প্রেম কিংবা পলায়ন

ঘরে ঢুকেই বুশরার বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে মাহির। বুশরা আনা বার্নসের সদ্য পুরস্কার পাওয়া বইখানা উলটে-পালটে দেখতে দেখতে মৃদু হাই তুলছিল। এমন ভাব করল মাহিরকে দেখে যেন মনে মনে এই অসময়ে তাকেই আশা করছিল। অথচ এমন সব আটপৌরে দুপুরে মাহির সাধারণত আসে না। সে আসে সন্ধ্যা নামার পর। অফিস ফেরত সব যানজট পার করে ঘামতে ঘামতে। তারপর আসার মিনিট পনেরো পর থেকেই শুরু করে দুঃখবিলাস। মাহিরের সঙ্গে বুশরার পরিচয় খুব বেশি দিনের নয়। এই হয়তো বছর খানিক হবে। তখন মাত্র কলাবাগানের এই চিলেকোঠার ঘরটা ভাড়া পেয়েছে সে বহু খোঁজাখুঁজির পর। একা মেয়ে মানুষকে কেউ বাড়িভাড়া দিতে চায় না। নেহাতই তাঁর সহকর্মীর পরিচিত ছিল বলে এই ঘরটা পাওয়া গেছে। আর মাহিরকে সে পেয়েছিল ঈদের একটা ক্যাম্পেইন করতে গিয়ে। ওরা দুজন দুই এজেন্সির পক্ষ থেকে ক্লায়েন্টকে কিছু আইডিয়া দিতে গিয়েছিল। কথা ছিল, যেকোনো এক পক্ষ কাজ পাবে, কিন্তু মূল বাজেট ভাগ করে দুজনকেই কাজে নিয়ে নিয়েছিল ক্লায়েন্ট। ক্যাম্পেইন চলার সময়টাতেও ওদের বন্ধুত্ব অতটা হয়নি, যতটা না শেষ হওয়ার পর হয়েছে। আসলে অনেক কিছুরই শেষ বলে কিছু নেই। হয়তো থাকেও না। 

বৈশিষ্ট্যহীন সব সন্ধ্যায় মাহির গল্পচ্ছলে বলে যায়, কীভাবে বাইশ বছর আগে এক বর্ষার দিনে খালি বাসায়        সে মুনশি খালুর খুব আপন হয়ে উঠেছিল। কীভাবে মুঠো    মুঠো চকলেট, কালার চুইংগাম আর রং পেন্সিলের     নানারকম আঁকিবুঁকি দিনে দিনে তাকে বড় করে তুলেছিল। আর তাই বাড়ির ছাদে, কিংবা সন্ধ্যা নম্বর পর বারান্দায়     মুনশি খালু যখন সবার অলক্ষ্যে ওর হাতে অন্ধকার এক তারাবাতি ধরিয়ে দিত, মাহির কেবলই কেঁপে কেঁপে উঠত ভয়ে আর অস্বস্তিতে। এমন দিনের গল্প বলতে বলতে মাহিরের হাতের তালু ঘেমে উঠত। বিছানার প্রান্ত ধরে সে হাত মুছতে থাকত বারবার।    

আজ সকাল থেকে খুব গরম ছিল। তবে বিকেল হতে হতে আকাশটা শান্ত হয়ে আসল। ঘরের একটিমাত্র জানালা দিয়ে বাতাস আসতে শুরু করল। হঠাৎ বাতাসে মুখ পেতে হা করে নিশ্বাস নিতে নিতে মাহির চোখ দুদুটি বন্ধ করে ফেলে। ওর হা করা মুখটা দেখে ওকে কেমন যেন মেসেঞ্জারের অবাক হওয়া হলদে ইমোটিকনের মতো দেখাতে থাকে। বাইরের আকাশটার আলো কমে যেতে যেতে কেমন যেন মায়া ছড়াতে শুরু করেছে। দূর থেকে ভেসে আসে গাড়ির হর্ন, রিকশার বেল আর অদূরের বাড়ি থেকে রেডিওর আওয়াজ। হালকা রোদেলা আলোতে অযথাই দুলে ওঠে ঘরের সবুজরঙা পর্দা। অল্প কিছুক্ষণের মাঝেই মুঠোফোনের অ্যাপ থেকে গান বেজে ওঠে,

‘ভাসালে কি আশায় রূপসী কুয়াশায়

কুহকিনী একাকিনী চুপিসারে আঁখি মুছনা’

বুশরা বই রেখে আনমনে দুহাত দুপাশে ছড়িয়ে দেয়। হাত মুঠো করে। যেন হাত ভরে ভরে তুলে নিচ্ছে কোনো অলীক বস্তু। অল্পপরেই কফি-দুধ-চিনির কৌটা বের করে। কফি মেশিনে পানি ঢালে। মাহির পৃথিবীর সব ক্লান্তি চোখে নিতে নিতে ঘুম ঘুম স্বরে অপলার কথা বলে। বুশরা শুনে যায়। অপলা মাহিরের প্রেমিকা ছিল। সদ্য বিয়ে হয়েছে এক ডাক্তারের সঙ্গে।

  • আজকেও দেখা করে এলাম অপলার সঙ্গে।
  • অফিস যাসনি?
  • নাহ। কাল থেকে যাব।
  • জানিস, অপলার গলায় একটা গোল্ডের চেইন। খুব চকচক করে। কিন্তু ওকে কেমন যেন বন্দী বন্দী লাগে এমন অলংকারে।
  • দেখা না করলেই পারিস।
  • করতে চাই না। হয়ে যায়। ও নিজেও দু একবার মানা করে, তারপর দেখা করতে চলে আসে। আসলে অপলা একটা নদী, থামতে পারে না কখনই, শুধুই বয়ে যায়।

বুশরা চুপ করে শোনে। একসময় কফি মেশিন পানি    গরম হয়ে যাওয়ার যান্ত্রিক শব্দ তোলে। দু চামচ কালো       কফি মেশিনে দিয়ে সে বাতাসে কফির ঘ্রাণ নেয়। একটা অদ্ভুত ঘোর নেমে আসে চোখে। মগে দুধ-চিনি মেশাতে মেশাতে পাবলো নেরুদার কবিতা আওড়াতে ইচ্ছে করে বুশরার। কিন্তু সে কিছুই করে না। একটা প্লেন উড়ে যায় খুব কাছ থেকে শব্দ তুলে। আর ওরা দুজন কফি মগ হাতে ঝিম মেরে বসে থাকে অনেকক্ষণ।

বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে বুশরা এই জাদু শহরে একা। প্রেম, অর্থ, প্রাপ্তি কিছুই তার জীবনে তেমন নেই। নাহ, প্রেম একদমই নেই, তা বলা যাবে না। টিএসসির এক অর্থহীন আড্ডায় মাঝে মাঝে প্রেমের বেশে একজন চলে আসে। সে আসার পর অপার্থিব এক ছায়াময়তা নেমে আসে সারা শহরে। বুশরার মনে খুব নিবিড় একটা জলধারা ঝরতে থাকে। আর মন্থর হয়ে যায় জগৎটা। সে আসে। অনেকের পাশাপাশি হাতে এক কাপ চা নিয়ে বসে থাকে দীর্ঘক্ষণ। মাঝে মাঝে মাটির গহিন থেকে ঠিকরে ওঠা পান্নার মতো হেসে বুশরার সঙ্গে কিছু অহেতুক গল্প করে। বুশরা তখন চুপ করে শোনে। আর মনে মনে অচিন বনভূমি থেকে গোছা গোছা নীল ফুল পাঠাতে থাকে প্রেমের উদ্দেশ্যে। এই চিলেকোঠার ঘরে অপলার সঙ্গে ভালোবাসা এঁকে রেখে যাওয়ার সময় মাহির বহুবার বলেছে, টিএসসির সেই সুবাস যেন বুশরা এই চিলেকোঠায় নিয়ে আসে। কিন্তু সে কিছুই করেনি। তাই প্রেম মাঝে মাঝে বিকেল বেলার ব্যস্ত সময়ে ফুরফুরে বাতাসের মতো টিএসসিতে হেঁটে আসে, চা পান করে, গল্প করে, আবার চলে যায়।

কোনো জৈবিক চাহিদা নয়, তবে প্রেমের হাত স্পর্শ করার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বুশরা তার চিলেকোঠার ঘরের জানালার পাশে বসে থাকে। আর নীল ফুল পাঠাতে থাকে বারবার। একদিন কোনো এক বর্ষা রাতে সেই প্রেম হয়তো তার বুকপকেটে হাত দিয়ে সত্যি শত শত নীল ফুল খুঁজে পাবে? আর না পেলেও ক্ষতি কী? এরপরেও ওদের চুপচাপ গল্পগুলো থেকে যাবে কোথাও না কোথাও। সবকিছুরই হয়তো কথিত গন্তব্য থাকতে নেই।

কফি মগ খালি হতে দেখে মাহির একটা সিগারেট ধরায়। বুশরা জানালার পাশে বসে থাকে।  মুঠোফোনে আবার গান বেজে ওঠে,

‘একাকিনী, চুপিসারে আঁখি মুছ না...’