিনের বেতন দান করেছে। এভাবে আমরা প্রথম আলো পরিবার ভালো কাজে এগিয়ে যেতে চাই। আগের তুলনায় বাংলাদেশে অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা হ্রাস পেয়েছে। মাদককে “না” বলুন—এই লক্ষ্যে অনেকখানি আমরা সফল হয়েছি। আমরা ৮০০ ছেলেমেয়েকে পড়াশোনার জন্য সাহায্য করেছি। এশিয়ান ওমেন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে আমাদের সাতজন দরিদ্র ছাত্র গ্র্যাজুয়েট হয়েছে। আমরা দরিদ্র ছেলেমেয়েদের জন্য পাঁচটি স্কুল পরিচালনা করছি।’

এরপরে আরও দুটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়, যেগুলোর মানবিক আবেদন স্পর্শ করে সবাইকে। ময়মনসিংহ নান্দাইল পাইলট স্কুলের এক ছাত্রী জুঁইয়ের বাল্যবিবাহ প্রতিহত করার জন্য ওর সাত সহপাঠীর লড়াইয়ের কাহিনি দেখানো হয়।

বন্ধু সমাবেশে আসা আমন্ত্রিত অতিথিদের একাংশ। ছবি: সাকিফ চৌধুরী
বন্ধু সমাবেশে আসা আমন্ত্রিত অতিথিদের একাংশ। ছবি: সাকিফ চৌধুরী

রাজশাহীতে প্রমত্ত পদ্মার মধ্যে অবস্থিত চরখিদিরপুরে এক গ্রামে প্রথম আলো ট্রাস্ট আলোর পাঠশালার কার্যক্রম দেখানো হয় আরেকটি তথ্যচিত্রে। যে গ্রামে একসময় সবাই ছিল নিরক্ষর। গ্রামের মেয়েদের বাল্যবিবাহ হতো। আর ছেলেরা হতো রাখাল। সেখানে ২০০১ সাল থেকে রেজিনা খাতুনের নেতৃত্বে একদল শিক্ষক পাঠদান করে চরের নানা বয়সী মানুষকে। তাদের দেয় শিক্ষার আলো। যেখানে সবাই ছিল শতভাগ নিরক্ষর, এখন ওই চরের একটি মেয়ে জিপিএ–৫ পেয়ে পাস করে দেখিয়েছে।

মতিউর রহমানের মূল বক্তব্যের পরে নিজেদের অনুভূতি ব্যক্ত করেন অতিথিরা। মুক্তিযোদ্ধা ড. জিয়া উদ্দীন আহমেদ প্রথম আলোকে একটি ইনস্টিটিউশন হিসেবে অভিহিত করেন। নিউইয়র্ক থেকে অ্যাসেম্বলিওম্যান পদে ডেমোক্র্যাট পার্টির প্রার্থী মেরি জোবাইদা, রাজনৈতিক-সামাজিক বিভাজন ভুলে সবাইকে একত্র হতে বলেন।

আরও বক্তব্য দেন ডেমোক্র্যাট পার্টির ডিস্ট্রিক্ট লিডার অ্যাট লার্জ অ্যাটর্নি মঈন চৌধুরী, জেবিবিএর সভাপতি শাহ নেওয়াজ, উৎসব ডট কমের প্রতিনিধি আল আমীন, এসেনশিয়াল হোম কেয়ারের হোসেন ইশতিয়াক, ডেমোক্রেটিক পার্টির ব্রুকলিন ব্যুরো প্রেসিডেন্ট এরিখ এডাম, কুইন্স কাউন্টি ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি জোসে নিয়েভস, অ্যাটর্নি অ্যাট ল’ জন পি ডিমাইয়ো, উডসাইড ও জ্যাকসন হাইটস ডেমোক্র্যাট ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ম্যানুয়েল পেরেজ, ডেমোক্র্যাট ডিস্ট্রিক্ট লিডার হিরা মনসেরেইট, নিউইয়র্ক সিটি কাউন্সিল মেম্বার ফার্নান্দো কাবরেরা, নিউইয়র্ক কাউন্সিল মেম্বার ডোনোভান রিচার্ডস, ডেমোক্র্যাট সিভিল কোর্ট জাজ মালডেনাডো ক্রুজ।

ইন্টারফেইথ কমিউনিটি অ্যাকটিভিস্ট ইমাম কাজী কাইয়্যুম ইফতারের মোনাজাতের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের নির্ধারিত সময়ের সমাপ্তি ঘটে। ইফতার ও নৈশভোজের পর প্রথম আলো সম্পাদক উপস্থিত সুধীজনের সঙ্গে কুশলবিনিময় করেন। নিউইয়র্কের বাইরে নিউজার্সি, কানেকটিকাটসহ ওয়াশিংটন মেট্রো এলাকা থেকে প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা বন্ধু সমাবেশে যোগ দিয়েছেন আমন্ত্রিত অতিথিরা।