'আমরা এখন নেতা-শূন্য'

জয়নুল আবদীন ফারুক
জয়নুল আবদীন ফারুক

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদীন ফারুক পায়ের চিকিৎসা শেষে বাংলাদেশের উদ্দেশে নিউইয়র্ক ছেড়ে গেছেন ১ জুন। ব্রুকলিনে তিনি মুখোমুখি হয়েছিলেন প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা কার্যালয়ে সোহেল মাহমুদের। কথা বলেছেন, বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচিসহ দলীয় বিভিন্ন বিষয়ে।

প্রশ্ন: এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনীতির অবস্থা কি?
জয়নুল আবদীন ফারুক: সরকারি দল ভালো আছে। তাদের নেতৃবৃন্দ, কর্মী-সমর্থকেরা ভালো আছেন; গ্রামপর্যায় থেকে শহর পর্যন্ত। কিন্তু, ভালো নেই শুধু গণতন্ত্রে বিশ্বাসী দলগুলোর নেতা-কর্মীরা। তাঁরা নির্যাতিত। বিশেষত, মঈন ইউ আহমেদের ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, গণতান্ত্রিক পন্থায় শাসনব্যবস্থায় বিশ্বাসী যারা, তারা এখন পর্যন্ত খুবই নির্যাতিত নিপীড়িত অবস্থায় আছেন। দু মাস ধরে চিকিৎসার জন্য আমি নিউইয়র্কে আছি। এখানে বসে যতটুকু খবর পাচ্ছি, এখনো দমন-পীড়ন চলছে। মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে। কিন্তু অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপগুলোই বেশি চলছে দেশে।

প্রশ্ন: এ পরিস্থিতিতে আপনার দলের ভূমিকাটা কি? এই যে দমন-পীড়নের কথা বললেন, এগুলোকে তুলে ধরতে, সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে এসবের প্রতিবাদ করায় বিএনপি কোনো কিছু করতে পারছে না কেন?
জয়নুল আবদীন ফারুক: এখানে বিষয় একটাই। অনেকে সমালোচনা করেন; বলেন, বিএনপি কিছু করতে পারছে না। করার বিষয়টা নিরপেক্ষভাবে বিবেচনা করে দেখুন। দেশে পুলিশি সরকার। যে দল ক্ষমতায় আছে তাদের বিরুদ্ধে যদি কেউ আন্দোলন করতে চায়, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবি তোলে, সেখানে পুলিশ দিয়ে বাধা দেওয়া হয়। মঈন ইউ আহমেদের সময় থেকে, শেখ হাসিনার দুই টার্ম (মেয়াদ) দেখুন, বিরোধী দলকে রাস্তায় নামতে দেওয়া হয়নি। পুলিশের অত্যাচারে কোনো মিটিং-মিছিল আমরা করতে পারিনি। এমনকি ঘরের ভেতরও কোনো অনুষ্ঠান করতে অনুমতির জন্য আমাদের দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে।
পাশাপাশি আমাদেরও কিছু দুর্বলতা আছে। অনেক জায়গায় আমরা সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় ভোটের মাধ্যমে নেতা নির্বাচনের কাজটা করিনি। নিজেদের পছন্দমতো লোক বসিয়েছি কমিটিতে। সেই নেতারা ভেবেছে, আন্দোলন করে, পুলিশের পিটুনি খেয়ে, জেলে গিয়ে লাভ কি? তবে, আমরা মনে করি এ দুর্বলতার চেয়ে পুলিশের অত্যাচার-নিপীড়ন অনেক বেশি হওয়ায় আমরা আন্দোলন করতে পারছি না।

প্রশ্ন: তাহলে উপায় কী? আপনারা কোন পথে যাবেন?
জয়নুল আবদীন ফারুক: আমরা এখন নেতা-শূন্য। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশের বাইরে। আর, যিনি আমাদের প্রকৃত আপসহীন নেত্রী, বেগম খালেদা জিয়া, (তিনি কারাগারে), ৭৪/৭৫ বছর বয়স তাঁর। তারা (আওয়ামী লীগ) বলে, সত্য মামলা; আমরা বলি কাল্পনিক মামলা, যে মামলার কোনো ভিত্তি নেই, সেই মামলায় দীর্ঘদিন জেলে তিনি। অতএব, আমরা অভিভাবকহীন, সভানেত্রীহীন দল পরিচালনা করছি। আমাদের দলে যে নেতা নেই, তা ঠিক নয়। আমাদের দলের নেতারাও ঐক্যবদ্ধ আছেন। অনেকে বলেন, বিএনপি থাকবে না। খালেদা জিয়া জেলে গেছেন। তারেক জিয়াকে ফিরিয়ে এনে কারাগারে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমি হতাশ নই। পৃথিবীর কোনো ইতিহাসে নেই যে, স্বৈরাচার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে পারে। একদিন না একদিন তার পতন আসবে। একদিন না একদিন জনগণ ঝাঁপিয়ে পড়বে আন্দোলনের পক্ষে।

প্রশ্ন: জনগণ ঝাঁপিয়ে পড়বে বুঝলাম, বিএনপি সেই নেতৃত্ব দিতে পারবে?
জয়নুল আবদীন ফারুক: সে সময় খুব কাছেই। আমি নিরাশ নই। বিএনপির যে সমর্থন সারা দেশে, সারা বিশ্বে গ্রহণযোগ্য একজন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, তাঁর অভাব ফিল করছি আমরা হান্ড্রেড পারসেন্ট। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের অভাবও ফিল করছি। একটা অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে শুধু দল হিসেবে বিএনপি নয়, জনগণও ফুঁসে উঠছে।

প্রশ্ন: কিন্তু উন্নয়ন তো হচ্ছে?
জয়নুল আবদীন ফারুক: হচ্ছে। কিন্তু, উন্নয়ন মানেই দুর্নীতি। বাংলাদেশের টাকায় উন্নয়ন হচ্ছে না। উন্নয়ন হচ্ছে বিদেশি টাকায়। পদ্মা সেতু নিয়ে কি কেলেঙ্কারিটা হয়েছিল, দেখেছেন। উন্নয়ন একেবারে হচ্ছে না, সেটা বললে আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী নই। হিংসা করে কথা বলার তো দরকার নেই।

প্রশ্ন: এই মারা কাটার রাজনীতি কবে থেকে শুরু হলো?
জয়নুল আবদীন ফারুক: অনেক আগে থেকে। আপনি নিজেও জানেন, স্বাধীনতার পরও দেশে গুম খুন হয়েছে। নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে। এ রাজনীতি নোংরা রাজনীতি। আমি এ রাজনীতিতে বিশ্বাসী নই। আমি রাজনীতি করি আমার দলের আদর্শ প্রচারের জন্য। মানুষের মন জয় করার জন্য।

প্রশ্ন: যে নোংরা রাজনীতির কথা বললেন, এ ধারা কি শেষ হবে কখনো?
জয়নুল আবদীন ফারুক: আমি যা দেখছি, মানুষের কাছে এ ধারার এখন আর গ্রহণযোগ্যতা নেই। এ দেশে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যা, জিয়াউর রহমানের মতো মানুষকে মেরে ফেলা, কোনো মানুষ কি এগুলো গ্রহণ করেছে?

প্রশ্ন: বঙ্গবন্ধুর কথা বললেন। তাঁকে কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
জয়নুল আবদীন ফারুক: আমি ওনাকে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে খুবই শ্রদ্ধা করি। আমি ওনার সমালোচনা করি না। কিন্তু, উনি চলে যাওয়ার পর ওনার আদর্শ কি বাস্তবায়িত হচ্ছে? ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু হতে আমার আরও দুই হাজার বছর লাগেব। জিয়াউর রহমান হতে পনেরো শ বছর লাগবে। খালেদা জিয়া হতে এক হাজার বছর। আমি রাজনৈতিক কর্মী, নেতাদের শ্রদ্ধা করি। আমি তার সমানই হতে পারব না, তার সমালোচনা কেন করব?

প্রশ্ন: দল হিসেবে বিএনপিকে মূল্যায়ন করুন। দল হিসেবে বিএনপি আরও কি ভালো করতে পারত?
জয়নুল আবদীন ফারুক: আমি দলের শীর্ষ পর্যায়ে একটা কথা সব সময় বলেছি, বিএনপিকে কৌশলের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপিতে ঝানু আমলা বেশি। ড. কামালকে প্রধানমন্ত্রী আশ্বস্ত করেছিলেন, ২০১৪ সালের মতো নির্বাচন এবার হবে না। সে বিশ্বাসটা যখন হারিয়ে ফেলেছি, তখন আমরা অপেক্ষা করছি। ইদ, কোরবানি, পরীক্ষা এসব কারণে আমাদের আন্দোলন বিঘ্নিত হতে পারে। কিন্তু, মানুষকে সংঘবদ্ধ করতে প্রকৃতপক্ষে তাদের কর্মসূচিগুলোই দিতে হবে। এ কর্মসূচি নট ফর ক্ষমতা। একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, বেগম জিয়া কারাগারে। মামলার কাগজপত্রে এধার-ওধার হতে পারে। কিন্তু, তিনি এক কোটি টাকা চুরি করার মানুষ না। এটা আওয়ামী লীগের অনেক নিরীহ নেতা-কর্মীও বিশ্বাস করেন। মার্ডার কেসের আসামি, ১০ খুনের আসামি তাদেরকেও জামিন দেওয়া হয়। আর উনি এক বছর ধরে জেলে। এটা সাধারণ মানুষের মনে ব্যথা দিচ্ছে। আমি মনে করি, চারদিকে, পুকুরপাড় যখন বাঁধা থাকে পানি বের হতে পারে না। বিএনপি এভাবে চারদিকে বদ্ধ অবস্থায় আছে। বাঁধ ভেঙে যাবে। আমি বললাম আপনাকে।