একজন অপ্রস্তুত বাবা

পৃথিবীর সব থেকে দামি খাবার কি জানো বাবা? 
-(জুমার নামাজ শেষ করে ফেরা বাবা পাঞ্জাবির পকেটে টুপি রাখতে রাখতে) সে তো সামর্থ্য ঠিক করে। ধর, এক প্লেট ভাতও অনেকের কাছে খুব দামি। এই যে পিএসসির রেজাল্টের দিন তোর ছোট খালার বায়নায় পিৎজা কিনতে গেলাম, আরিব্বাস ১৫ টাকা ভ্যাট, ১০ টাকা কী বলে সম্পূরক শুল্ক দিয়ে–টিয়ে দাম ধরিয়ে দিল ৬৫৫ টাকা। 
-বাবা, সামর্থ্য না, আমি সব থেকে দামের কথা বলছি।
-সে তো জানি না। 
-ট্রাফল। এক ধরনের মাশরুম। মাটির নিচে হয় বলে মানুষ ওগুলো খুঁজে পায় না। তবে সুন্দর গন্ধ হয়। এই ঘ্রাণ শুঁকেই ট্রাফল খুঁজে পায় লাগোটো রোমানিয়োলো নামে এক ধরনের কুকুর। 
-তাই বুঝি! কত দাম? 
-আর্টিকেলে লিখেছে, প্রতি কেজি পাঁচ হাজার ডলারও হতে পারে। টাকায় পাঁচ লাখ, তাই না বাবা? ট্রাফল দিয়ে চকলেটও বানানো হয়। পৃথিবীর সব থেকে দামি চকলেট। কেমন হয় খেতে...
হয়তোবা পৃথিবীর সব থেকে দামি চকলেটের স্বাদ ভাবতে ভাবতেই সার্থক ওপাশে ফেরে। ওর বেডের পাশে মন ভালো করে দেওয়া একটা জানালা আছে। ভাগ্যিস। ছেলেটা একটুখানি সকাল দুপুর দেখতে পায়। দেখতে পায় রং দোলানো একটুখানি কৃষ্ণচূড়ার ডাল। ছেলের ঘাড়ে গলায় ওর মায়ের বুলানো পাউডার, নাপিতের কাঁচি না ছোঁয়া, মাস দেড়েকের কোঁকড়ানো চুল, পাশ টেবিলে পড়ে থাকা আধখাওয়া কমলালেবু কিংবা এ ঘরে হুহু করা অস্ফুট সব দীর্ঘশ্বাস দেখতে দেখতে বাবার তখন খুব আগের এক হাসপাতালের দিন মনে পড়ে।
তত দিনে বাবার মনে ছিল রাংতা বিশ্বাস, আমার মেয়েই হবে, দেখো। মেয়ের জামা, জুতো, পুতুলে জুড়ে আছে ঘর। নামও বাছাই হয়ে গেছে অহনা, ভোরের প্রথম আলো। অথচ ডাক্তার মধ্যরাতে অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে জানাল ছেলে হয়েছে। কী যে ভীষণ অপ্রস্তুত লাগছিল নিজেকে। নাম ঠিক নেই, একগাদা মেয়েদের কাপড় তোয়ালের ভিড়ে ছেলে যেন বেমানান। কেমন এক অপরাবোধও ছিল। তখনই বাইরে ছুটে যেতে চায়। কোন একটা কাপড়ের দোকান খোলা থাকে যদি এই রাতে। 
আম্মা তখন চেঁচিয়ে উঠেছিল-যাচ্ছোটা কোথায়?
-দু–একটা জামা কিনে...
-আজান দাও। হয়েছ তো বাবার মতো, মাথায় কিছু একবার ঢুকলে আর বেরোবে না। মেয়েই হবে, আলট্রা সাউন্ড করাব না। তোমার পাগলামিতে নাচলে তো আমাদের চলে না। নাও তোমার ছেলের জামা। আমি আর বউমা ঠিক করেছিলাম, ছেলে হলে নাম রাখব সার্থক। 
সবাই কেমন সবটা চমৎকার সামলে নিয়েছিল সেদিন। অপ্রস্তুত বাবা অবশ্য আজান শেষে বাইরে ছুটে গিয়েছিল। হাসপাতালের সামনের মাঠে কত কৃষ্ণচূড়ার ফুল পড়ে থাকতে দেখেছে। ছেলেকে কোলে তুলে নিয়েছিল সেই কৃষ্ণচূড়া দিয়ে। ওইটুকু লালে ছুঁয়ে ছিল ছেলে আর অপ্রস্তুত বাবার একান্ত সম্পর্ক। 
ছেলের কাছে নিজেকে বরাবরই অপ্রস্তুত মনে হয় বাবার। মশিউর ভাই যেদিন হেমাটোলজি রিপোর্ট নিয়ে এসে জানাল, যেখানে অন্তত ১৫০ হাজার থাকার কথা, সার্থকের রক্তে প্লেটলেটস আছে মোটে ২৫ হাজার। আর সব উপাদানও বিপৎসীমার নিচে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট করাতে হবে। সেদিনও ছেলেকে বুকে জড়িয়ে বাবা বলতে পারেনি—ভাববি না কিচ্ছু, বাবা আছি তো। বলতে গিয়ে কেমন থমকে গিয়েছে ছেলেটার শান্ত স্থির জোরের কাছে। সবাই যত ভেঙে পড়েছে, ও যেন তত স্থির হয়েছে অসুখে। 
সেদিনের হাসপাতালের দিনটার মতো সবাই সামলে নেওয়ার চেষ্টা করছে। টাকা জোগাড়ের খুব চেষ্টা করছেন মশিউর ভাই। ভারতে চিকিৎসা করাতে ৫০ লাখ টাকার দরকার। প্রবাসী আত্মীয় বন্ধুদের কাছ থেকে এই কুড়ি দিনে সব মিলিয়ে দুহাজার ডলার জোগাড় করেছেন। অথচ বাবার যেন কিছু করার নেই, করার ক্ষমতা নেই অফিস শেষে ছেলের পাশে বসে থাকা ছাড়া। ছেলেটা সারা দিন বই–ম্যাগাজিন পড়ে, ওসব ভালো না লাগলে পড়ে জানালাটা। সারা দিন যা পড়ে বাবার কাছে সেই সব গল্প করে। এইটুকুতেই যেন আছে বাবা। 
পাশ ফেরানো ছেলেটাকে পেছন থেকে দেখতে দেখতে বাবা ভাবে, সার্থকের মায়ের সঙ্গে একটি কাল্পনিক কথোপকথন। 
-ট্রান্সপ্লান্টটা দেশে করালে হয় না? অফিসের সুবাস ভাই বলছিলেন, পাঁচ-ছয় লাখ টাকায় হয়ে যাবে। এখানেও নাকি সফল চিকিৎসা হচ্ছে। আচ্ছা মিলি, পৃথিবীর সব থেকে দামি চকলেটের দাম কত জানো? ওরকম একটা চকলেট ছেলেকে খাওয়াতে ইচ্ছে হয়। ছোটবেলা থেকেই তো অসুখে পড়লে ছেলেটা বড় চকলেট খেতে ভালোবাসে। 
-ছেলের চিকিৎসা নিয়ে কম্প্রোমাইজ করতে বলছ? যদি ভালো না হয় এখানে? আমাদের ছেলের ব্লাড ক্যানসার হয়েছে শোয়েব। আর তুমি চিকিৎসার টাকা দিয়ে চকলেট কিনতে বলছ! তোমার পাগলামিতে নাচলে আমাদের চলে না। 
কথোপকথনের সঙ্গে ধুঁকতে ধুঁকতে বাবা ভাবে, সত্যিই চলে না। আচ্ছা এখানে কি কোথাও ট্রাফল হয় না? একটা কুকুর হয়ে গন্ধ শুঁকে শুঁকে পৃথিবীর অতল থেকে কেন নিয়ে আসতে পারা যায় না এক আশ্চর্য ট্রাফল! ট্রাফলের গন্ধ খুঁজতে গিয়ে ভীষণ অসুখের ঘ্রাণে বাবার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। পেছন থেকে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে চুলে চুমু খেতে খেতে অপ্রস্তুত বাবা কেঁদে ফেলে- বাবারে, তোর বাবা যে সুপারহিরো না। 
ছেলেও শক্ত করে জড়িয়ে রাখে অপ্রস্তুত বাবার হাত। বাবার হাত থেকে ততক্ষণে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ছে সোনালি রাংতায় মাখা কটা সাধারণ চকলেট। এতক্ষণ পকেটে এগুলোই পুষে রেখেছিল বাবা। সার্থক ঠিক করেছে, কাউকে দেখিয়ে আর কাঁদবে না। নোনতা সব নিখাদ বিষাদ জলের মতো এক ঢোঁকে শুষে নেবে করুণ অসুখে। অথচ কেমন ভিজে আসতে চায় চোখ। সাজিয়ে রাখা কথাগুলো ভারী এক ট্রেনের নিচে চাপা পড়ে থাকে—দার্শনিক কনফুসিয়াস পাঁচটা গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা বলেছিলেন, তার একটা কি জানো বাবা? পিতার সঙ্গে পুত্রের সম্পর্ক। 
কিংবা বলা হয় না সেই মিথটা—পৃথিবীতে সব সন্তানের চোখ এঁকেছিল তাদের পিতা। ঈশ্বর সব পিতাকে সন্তানের চোখ আঁকতে বলেছিলেন। সেই চোখ আঁকতে গিয়ে আনকোরা এক পিতা এলোমেলো করে ফেলেছে ছেলের চোখ। আইবল দেয়নি, এমনভাবে বসিয়েছে, বেচারা এদিক-ওদিক চোখ নাড়াতে পারছে না। অথচ বাবাকে কিছুতেই হেরে যেতে দেবে না ও। বাবার এঁকে দেওয়া চোখকে সার্থক করতে, ভীষণ চেষ্টা করে করে ঘাড় সে ঘুরিয়ে ফেলেছে ২৭০ ডিগ্রি, তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর করে ফেলেছে তার তাবৎ শব্দ শোনার ক্ষমতা। তারপর সবাই অবাক হয়ে দেখে— আহা, কী আশ্চর্য বিহ্বল চোখ। প্যাঁচার সেই গল্পটা কিছুতেই গুছিয়ে বলতে পারে না ছেলে। নোনতা সব জল হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে ছুটে চলা একটা ডিঙির মতো হয়ে গেছে যেন কথারা। 
নিজেকে স্থির করতে করতে, উড়িয়ে দেওয়া একটা বেলুনের মতন ছেলে শুধু এই প্রশ্নটুকুই করে, করতে পারে- পৃথিবীর সব থেকে দামি সম্পর্ক কি জানো বাবা?