'জীবন থেকে নেয়া'

ঈদের দুদিন পর মেয়েকে টেলিফোনে রায়হান সাহেব জানতে চাইলেন, কখন আসবেন। ‘দুপুর দুটা, বেশি দেরি করতে পারবে না আব্বু’, মেয়ে সোজাসুজি জানিয়ে দিল। রায়হান সাহেব টেলিফোন রেখে দিতেই মেয়ে টিনা নিজেই কলব্যাক করল আবার।
-তোমাকে একটা খুব জরুরি কথা বলতে চাই আব্বু।
-কী কথা?
ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন রায়হান সাহেব।
-তুমি ন্যান্সির সাথে হাই-হ্যালোর বেশি কোনো কথা বলবে না আব্বু।
-কেন! কী হয়েছে?
-তোমাকে পরে বলব।
ন্যান্সি তো টিনার খুব ভালো বন্ধু। তার সাথে কী হলো আবার? সেই হাইস্কুল থেকে দেখেছেন তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব। স্কুল ছুটির পর সবাই মিলে কিছুক্ষণ গল্পগুজব, হই হুল্লোড়, তারপর তাদের বাসায় ফেরা। ন্যান্সির জন্মদিনে রায়হান সাহেব কাজ বাদ দিয়ে মেয়েকে তার বান্ধবীর বাসায় নিয়ে গেছেন। হাইস্কুল গ্র্যাজুয়েশনের পর একসঙ্গে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে, সেই প্ল্যান করেছিল তারা। কিন্তু ন্যান্সির ভুল সিদ্ধান্তের কারণে নিউইয়র্ক সিটির কলেজে তাকে ভর্তি হতে হয়। সিটিতে পার্টটাইম কাজ করে ক্লাসে যাওয়া যায়, কিন্তু বছর না যেতেই ভুল ভাঙে ন্যান্সির। সিরিয়াস কিছু পড়তে গেলে দুটো একসাথে এগোয় না, বুঝতে পারে।
রায়হান সাহেবের মেয়ে টিনা ছুটিতে এলেই ন্যান্সি বারবার তাকে কল দিতে থাকে—কীভাবে ট্রান্সফার হবে তাদের ইউনিভার্সিটিতে। তাদের হরিহর আত্মা। একজনকে না দেখে আরেকজন থাকতে পারে না। অবশেষে থার্ড সেমিস্টারে ন্যান্সি ট্রান্সফার নিয়ে আপ স্টেটে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসে। তাদের ডরম এক ছিল না, যদিও মেজর একই ছিল। ক্লাসও ভিন্ন। এবার তারা ডরম ছেড়ে চারজন মিলে ক্যাম্পাসের কাছেই অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেয়।
রায়হান সাহেব প্রথম দিকে মেয়েকে নিষেধ করেছিলেন, ‘ডরম ছেড়ে যেও না।’ মেয়ের সাথে যুক্তিতে পারলেন না। থাকা-খাওয়ার ব্যয় অনেক নিচে নেমে আসবে। নিজের খাবার নিজেই বানিয়ে ফেলবে-এসব অনেক আরগুমেন্ট।
টিনার হাইস্কুলের বান্ধবী ন্যান্সিকে নিয়ে একই অ্যাপার্টমেন্টে সবাই থাকবে। আলাদা আলাদা রুমে। তবে ন্যান্সি মত পাল্টে ফেলে। ন্যান্সির পক্ষে এত ব্যয় কঠিন, তাই অন্য এক বান্ধবীকে নিয়ে তার রুম শেয়ার করবে। তখন থেকেই শুরু হয় ভুল বোঝাবুঝি। রায়হান সাহেব সে খবর মেয়ের কাছ থেকে আগেই জেনেছিলেন এবং মেয়েকে বলেছিলেন, ‘যদি ন্যান্সি ত্যাগ স্বীকার করতে চায়, তাকে সুযোগ দাও। তোমাদের তো কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।’ এ পর্যন্তই। আর কিছু জানেন না।
অনেক দূর, আপ স্টেট, নিউইয়র্ক। ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি রেডি হতে বলেন স্ত্রী নীলিমা বেগমকে। খাবার নেওয়ার দরকার নেই। সময় লেগে যাবে। গরম পড়েছে অনেক। আইস বক্সে খাবার না রাখলে নষ্ট হয়ে যাবে। এগুলো তৈরি করতেও সময় লাগবে। দুপুর একটার মধ্যে পৌঁছানো এখন আর সম্ভব নয়। মেয়ে বারবার ফোন করছিল তোমরা দেরি করছ কেন?
প্রায় সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে। কেন যে রাতে দেরিতে ঘুমাতে গেলেন। ঘর থেকে বের হবেন, তাই সেলফোনে ম্যাসেজ বক্স আবার চেক করলেন। ‘Bring food’, মেয়ের ম্যাসেজ।
তাহলে তো আরও দেরি হয়ে যাবে। ফ্রিজার থেকে আইস কিউবগুলো বের করলেন। অল্প আইস। রেগুলার বক্সে এই আইস কিউবগুলো দিয়ে কিচ্ছুই হবে না। দোকান থেকে এক ব্যাগ আইস কিনতে হবে; কিন্তু সময় কই। কী করা যায়?
নীলিমা বেগম তাড়াহুড়া করে বড় কনটেইনারে আইস কিউবগুলো ঢেলে ভেতরে খাবারের প্লাস্টিকের বক্সগুলো রাখলেন। পর্যাপ্ত আইস নেই।
বের হতে হতে একটা বাজল। আরএফকে ব্রিজ থেকে নেমে হারলেম ড্রাইভ ধরলেন মেজর ডিগ্যানের ট্রাফিক অ্যাভয়েড করতে। এখানেও ট্রাফিক। মেয়ে আবার ফোন করল, ‘তোমরা কোথায়?’
কি বলবেন! মেয়ে তো রেগে যাবে। রায়হান সাহেব আর টেলিফোন ধরলেন না, মেয়ের মাকে দিয়ে দিলেন। তাঁরা কথা বলতে লাগল। জর্জ ওয়াশিংটন ব্রিজ পার হয়ে এখন আরটি ১৭ নর্থ উঠেছেন মাত্র। এর মধ্যে এক ঘণ্টা চলে গেল। নিউইয়র্ক স্টেট থ্রোওয়ে আই-৮৭ উঠলেই আরও দ্রুত গাড়ি চালিয়ে যেতে পারবেন।
রায়হান সাহেব কখনো সময়মতো কোথাও যেতে পারেন না। সবাই জানে। তাই মেয়ে বারবার বলছিল, ‘লেট করো না আব্বু।’
যখন পৌঁছলেন, সন্ধ্যার কয়েক ঘণ্টা বাকি। মফস্বল শহর। ছিমছাম পরিবেশ। অনেক ভালো লাগল রায়হান সাহেবের। কিন্তু এই নিরিবিলি পরিবেশে ওরা কীভাবে থাকবে? অধিকাংশ বাসার সামনে সাইন ঝোলানো, ‘শুধু মাত্র স্টুডেন্টদের ভাড়া দেওয়া হবে।’ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটু দূরে আলাদা বড় ক্যাম্পাস। তার পাশেই ওরা চার বান্ধবী দুতলা ভাড়া নিয়েছে। রায়হান সাহেব কল দিলেন, ‘আম্মু আমরা নিচে, তোমাদের বাসার সামনে গাড়ি পার্ক করে আছি।’
-এখনই নামছি। বলেই তাৎক্ষণিক নিচে নেমে এল।
-আমরা ওপরে যাব না?
-আগে নিচে গাড়িতে বসে খেয়ে নিই। পরে তোমাদের বাসা দেখাব, মেয়ের ঝটপট উত্তর।
-তোমার বান্ধবীরা কি রুমে?
-না আব্বু, কিছুক্ষণ আগে সবাই তাদের বাড়ি চলে গেছে। তোমরা বেশি দেরি করে ফেলেছ। শুধু ন্যান্সি আছে। সে এখন ঘরে না।
-ন্যান্সি কেন থাকবে?
-সে জন্যই তো প্রবলেম হচ্ছে আব্বু। এখানে ওর সম্বন্ধে কিছু বলব না। যদি আসে, শুনে ফেলবে।
গাড়িতে বসেই খাবার সেরে তাঁরা দুতলায় গেলেন। মোটামুটি সুন্দর বাড়ি; চার বেডরুম। অনেক বড় লিভিং রোম; কিচেনটাও অনেক বড়। তবে যত্নের অভাব রয়েছে। মাকড়সা নাকি আছে; কিন্তু রায়হান সাহেব খুঁজে পেলেন না একটাও। লিভিং রুমের কাছে এক কোনায় একটা মরা ইঁদুর দেখলেন। সেটা নিয়েই মেয়েটার যত ভয়। ইঁদুরটি নাকি তাকে কামড় দিবে। তাই ভয়ে কাছে যাচ্ছে না।
-ইঁদুর মাকড়সাকে ভয় পাও! তাহলে থাকবে কীভাবে?
খুব পাওয়ারফুল স্প্রে কিনে নিয়ে এসেছে টিনা পোকামাকড় মারার জন্য। রায়হান সাহেব ও নীলিমা বেগম ঘুরে পুরো দুতলা দেখলেন।
-ন্যান্সির সঙ্গে তোমাদের কি প্রবলেম হয়েছে বলো না আম্মু?
-না এখন বলব না। বাসা থেকে বের হয়ে বলব।
হেভি লাগেজগুলো টিনার রুমে রেখে বাকিগুলো গাড়ির ট্রাংকে তুললেন। ‘নিউইয়র্কের উদ্দেশে রওনা দেওয়ার আগে প্রথমে আমরা ওয়ালমার্টে যাব।’
-ঠিক আছে আব্বু’, মেয়ে সম্মতি জানাল।
জিপিএসে ওয়ালমার্টের অ্যাড্রেস দিয়ে গাড়ি চালাতে লাগলেন। টিনা বলেছিল মাত্র দশ-পনেরো মিনিটের ড্রাইভিং ওর বাসা থেকে ওয়ালমার্ট বা ইউনিভার্সিটি। কিন্তু এ কী, দশ মিনিট তো পার হয়ে গেছে আগেই। তিনি এখন আই-৯০ এন/আই-৮৭ এন-এ প্রায় উঠে যাচ্ছিলেন, মন্ট্রিয়েলের উদ্দেশ্যে। কি ব্যাপার টিনা? ওয়ালমার্ট তো এত দূরে থাকার কথা নয়।
টিনা তার ফোনে অ্যাড্রেস রাখল। ‘এ কী আব্বু! তুমি কোনো ওয়ালমার্টের অ্যাড্রেস দিয়েছ? এ তো ভুল পথে যাচ্ছ, মন্ট্রিয়েলের দিকে। এক্ষুনি এক্সিট নাও।’
তাড়াহুড়া করতে গিয়ে রায়হান সাহেব ইদানীং এমনি ভুল করে বসেন। শুধু শুধু আধা ঘণ্টা আরও নষ্ট হয়ে গেল। ওয়ালমার্টে ঢোকার আগে ম্যাকডোনাল্ডসে ঢুকলেন মেয়েকে নিয়ে কিছু খেতে।
-এবার বল ন্যান্সির সাথে হঠাৎ করে তোমাদের মনোমালিন্য কেন হলো?
টিনা বলতে লাগল, ‘ন্যান্সি সিদ্ধান্ত নিয়েছে সামারে এখানেই থাকবে, বেশ ভালো কথা; কিন্তু আমরা তোমার ইলেকট্রিক বিল, গ্যাস বিল ও ইন্টারনেটের বিল কেন দিতে যাব? আমরা তো পুরো সামারের বাসা ভাড়া ল্যান্ড লর্ডকে অ্যাডভান্স দিয়ে রেখেছি যদিও আমরা কেউ সামারে থাকছি না। সামার বন্ধের পর যখন আসব, তখন এসব ইউটিলিটি অ্যাকটিভ করব। ন্যান্সি থাকলে তাকেই একা পরিশোধ করতে হবে এখন বিলগুলো। প্লাস লিভিং রুম অনেক বড় বিধায় ন্যান্সি চায় তাদের দুজনের একজন লিভিং রুমে থাকবে। এটাও একটা প্রবলেম’, এই বলে মেয়ে থামল।
-আচ্ছা, এই বিষয়! এই সামান্য জিনিস নিয়ে ফ্রেন্ডশিপ নষ্ট করবে? রায়হান সাহেব মেয়েকে বললেন।
-আব্বু তুমি জানো না, ন্যান্সি ভীষণ সেলফিশ হয়ে গেছে। সে আমার আরেক বন্ধু জেনিফারকে উবার ড্রাইভারের মতো ব্যবহার করতে চায়। যখন-তখন তাকে রাইড দিতে বলে। সে কি তার উবার ড্রাইভার? বল? এত দিন ওর কাছাকাছি ছিলাম না, তাই ওকে বুঝতে পারিনি। এখন আমরা ওকে কিছু বলব না। আমরা অন্য সব বান্ধবীরা এক আছি। আমাদের কথা না শুনলে সামারে ন্যান্সিকে আমরা কিক-আউট করব।
-না আম্মু এগুলো করো না, রায়হান সাহেব আবার মেয়েকে বললেন।
-ন্যান্সিকে বোঝাও। জীবনের শুরুতে তোমাদের অভিজ্ঞতার অভাব তাই এমন হচ্ছে। সব ঠিক হয়ে যাবে। এত দিনের বন্ধুত্ব নষ্ট করতে যেও না।
-ন্যান্সি তো আমার হাইস্কুলের বন্ধু। কিন্তু আমার অন্য বন্ধুরা ওকে চিনত না। ওরা কেন সেক্রিফাইস করবে আব্বু? তুমি ন্যান্সির সঙ্গে একদম কথা বলবে না। আমাদের প্রবলেম আমাদের সলভ করতে দাও।
রাত অনেক হয়ে যায় সেদিন মেয়েকে নিয়ে নিউইয়র্কে ফিরতে। রায়হান সাহেবের ভাবতে ভালো লাগে, সেদিনের এই ছোট্ট মেয়েটি জটিল সমস্যার সমাধান এখন নিজে নিজেই করতে জানে! মনে হলো কত আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথা বলে সে। দিনগুলো এভাবেই এগিয়ে যায়।